হাওর বার্তা ডেস্কঃ বর্ষা এলেই ঢাকা, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, নরসিংদী, খুলনা, রাজবাড়ি ও মৌলভীবাজারে নৌকা বাইচ উৎসবে পরিণত হয়। এসব অঞ্চলে বিভিন্ন দিবস ও আঞ্চলিক সময়সূচি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়। তবে ঢাকা, মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলে নৌকা বাইচের বাকি আর মাত্র কয়েক দিন। এজন্য নৌকার মালিক আর মাঝি-মাল্লারা পার করছে ব্যস্ত সময়।
ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার দেওতলা মাঠে গিয়ে দেখা যায় ‘মাসুদ রানা’ নৌকা। নৌকার একপাশে মালিক মো. মাসুম মোল্লা অপর পাশে মিস্ত্রি। দম ফেলানোর সময় নেই তাদের। যেভাবেই হোক বাংলা সনের ভাদ্র মাসের ১ তারিখে নৌকা নদীতে নামাতেই হবে। এখনো সেই উপযোগী করতে কাজ বাকি ২৫ ভাগ। তাইতো নৌকার মালিক নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে সারা দিন রাত মিস্ত্রির সঙ্গেই দিন কাটান। তিনি প্রায় দুই যুগ ধরে নৌকা বাইচ করেন। বছরের জমাকৃত টাকা খরচ করেন এই সময়। কিন্তু পায়নি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
নৌকার মালিক মাসুদ মোল্লা বলেন, গত ১৫-২০ বছর ধরে বর্ষা মৌসুম আসলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নৌকা বাইচে অংশগ্রহণ করি। কিন্তু গত বেশ কয়েক বছর ধরে ইছামতি নদীতে পানি না থাকায় এই উৎসব তেমন হয়নি। তবুও প্রস্তুত রাখি নৌকা। আগে লোকজন স্ব উদ্যোগে বাইচের আয়োজন করেছে। কিন্তু এখন মারামারির ভয়ে তেমন একটা আয়োজন হয় না। তাই আমি নিজেই গ্রামবাসিকে নিয়ে দেওতলা নবারুন সংঘের উদ্যোগে বাইচের আয়োজন করি। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমরা মানুষকে বিনোদন দেওয়ার জন্য নিজের পকেটের টাকা খরচ করে অংশ গ্রহন করি। কিন্তু সরকার আমাদের কোনো খোজখবর নেয় না।
অপরদিকে, উপজেলার খানেপুরের প্রবাসী শেখ আনছের মাদবরের ছেলে শেখ রায়হান নির্মাণ করছেন বিশাল এক সিপ (ঘাসী) নৌকা। নৌকার দের্ঘ্য ৮৭ হাত। নৌকার সামনে একজন আর পেছনে হেড চালকসহ প্রায় ৫০-৬০ জন মাল্লা নদীতে বৈঠা লাগাবে। ইতোমধ্যে নৌকার নাম ঠিক করা হয়েছে। পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নৌকার নাম হবে ‘শেখ বাড়ি’। নির্মাণ কাজ শেষ হলেই পুরো নৌকা সাজানো হবে বিভিন্ন কালারের রং দিয়ে। নৌকার পেছনে বড় বড় অক্ষরে লেখা হবে নৌকা ও নৌকার মালিকের নাম।
নৌকার মালিক শেখ রায়হান বলেন, ছোটবেলায় বিভিন্ন নৌকার মাল্লা হয়ে বাইচ দিতাম। বন্ধ্বুদের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় বাইচ দেখতে যেতাম। এক সময় নৌকা বাইচ নেশায় পরিণত হয়। এক সময় ইচ্ছে হল নিজেই নৌকার মালিক হব। যেই ইচ্ছা সেই কাজ। আজ থেকে প্রায় ১০-১২ বছর আগে একটি কোষা নৌকা বানাই। কয়েক বছর বিভিন্ন বাইচে অংশ গ্রহণ করি। এরপর চলে যাই প্রবাসে । হঠাৎকরে গত বছর দেশে আশার পর আবার মনে হয় হাজার বছরের ঐতিহ্য নৌকা বাইচের কথা। নির্মাণ করি ৫০ হাত দৈর্ঘ্যের কোষা নৌকা। তবে এবার ওটা বিক্রি করি উপজেলার সবচাইতে বড় নৌকা নির্মাণ করছি।
তিনি জানান, নৌকাটি বানানো হচেছ সেগুন কাঠ দিয়ে। এক মাস ধরে ৫-৭ জন মিস্ত্রি দিন রাত কাজ করছে। আশা করি আগামী ৪-৫ দিনের মধ্যে নদীতে নামানো যাবে। এ ব্যাপারে নৌকা বাইচ ঐতিহ্য রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সোনার বাংলার নৌকার মালিক ডা. শাহীনূর ইসলাম বলেন, পদ্মা নদীর উৎপত্তিস্থল সোনাবাজু এলাকার বেড়িবাধে স্লুইচ গেট না থাকায় ইছামতি নদী এখন মৃতপ্রায়। পানির অভাবে এখন আর আগেন মতো বাইচ হয় না। এক সময় নবাবগঞ্জে ইছামতি নদীতে প্রায় ১৫-২০টি পয়েন্টে আয়োজন করা হতো নৌকাবাইচ। কিন্তু সরকারি সহায়তা না পেয়ে এখন অনেক স্থানেই বন্ধ হয়ে গেছে এ উৎসব।
সূত্র জানায়, নৌকাবাইচ বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি অংশ। তবে কবে এদেশে গণবিনোদন হিসেবে নৌকাবাইচের প্রচলন হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে এ বিষয়ে দুটি জনশ্রুতি রয়েছে। একটি জনশ্রুতি জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রাকে কেন্দ্র করে। জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার সময় স্নানার্থীদের নিয়ে বহু নৌকার ছড়াছড়ি ও দৌড়াদৌড়ি পড়ে যায়। এতেই মাঝি-মাল্লা-যাত্রীরা প্রতিযোগিতার আনন্দ পায়। এ থেকে কালক্রমে নৌকাবাইচ শুরু। দ্বিতীয় জনশ্রুতি পীর গাজীকে কেন্দ্র করে। ১৮ শতকের শুরুর দিকে কোনো এক গাজী পীর মেঘনা নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়ে অন্য পাড়ে থাকা তা ভক্তদের কাছে আসার আহ্বান করেন। কিন্তু ঘাটে কোনো নৌকা ছিল না। ভক্তরা তার কাছে আসতে একটি ডিঙ্গি নৌকা খুঁজে বের করেন। যখনই নৌকাটি মাঝ নদীতে এলো তখনই নদীতে তোলপাড় আরম্ভ হলো।
নদী ফুলেফেঁপে উঠলো। তখন চারপাশে যত নৌকা ছিল তারা খবর পেয়ে ছুটে আসে। তখন সারি সারি নৌকা একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলে। এ থেকেই নৌকাবাইচের গোড়াপত্তন হয়। মুসলিম যুগের নবাব-বাদশাহদের আমলে নৌকাবাইচ বেশ জনপ্রিয় ছিল। অনেকে মনে করেন, নবাব বাদশাহদের নৌবাহিনী থেকেই নৌকাবাইচের গোড়াপত্তন হয়। পূর্ববঙ্গের ভাটি অঞ্চলের রাজ্য জয় ও রাজ্য রক্ষার অন্যতম কৌশল ছিল নৌশক্তি। বাংলার বারো ভুঁইয়ারাও নৌ-বলেই মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। মগ ও হার্মাদ জলদস্যুদের দমনে নৌশক্তি কার্যকর ভূমিকা রাখে। এসব রণবহর বা নৌবহরে দীর্ঘাকৃতির ছিপ জাতীয় নৌকা থাকতো।
একেক অঞ্চলে একেক রকমের নৌকার প্রচলন রয়েছে। তবে নৌকাবাইচের জন্য যে নৌকা ব্যবহার করা হয় সেটা হয় সরু ও লম্বাটে। কারণ, সরু ও লম্বাটে হওয়ায় পানি কেটে দ্রুত চলতে সক্ষম এ নৌকা। নৌকার সামনের গলুইটাকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়। কখনো করা হয় ময়ূরের মুখ, কখনো রাজহাঁস বা অন্য কোনো পাখির মুখাবয়ব। ঢাকা, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ অঞ্চলগুলোতে বাইচের জন্য সাধারণত কোশা নৌকা ব্যবহৃত হয়। এর গঠন সরু এবং লম্বায় প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ ফুট পর্যন্ত হয়। কোশা নৌকার সামনের ও পেছনের অংশ একেবারে সোজা। বাইচের নৌকাগুলোর রয়েছে বিভিন্ন নাম।
অগ্রদূত, ঝড়ের পাখি, পঙ্খীরাজ, ময়ূরপঙ্খী, সাইমুন, তুফানমেইল, সোনার তরী, দীপরাজ ইত্যাদি। নৌকায় ওঠার ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক আনুষ্ঠানিকতা। সকলে পাক-পবিত্র হয়ে গেঞ্জি গায়ে মাথায় একই রঙের রুমাল বেঁধে নেয়। সবার মধ্যখানে থাকেন নৌকার নির্দেশক। প্রতিটি নৌকায় ৫০ থেকে ১০০ জন মাঝি থাকে। যে কেউই নৌকার মাঝি হতে পারতো না। মাঝি হতে হলে তাকে একটু হৃষ্টপুষ্ট হতে হতো। ছয় মাস আগ থেকেই বাছাই করা হতো মাঝিদের।