ঢাকা ০৫:৪৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হারিয়ে যাচ্ছে পাল তোলা নৌকা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:১৯:৩৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৬ অগাস্ট ২০১৮
  • ১২৬৮ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পাল তোলা ওই নায়ের মাঝি/ ভাটিয়ালি গায়/ ঘোমটা পরা গায়ের বধূ/ শশুরবাড়ি যায়। ও মাঝি ভাই ও মাঝি ভাই/ কোন সে গাঁয়ে যাও/রূপগঞ্জে মামার বাড়ি আমায় নিয়ে যাও/আষাঢ় মাসে ভাসা পানি/পুবালী বাতাসে বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি/আমারনি কেউ আসে। মাঝিকে গাঁয়ের বধুর এমন আকুতি হারিয়ে গেছে। খালে-বিলে ও নদীতে নেই আর সেই মাঝি ভাইয়ের পাল তোলা নৌকা। আছে শুধু সেই সব সোনাঝরা দিনের স্মৃতি বিজরিত ছড়া-কবিতা-গান।

আধুনিক নগর সভ্যতার যুগে যান্ত্রিক যানবাহনের ভারে পাল তোলা নৌকা আজ হারিয়ে গেছে। হাতে গোনা দু’একটা চোখে পরলেও তাদের নৌকায় আগের মতো আর মানুষ ওঠে না। নতুন বধূ বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য পাল তোলা নৌকার বায়না ধরে না। কেননা স্পিডবোটে ঝুঁকি কম এবং দ্রুত গন্তব্যে পৌছানো যায়।

08

আগে গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি বাড়ির ঘাটে সারি সারি পাল তোলা নৌকা বাঁধা থাকতো। এখন যান্ত্রিক ষ্পিডবোট তার স্থান দখল করে নিয়েছে। এখনও নদীমাতৃক আমাদের জীবন-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। কিন্তু পানি শূন্যতা আমাদের সবকিছু পানসে করে দিচ্ছে। যুগের হাওয়া বদলে গেছে। যান্ত্রিক যানবাহন হটিয়ে দিচ্ছে জীবন নির্ভর যানবাহনকে। শেকড় সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে জীবন। নদী আর নৌকা ছিল রূপগঞ্জের গ্রাম্যজীবনের বহমানতা। সভ্যতার পালে লেগেছে হাওয়া। ছুটছে মানুষ দ্রুত। কোথায় যাচ্ছে এবং কেন যাচ্ছে তা কারো জানা নেই। গুরুজনেরা বলেন, পিপীলিকার পাখা গজিয়েছে বর্তমান লোকদের। তাই প্রতিনিয়ত মৃত্যুর দিকে ছুটছে মানুষ।

আধুনিক যানবাহনে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। এ যেন সভ্যতার নামে মানুষের মৃত্যুর মিছিলে যোগদান। ব্রাহ্মণখালী এলাকার আব্দুল ওহাব মিয়া বলেন, আধুনিক সভ্যতার নামে ছুটছি আমরা। দ্রুত মরছি আমরা। যান্ত্রিকতা আমাদের তাড়া করছে। তাই পাল তোলা নৌকায় আমাদের আর চলে না।

09

দক্ষিনবাগ এলাকার নায়েব আলী বলেন, ইঞ্জিনচালিত শ্যালো নৌকা এখন আমাদের সঙ্গী হয়েছে। ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়া আর ভটভট বিকট শব্দ পরিবেশ নষ্ট করছে, করুক তাতে কার কি আসে যায়। আমরাতো ছুটছি দ্রুত। আমাদের সন্তানেরা মরে মরুক। পরিবেশ দূষিত হয় হোক-তাতো দেখার কেউ নেই।

নদীতে সারি সারি পাল তোলা নৌকার সেই মনোরম, মনোহর ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এখন শুধুই স্মৃতি। বাঘবাড়ি এলাকার নুরুল হক মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, আহারে আগে খালে-বিলে-নদীতে কত রকম নৌকা চলতো নাইয়রি নৌকা, পাল তোলা নৌকা, কেড়াই নৌকা, সাপুরিয়া নৌকা, ভোট নৌকা, পানসি নৌকা, বৌচোরা নৌকা, গয়না, লক্ষী বিলাস, গন্ডী বিলাস, বজরা, খেয়া নৌকা, কোসা নৌকা, ডিঙ্গি নৌকা, বাইচের নৌকা ও মহাজনী নৌকা। সেসব এখন জাদুঘরে।

সত্যিই এখন আর আগের মতো রূপগঞ্জে নৌকা দেখা যায় না। মাঝির কন্ঠে শোনা যায় না-‘মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে, আমি আর বাইতে পারলাম না’। গ্রামীণ নৌকা জীবনে এসেছে যান্ত্রিকতা। এখন আর মাঝিকে গুণ টেনে নৌকা চালাতে হয় না। নদী হারিয়েছে নাব্যতা। এছাড়া নদীতে ব্রিজ হয়েছে। বিলগুলো পানি শূন্য সারা বছর। জলাশয়গুলো বালি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। পাল তোলা নৌকা চলবে কোথায়? তাই এখন শুধুই স্মৃতির জাবরকাটা।

10

যান্ত্রিক সভ্যতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে পাল তোলা নৌকা। কদর নেই মাঝি-মাল্লাদেরও। নৌকায় পাল এবং দাঁড়-বৈঠার পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজেল চালিত ইঞ্জিনের নৌকা। মাঝে মধ্যে দু’একটা পাল তোলা নৌকা এখনো নদ-নদীতে দেখা যায়। পালের নাওকে উপজীব্য করে যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা রচনা করেছেন তাদের অমূল্য কবিতা, ছড়া, গান, গল্প ইত্যাদি। শুধু দেশি কবি-সাহিত্যিক নয় বিদেশি শিল্পী-সাহিত্যিক, রসিকজনসহ অনেক পর্যটকের মনেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল পালের নাও। এ ব্যাপারে কথা হয় পরিবেশ আন্দোলনের নেতা, বিশিষ্ট কলামিষ্ট, কবি, গবেষক ও সাংবাদিক লায়ন মীর আব্দুল আলীমের সাথে। তিনি বলেন, নৌকাই ছিল আদি বাহন। যুগের চাহিদা অনুযায়ী ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারেরও আবেদন রয়েছে। তাই বলে গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ভুলে গেলে চলবে না। সেই নৌকাগুলোর কদরও যাতে সব সময় থাকে তারও একটা ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

হারিয়ে যাচ্ছে পাল তোলা নৌকা

আপডেট টাইম : ১১:১৯:৩৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৬ অগাস্ট ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পাল তোলা ওই নায়ের মাঝি/ ভাটিয়ালি গায়/ ঘোমটা পরা গায়ের বধূ/ শশুরবাড়ি যায়। ও মাঝি ভাই ও মাঝি ভাই/ কোন সে গাঁয়ে যাও/রূপগঞ্জে মামার বাড়ি আমায় নিয়ে যাও/আষাঢ় মাসে ভাসা পানি/পুবালী বাতাসে বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি/আমারনি কেউ আসে। মাঝিকে গাঁয়ের বধুর এমন আকুতি হারিয়ে গেছে। খালে-বিলে ও নদীতে নেই আর সেই মাঝি ভাইয়ের পাল তোলা নৌকা। আছে শুধু সেই সব সোনাঝরা দিনের স্মৃতি বিজরিত ছড়া-কবিতা-গান।

আধুনিক নগর সভ্যতার যুগে যান্ত্রিক যানবাহনের ভারে পাল তোলা নৌকা আজ হারিয়ে গেছে। হাতে গোনা দু’একটা চোখে পরলেও তাদের নৌকায় আগের মতো আর মানুষ ওঠে না। নতুন বধূ বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য পাল তোলা নৌকার বায়না ধরে না। কেননা স্পিডবোটে ঝুঁকি কম এবং দ্রুত গন্তব্যে পৌছানো যায়।

08

আগে গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি বাড়ির ঘাটে সারি সারি পাল তোলা নৌকা বাঁধা থাকতো। এখন যান্ত্রিক ষ্পিডবোট তার স্থান দখল করে নিয়েছে। এখনও নদীমাতৃক আমাদের জীবন-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। কিন্তু পানি শূন্যতা আমাদের সবকিছু পানসে করে দিচ্ছে। যুগের হাওয়া বদলে গেছে। যান্ত্রিক যানবাহন হটিয়ে দিচ্ছে জীবন নির্ভর যানবাহনকে। শেকড় সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে জীবন। নদী আর নৌকা ছিল রূপগঞ্জের গ্রাম্যজীবনের বহমানতা। সভ্যতার পালে লেগেছে হাওয়া। ছুটছে মানুষ দ্রুত। কোথায় যাচ্ছে এবং কেন যাচ্ছে তা কারো জানা নেই। গুরুজনেরা বলেন, পিপীলিকার পাখা গজিয়েছে বর্তমান লোকদের। তাই প্রতিনিয়ত মৃত্যুর দিকে ছুটছে মানুষ।

আধুনিক যানবাহনে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। এ যেন সভ্যতার নামে মানুষের মৃত্যুর মিছিলে যোগদান। ব্রাহ্মণখালী এলাকার আব্দুল ওহাব মিয়া বলেন, আধুনিক সভ্যতার নামে ছুটছি আমরা। দ্রুত মরছি আমরা। যান্ত্রিকতা আমাদের তাড়া করছে। তাই পাল তোলা নৌকায় আমাদের আর চলে না।

09

দক্ষিনবাগ এলাকার নায়েব আলী বলেন, ইঞ্জিনচালিত শ্যালো নৌকা এখন আমাদের সঙ্গী হয়েছে। ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়া আর ভটভট বিকট শব্দ পরিবেশ নষ্ট করছে, করুক তাতে কার কি আসে যায়। আমরাতো ছুটছি দ্রুত। আমাদের সন্তানেরা মরে মরুক। পরিবেশ দূষিত হয় হোক-তাতো দেখার কেউ নেই।

নদীতে সারি সারি পাল তোলা নৌকার সেই মনোরম, মনোহর ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এখন শুধুই স্মৃতি। বাঘবাড়ি এলাকার নুরুল হক মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, আহারে আগে খালে-বিলে-নদীতে কত রকম নৌকা চলতো নাইয়রি নৌকা, পাল তোলা নৌকা, কেড়াই নৌকা, সাপুরিয়া নৌকা, ভোট নৌকা, পানসি নৌকা, বৌচোরা নৌকা, গয়না, লক্ষী বিলাস, গন্ডী বিলাস, বজরা, খেয়া নৌকা, কোসা নৌকা, ডিঙ্গি নৌকা, বাইচের নৌকা ও মহাজনী নৌকা। সেসব এখন জাদুঘরে।

সত্যিই এখন আর আগের মতো রূপগঞ্জে নৌকা দেখা যায় না। মাঝির কন্ঠে শোনা যায় না-‘মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে, আমি আর বাইতে পারলাম না’। গ্রামীণ নৌকা জীবনে এসেছে যান্ত্রিকতা। এখন আর মাঝিকে গুণ টেনে নৌকা চালাতে হয় না। নদী হারিয়েছে নাব্যতা। এছাড়া নদীতে ব্রিজ হয়েছে। বিলগুলো পানি শূন্য সারা বছর। জলাশয়গুলো বালি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। পাল তোলা নৌকা চলবে কোথায়? তাই এখন শুধুই স্মৃতির জাবরকাটা।

10

যান্ত্রিক সভ্যতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে পাল তোলা নৌকা। কদর নেই মাঝি-মাল্লাদেরও। নৌকায় পাল এবং দাঁড়-বৈঠার পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজেল চালিত ইঞ্জিনের নৌকা। মাঝে মধ্যে দু’একটা পাল তোলা নৌকা এখনো নদ-নদীতে দেখা যায়। পালের নাওকে উপজীব্য করে যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা রচনা করেছেন তাদের অমূল্য কবিতা, ছড়া, গান, গল্প ইত্যাদি। শুধু দেশি কবি-সাহিত্যিক নয় বিদেশি শিল্পী-সাহিত্যিক, রসিকজনসহ অনেক পর্যটকের মনেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল পালের নাও। এ ব্যাপারে কথা হয় পরিবেশ আন্দোলনের নেতা, বিশিষ্ট কলামিষ্ট, কবি, গবেষক ও সাংবাদিক লায়ন মীর আব্দুল আলীমের সাথে। তিনি বলেন, নৌকাই ছিল আদি বাহন। যুগের চাহিদা অনুযায়ী ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারেরও আবেদন রয়েছে। তাই বলে গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ভুলে গেলে চলবে না। সেই নৌকাগুলোর কদরও যাতে সব সময় থাকে তারও একটা ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে।