ঢাকা ০৪:০৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নজরুলের কবিতায় কোরবানির মহিমা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৭:৫২:২২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫
  • ৪৩৫ বার

মানুষের বিচিত্র জিজ্ঞাসার মধ্যে হজরত ইব্রাহিম আ:-ই প্রথম পুরুষ, যিনি অস্তিত্বের মূল সত্যকে আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁরই হাত ধরে যুক্তির সাহায্যে ইসলামি বিশ্বাস বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁরই হাত ধরে বিশ্ব নরনারীর মধ্যে সত্যের যথার্থ উন্মেষ ঘটেছে, মূলত মহান আল্লাহর অস্তিত্ব অনুসন্ধানমূলক আবিষ্কারের ফলে। হজরত ইব্রাহিম আ:-এর আগে অতীতেও যে সত্যের অনুসন্ধান ছিল না তা নয়। অবশ্যই ছিল। তবে তাঁর সময়কার সত্যতা আবিষ্কারের মাত্রা ছিলো অন্যরকম। কেননা সেই সময়ে মহান আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে জিজ্ঞাসা ছিল সর্বত্র। আর এর মধ্যে মহাচ্যালেঞ্জস্বরূপ ত্যাগের যে সত্যতা ‘কোরবানি’ বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা যুগ যুগ ধরে আসছে বিশ্ব মুসলমানদের দুয়ারে ঈদুল আজহার দিনে।
কোরবানি আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। হাদিসে আছে আল্লাহর উদ্দেশে যে কোরবানি দেয়া হয়, সেই কোরবানি জন্তুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা মহান আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। যার প্রতিদান সাথে সাথে আল্লাহ মঞ্জুর করে দেন। প্রকৃতই ত্যাগের মহিমা অপার। যে মহিমার বর্ণনা দিতে বিদ্রোহী কবি নজরুল তার বিদ্রোহী সুরে বলেছিলেন :
‘যে আপন পুত্রে আল্লারে দেয়
শহীদ হওয়ার তরে
কা’বাতে সে যায় নারে ভাই
নিজেই কাবা গড়ে।’
প্রকৃতই নজরুলের এ ভাষ্য জানান দেয় তাদের প্রকৃত কোরবানির। যারা দেহ-মন নিয়ে আল্লাহর কাছে নিবেদিত এক প্রাণ। নজরুল অবশ্যই তার কাব্যিক এ রচনাকে গ্রহণ করেছেন মহান সৃষ্টিকর্তার বাণী থেকে। পবিত্র কুরআন বারবার বলেছে, ‘এ পৃথিবীতে তোমার জীবন লাভের কারণে তুমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ হও এবং আল্লাহর কাছে নিজেকে উৎসর্গ করো।’ এ উৎসর্গের মাধ্যমেই মানুষ সফলকাম হয়। কিন্তু মানুষের উৎসর্গ করার কী আছে? প্রত্যেক মানুষেরই তো একটি মাত্র প্রাণ যার দানকর্তাও আল্লাহ। তাই যে জীবন বা প্রাণ মানুষ পেয়েছে তার জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। এবং এ কৃতজ্ঞতার প্রতীকী হিসেবে বিশ্বাসী মুসলমানেরা পেয়েছে ইব্রাহিম আ:-এর ‘কোরবানি’ প্রদান। পবিত্র কুরআনে ‘কোরবানি’ প্রসঙ্গে অন্য এক ভাষ্যে বলা হয়েছে, কোরবানির পশুর গোশত বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না। এর মধ্যে যে উদ্দেশ্য কিংবা ত্যাগ রয়েছে সেটিই শুধু আল্লাহর দরবারে পৌঁছায়। কবি নজরুল অতি সুন্দরভাবে এ ত্যাগের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন-
‘আজ শোর ওঠে জোর
খুন দে জান শির, বৎস শোন।
ওরে হত্যা নয় সত্যাগ্রহ
শক্তির উদ্বোধন।
দুধারি ধার শেরে খোদায়
রক্তে-পুত-বদন
খুনে আজ রুদবো মন
ওরে শক্তি হস্তে মুক্তি
শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন।’
হজরত ইব্রাহিম আ: আল্লাহর কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছিলেন ‘কোরবানি’ করো তোমার প্রিয়তম বস্তুকে। যার সূত্র ধরে আজকের এ ত্যাগের উৎসব। কিন্তু এখনকার ত্যাগ! অনেকটাই লোকদেখানো মায়াকান্না! অনেক ক্ষেত্রে অর্থবল, বাহুবল গ্রাস করে নিয়েছে মানুষের খাঁটি মনকে। ফলে ত্যাগ-তিতিক্ষা সাধারণের কাছে এক মহাকঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানব সভ্যতার এ অগ্রগতির (!) দিনে প্রকৃতই ঈদুল আজহার শাশ্বত বাণী অতি প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিকতার এ আলোচনাক্রমে কাজী নজরুলের কাব্যিক রচনায় আরো একবার দৃষ্টি দেয়া যাক। নজরুল তার তথাকথিত মায়াকান্নাধারীদের উদ্দেশে বলেছেন-
‘ওরে ফাঁকিবাজ ফেরেববাজ
আপনারে আজ দিসনে লাজ
গরু ঘুষ দিয়ে চাস সওয়ার?
যদিইরে তুই গরুর সাথে
পার হয়ে যাস পুলসিরাত
কি মহাম্মদে জওয়াব?
নজরুল তার আরেক রচনায় মানুষের স্বভাবসুলভ আচরণকে শ্লেষ দিয়ে লিখেছেনÑ
নামাজ রোজার শুধু ভড়ং
ইয়া উয়া পরে সেজেসে সং
ত্যাগ নেই তোর এক জড়
ত্যাগের নামেতে জড়সড়
তোর নামাজের কি আছে দাম?
প্রকৃতই যাদের ত্যাগ নেই, মুখোশের আড়ালে থাকায় স্বভাবটা আয়ত্ত করে নিয়েছেন তাদের কাছে আধ্যাত্মিক ও সামাজিক বার্তা দুই-ই নিরর্থক। তাই প্রার্থনা করি অন্তত ঈদুল আজহার দিনে এর যথার্থ উন্মেষ হোক। অবশ্যই এখনো উন্মেষ ঘটছে বলে মানুষ মানুষের জন্য কাঁদতে পারে, রক্ত দেখলে আঁতকে ওঠে, দুর্যোগ মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, অনাহারি বুভুক্ষুদের অন্নবস্ত্রের সংস্থান করে, কোলে তোলে নেয় এবং সর্বোপরি অনাথ, নিরাশ্রয়ীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে। সেই বোধগম্য এবারেও জাগ্রত হোকÑ এ আমাদের প্রার্থনা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

নজরুলের কবিতায় কোরবানির মহিমা

আপডেট টাইম : ০৭:৫২:২২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

মানুষের বিচিত্র জিজ্ঞাসার মধ্যে হজরত ইব্রাহিম আ:-ই প্রথম পুরুষ, যিনি অস্তিত্বের মূল সত্যকে আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁরই হাত ধরে যুক্তির সাহায্যে ইসলামি বিশ্বাস বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁরই হাত ধরে বিশ্ব নরনারীর মধ্যে সত্যের যথার্থ উন্মেষ ঘটেছে, মূলত মহান আল্লাহর অস্তিত্ব অনুসন্ধানমূলক আবিষ্কারের ফলে। হজরত ইব্রাহিম আ:-এর আগে অতীতেও যে সত্যের অনুসন্ধান ছিল না তা নয়। অবশ্যই ছিল। তবে তাঁর সময়কার সত্যতা আবিষ্কারের মাত্রা ছিলো অন্যরকম। কেননা সেই সময়ে মহান আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে জিজ্ঞাসা ছিল সর্বত্র। আর এর মধ্যে মহাচ্যালেঞ্জস্বরূপ ত্যাগের যে সত্যতা ‘কোরবানি’ বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা যুগ যুগ ধরে আসছে বিশ্ব মুসলমানদের দুয়ারে ঈদুল আজহার দিনে।
কোরবানি আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। হাদিসে আছে আল্লাহর উদ্দেশে যে কোরবানি দেয়া হয়, সেই কোরবানি জন্তুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা মহান আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। যার প্রতিদান সাথে সাথে আল্লাহ মঞ্জুর করে দেন। প্রকৃতই ত্যাগের মহিমা অপার। যে মহিমার বর্ণনা দিতে বিদ্রোহী কবি নজরুল তার বিদ্রোহী সুরে বলেছিলেন :
‘যে আপন পুত্রে আল্লারে দেয়
শহীদ হওয়ার তরে
কা’বাতে সে যায় নারে ভাই
নিজেই কাবা গড়ে।’
প্রকৃতই নজরুলের এ ভাষ্য জানান দেয় তাদের প্রকৃত কোরবানির। যারা দেহ-মন নিয়ে আল্লাহর কাছে নিবেদিত এক প্রাণ। নজরুল অবশ্যই তার কাব্যিক এ রচনাকে গ্রহণ করেছেন মহান সৃষ্টিকর্তার বাণী থেকে। পবিত্র কুরআন বারবার বলেছে, ‘এ পৃথিবীতে তোমার জীবন লাভের কারণে তুমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ হও এবং আল্লাহর কাছে নিজেকে উৎসর্গ করো।’ এ উৎসর্গের মাধ্যমেই মানুষ সফলকাম হয়। কিন্তু মানুষের উৎসর্গ করার কী আছে? প্রত্যেক মানুষেরই তো একটি মাত্র প্রাণ যার দানকর্তাও আল্লাহ। তাই যে জীবন বা প্রাণ মানুষ পেয়েছে তার জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। এবং এ কৃতজ্ঞতার প্রতীকী হিসেবে বিশ্বাসী মুসলমানেরা পেয়েছে ইব্রাহিম আ:-এর ‘কোরবানি’ প্রদান। পবিত্র কুরআনে ‘কোরবানি’ প্রসঙ্গে অন্য এক ভাষ্যে বলা হয়েছে, কোরবানির পশুর গোশত বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না। এর মধ্যে যে উদ্দেশ্য কিংবা ত্যাগ রয়েছে সেটিই শুধু আল্লাহর দরবারে পৌঁছায়। কবি নজরুল অতি সুন্দরভাবে এ ত্যাগের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন-
‘আজ শোর ওঠে জোর
খুন দে জান শির, বৎস শোন।
ওরে হত্যা নয় সত্যাগ্রহ
শক্তির উদ্বোধন।
দুধারি ধার শেরে খোদায়
রক্তে-পুত-বদন
খুনে আজ রুদবো মন
ওরে শক্তি হস্তে মুক্তি
শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন।’
হজরত ইব্রাহিম আ: আল্লাহর কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছিলেন ‘কোরবানি’ করো তোমার প্রিয়তম বস্তুকে। যার সূত্র ধরে আজকের এ ত্যাগের উৎসব। কিন্তু এখনকার ত্যাগ! অনেকটাই লোকদেখানো মায়াকান্না! অনেক ক্ষেত্রে অর্থবল, বাহুবল গ্রাস করে নিয়েছে মানুষের খাঁটি মনকে। ফলে ত্যাগ-তিতিক্ষা সাধারণের কাছে এক মহাকঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানব সভ্যতার এ অগ্রগতির (!) দিনে প্রকৃতই ঈদুল আজহার শাশ্বত বাণী অতি প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিকতার এ আলোচনাক্রমে কাজী নজরুলের কাব্যিক রচনায় আরো একবার দৃষ্টি দেয়া যাক। নজরুল তার তথাকথিত মায়াকান্নাধারীদের উদ্দেশে বলেছেন-
‘ওরে ফাঁকিবাজ ফেরেববাজ
আপনারে আজ দিসনে লাজ
গরু ঘুষ দিয়ে চাস সওয়ার?
যদিইরে তুই গরুর সাথে
পার হয়ে যাস পুলসিরাত
কি মহাম্মদে জওয়াব?
নজরুল তার আরেক রচনায় মানুষের স্বভাবসুলভ আচরণকে শ্লেষ দিয়ে লিখেছেনÑ
নামাজ রোজার শুধু ভড়ং
ইয়া উয়া পরে সেজেসে সং
ত্যাগ নেই তোর এক জড়
ত্যাগের নামেতে জড়সড়
তোর নামাজের কি আছে দাম?
প্রকৃতই যাদের ত্যাগ নেই, মুখোশের আড়ালে থাকায় স্বভাবটা আয়ত্ত করে নিয়েছেন তাদের কাছে আধ্যাত্মিক ও সামাজিক বার্তা দুই-ই নিরর্থক। তাই প্রার্থনা করি অন্তত ঈদুল আজহার দিনে এর যথার্থ উন্মেষ হোক। অবশ্যই এখনো উন্মেষ ঘটছে বলে মানুষ মানুষের জন্য কাঁদতে পারে, রক্ত দেখলে আঁতকে ওঠে, দুর্যোগ মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, অনাহারি বুভুক্ষুদের অন্নবস্ত্রের সংস্থান করে, কোলে তোলে নেয় এবং সর্বোপরি অনাথ, নিরাশ্রয়ীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে। সেই বোধগম্য এবারেও জাগ্রত হোকÑ এ আমাদের প্রার্থনা।