হাওর বার্তা ডেস্কঃ ঈদ মানেই আনন্দ। সেই আনন্দের রেশ বহুগুণ বেড়ে যায় পরিবারের সঙ্গে একান্তে কিছু সময় কাটাতে পারলে। যারা ঢাকাতেই ঈদ করেন তারা চান ঈদের ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে ঢাকার আশপাশে একটু ঘুরে আসতে, যেখানে থাকবে না কোনো নাগরিক ব্যস্ততা, থাকবে না ক্লান্তির স্পর্শ। প্রকৃতির কোলে একটু বিশ্রাম নেয়া যাবে নিশ্চিন্তে। ঈদে পরিবার নিয়ে বেড়িয়ে আসতে পারেন এমন কিছু জায়গার খোঁজ থাকছে এই লেখায়।
জল জঙ্গলের কাব্য
৯০ বিঘা জমির ওপরে ঢাকার পাশেই পূবাইলে গড়ে উঠেছে অপূর্ব একটি গ্রাম, নাম জল জঙ্গলের কাব্য। মূলত এটি একটি রিসোর্ট। ঈদের ছুটিতে পারিবার নিয়ে গেলে সেখানে গ্রামের আমেজ পাওয়া যাবে পুরোপুরি। উপরে ছনের ছাউনি, পাশে বাঁশ আর পাটখড়ির বেড়া, সামনে দিগন্ত বিস্তৃত জলের নাচন। রাতের নির্মল আকাশ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে পাবেন সেখানে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন প্রাকৃতিক এমন গ্রাম-বাংলার পরিবেশ অন্যত্র পাওয়া কষ্টকর। অনাবিল সবুজ আর বিলের শান্ত জলে বড়শি হাতে একটি দুপুর আপনার নিভৃতচারী মনের স্বপ্নসাধ পূরণের জন্য যথেষ্ট। এখানে নিজস্ব জমিতে চাষ করা শাক-সবজি, ধান এবং বিলের মাছ দিয়ে তৈরি খাবার পরিবেশন করা হয়।
একসঙ্গে কমপক্ষে ১০জনের গ্রুপে যেতে হয় এই রিসোর্টে। রিসোর্টে রাত্রিযাপন করলে সকালের নাস্তা, দুপুর ও রাতের খাবারসহ জনপ্রতি ৩,৫০০ টাকা নেয়া হয়। সারাদিন থাকলে সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার আর বিকেলে হালকা নাস্তা বাবদ জনপ্রতি ১৫০০ টাকা দিতে হয়। ৩ থেকে ১০ বছর বয়সের শিশু, কাজের লোক এবং ড্রাইভারের জন্য জনপ্রতি ৭৫০ টাকা। যেতে হলে অবশ্যই অগ্রিম বুকিং দিয়ে যেতে চেষ্টা করবেন। যোগাযোগ: ০১৯১৯৭৮২২৪৫
কীভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে পূবাইল। পূবাইল কলেজ গেট থেকে রিসোর্টের দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার। ঢাকার সায়েদাবাদ, আজিমপুর, গুলিস্তান কিংবা মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে টঙ্গী নেমে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে যাওয়া যাবে। অথবা গাজীপুর শহরের শিববাড়ী নেমে সেখান থেকে অটোরিকশায় যেতে পারবেন।
নুহাশ পল্লী
ঢাকার পাশেই গাজীপুরের পিরুজালী গ্রামের বেশিরভাগ পথই ঘন শালবনে আচ্ছাদিত। আলো আঁধারিতে ঢেকে থাকা এমনই একটি পথ আপনাকে নিয়ে যাবে গাজীপুর সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নুহাশ পল্লীতে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ প্রকৃতির কোলে তৈরি করেছেন দারুণ এই পল্লী। নুহাশ পল্লীর বর্তমান আয়তন প্রায় ৪০ বিঘা। নুহাশ পল্লীর উত্তর প্রান্তে একটি বড় পুকুর রয়েছে যেখানে একটি কাঠের সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। আছে স্মৃতিঘেরা পুকুর, যার নাম লীলাবতি। পুকুরের পাশেই ‘ভূতবিলাস’ নামে দারুণ একটি ভবন। রাতে আপনি চাইলে নিজেও ভূত দেখার চেষ্টা করতে পারেন। হুমায়ূন আহমেদ যখনই দেশে ও বিদেশে ভ্রমণ করতেন তিনি বিভিন্ন রকমের গাছ সংগ্রহ করতেন। নুহাশ পল্লীতে প্রায় ৩০০ প্রজাতির ফলদ এবং ঔষধি গাছ রয়েছে। প্রবেশ মূল্য ২০০ টাকা। নুহাশ পল্লী মূলত রিসোর্ট নয়, ঈদের ছুটিতে পিকনিক স্পট হিসেবে পরিবার নিয়ে বেড়ানোর দারুণ জায়গা।
কীভাবে যাবেন : ঢাকার গুলিস্তান থেকে প্রভাতী বনশ্রী বাসে উঠে সোজা চলে যাবেন গাজীপুর হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ড। এরপর সেখান থেকে অটোরিকশায় নুহাশ পল্লী যাওয়া যাবে।
ছুটি রিসোর্ট
ঢাকার পাশে দারুণ কিছু রিসোর্ট গড়ে উঠেছে মূলত গাজীপুরে। এরকম আরেকটি রিসোর্টের নাম ছুটি। গাজীপুরের সুকুন্দি গ্রামে প্রায় ৫০ বিঘা জায়গার ওপর যত্নে গড়ে তোলা হয়েছে এটি। গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানসংলগ্ন গ্রামীণ আবহে তৈরি এই অবকাশ কেন্দ্রে রয়েছে নৌ-ভ্রমণ এবং সংরক্ষিত বৃক্ষের বনে তাঁবু টানানোর ব্যবস্থা। এছাড়াও আছে ছনের তৈরি ঘর, কটেজ, মাছ ধরার ব্যবস্থা, বার্ড হাউস, ভেষজ গার্ডেন, ফল, সবজি ও ফুলের বাগান, আধুনিক রেস্টুরেন্ট, দুটি পিকনিক স্পট, গ্রামীণ পিঠার ব্যবস্থা, দুটি খেলার মাঠ এবং কিডস জোন। ঈদের ছুটিতে পারিবারের সঙ্গে ছুটি রিসোর্টের পাখির কলরব, শিয়ালের হাঁক, বাদুড়, জোনাকি আলো ও ঝিঁঝিঁ পোকার গুঞ্জন আপনাকে প্রতি মুহূর্তে গ্রামের রাতের কথাই মনে করিয়ে দেবে। ছুটি রিসোর্টে আগত অতিথিদের নানা ধরনের মৌসুমি ফল উপহার দেওয়া হয়।
এখানে রয়েছে মাছ ধরার সুবিধা। রিসোর্টের বিশাল ৩টি লেকে নির্দিষ্ট ফি প্রদান করে যেমন খুশি মাছ শিকার করা যায়। আগত অতিথিদের জন্য রয়েছে ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলার ব্যবস্থা। কেউ যদি রাতে থাকতে চান তাদের জন্য রয়েছে দারুণ ব্যবস্থা। রিসোর্টে গড়ে তোলা হয়েছে ২১টি এসি, নন-এসি কটেজ। গ্রামীণ এবং শহুরে স্থাপনার আদলের এই রিসোর্টে আরো রয়েছে সুইমিং পুল এবং দুটি কনফারেন্স রুম। রিসোর্টের রেস্টুরেন্টে বাংলা, ইন্ডিয়ান, চাইনিজ, থাই এবং কন্টিনেন্টাল খাবার পাওয়া যায়। সাধারণত ৩ হাজার থেকে শুরু হলেও ঈদ উপলক্ষে একদিনের জন্য কটেজ ভাড়া নিতে ৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা পর্যন্ত লেগে যাবে। বুকিং করতে চাইলে ০১৭৭৭১১৪৪৮৮, ০১৭৭৭১১৪৪৯৯ নাম্বারে যোগাযোগ করতে হবে।
কীভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে বাসে বা গাড়িতে গাজীপুরের চৌরাস্তায় এসে সেখান থেকে গাজীপুর ডিসি অফিসের সামনে (রাজবাড়ী) যেতে হবে। ডিসি অফিসের সামনে থেকে সিএনজিতে ৩ কিলোমিটার দূরত্বে আমতলী বাজারের কাছেই সুকুন্দি গ্রামে এই রিসোর্টের অবস্থান।
পদ্মা রিসোর্ট
পরিবার, বন্ধুবান্ধব নিয়ে এই ঈদে অল্প সময়ে এবং স্বল্প বাজেট নিয়ে ঘোরার জায়গার মধ্যে অন্যতম হলো পদ্মা রিসোর্ট। পদ্মা নদীর গা ঘেঁষে জেগে ওঠা চরের মধ্যেই অপূর্ব সুন্দর রিসোর্টটি তৈরি করা হয়েছে। চারদিক সবুজ দিয়ে ছেয়ে থাকা রিসোর্টের পাশেই বয়ে চলেছে পদ্মা নদী। রিসোর্টে ঢুকতেই চোখ জুড়িয়ে যাবে সবুজের সমারোহ দেখে। এর মধ্যে তৈরি করা হয়েছে মোট ১৬টি কটেজ। এই কটেজগুলোই মূল আকর্ষণের জায়গা। নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা কটেজগুলোতে বেশ আরামদায়ক এবং নিরিবিলি সময় কাটাতে পারবেন। কটেজগুলোর নামকরণও করা হয়েছে বেশ সুন্দরভাবে। ১২টি কটেজের নাম রাখা হয়েছে বাংলা বছরের ১২টি মাসের নামানুসারে। আর বাকি চারটির নাম নেওয়া হয়েছে চারটি ঋতু থেকে। বাঙালিয়ানার সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন করার চেষ্টা করা হয়েছে কটেজগুলোতে। পদ্মা রিসোর্টে ঢুকলে ওখানকার খাবার খেতে হবে। খাবারের মান বেশ ভালো। প্যাকেজ খাবার ১০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে পেয়ে যাবেন। আর রিসোর্ট যদি শুধু দিনের বেলা ভাড়া করতে চান, তাহলে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত থাকতে পারবেন। সেক্ষেত্রে ভাড়া লাগবে ২৩০০ টাকা। আর যদি দিনসহ রাতও কাটাতে চান, তাহলে ভাড়া লাগবে ৩৫০০ টাকা। ঈদ উপলক্ষে আগে থেকে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে গেলে ভালো। ০১৭৫২৯৮৭৬৮৮, ০১৬৮০৫৫০৫৯৮ নাম্বারে যোগাযোগ করে নিতে হবে।
কীভাবে যাবেন : ঢাকার গুলিস্তান থেকে গাংচিল কিংবা ইলিশ পরিবহনের বাসে লৌহজং যেতে হবে। মিরপুর ১০, ফার্মগেট অথবা শাহবাগ থেকে যেতে হলে স্বাধীন পরিবহনের বাসে লৌহজং পর্যন্ত যেতে হবে। আবার গুলিস্তান থেকে বিক্রমপুর পরিবহনের বাসে মাওয়া ফেরিঘাট এসে লৌহজং চৌরাস্তা মোড় দিয়ে অটোরিকশা নিয়ে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যাবে পদ্মা রিসোর্টে। গাড়ি নিয়ে গেলে টোল দিতে হবে ৬০ টাকা। গাড়ি পার্কিং করতে লৌহজং থানার সামনে যেতে হবে। লৌহজং থানার কাছে মসজিদের ঘাটে ইঞ্জিন চালিত নৌকা ও স্পিডবোট পাওয়া যায়।
নক্ষত্রবাড়ি
ঢাকার পাশেই গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ি এলাকায় ‘নক্ষত্রবাড়ি’ নামের দারুণ এই রিসোর্টটি তৈরি করা হয়েছে। ২৫ বিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা নক্ষত্রবাড়ির বৈশিষ্ট্য হলো, পুকুরের পানির ওপর কাঠ-বাঁশের সমন্বয়ে নির্মিত ১১টি কটেজ। দুটি বেডরুম, একটা বাচ্চাদের রুম, একটা ড্রয়িং, একটা ডাইনিং আর বারান্দা নিয়ে। সামনে বড়সড় একটা লন। যেতে যেতে চোখে পড়বে মাটির বেশ বড় গামলা, যার মধ্যে ফুটে আছে শাপলা। উঁচু জায়গাতেই ছোট্ট একটা সুইমিং পুল। এখানে আঁকা আছে সূর্যমুখী। নক্ষত্রবাড়ির সিগনেচার সিম্বল। আশপাশে বাঁশঝাড় আর গাছপালা। অতীত থেকে আপনাকে বর্তমানে নিয়ে আসবে কফি শপ আর বিশাল কনফারেন্স সেন্টার। চাইলে সুইমিং পুলের পাশে তাঁবুতেও রাত্রিযাপন করতে পারেন। আছে সুব্যবস্থা। আছে বিল্ডিং কটেজও। রিসোর্টে বসে শোনা যায় ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, ব্যাঙের ডাক, জোনাকির আলো ছড়ানো টিপ টিপ বাতি জ্বলা-নিভা। এর নির্মাণশৈলীও প্রশংসার দাবিদার। যথেষ্ট খোলামেলা। আলো আর বাতাসের অবিরল উপস্থিতি। ছাদ থেকে, দোতলা থেকে ঝুলছে কিছু লতানো গাছ। কংক্রিটকে আড়াল করে চোখে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়ার জন্য। রেস্টুরেন্ট সাজানো হয়েছে বেশ কায়দা করে- কাঠের বেঞ্চি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে আরাম করে বসার কাউচ। বারান্দায় বেতের সোফায় বসে আয়েশ করে একটা বিকেল কাটিয়ে দেয়া যায়। কনফারেন্স হলের তিনতলায় আরো একটি ব্যাঙ্কোয়েট হল। হলের সামনের দিক থেকে পুরো গ্রামটাই দেখা যায়।
পানির ওপর কটেজগুলো ২৪ ঘণ্টার ভাড়া ১০ হাজার ৭৫২ টাকা। ফ্যামিলি স্পেশাল কটেজের ভাড়া ২০ হাজার ২২২ টাকা আর প্রিমিয়াম কটেজের ভাড়া ২২ হাজার ৭৭০ টাকা। বিল্ডিং কটেজের ভাড়া কাপলবেড ৮ হাজার ২২২ টাকা এবং টু-ইন বেড ৬ হাজার ৯৫৮ টাকা। দর্শনার্থীদের জন্য প্রবেশ মূল্য ৫০০ টাকা। বুকিং করতে চাইলে ০১৭৭২২২৪২৮১, ০১৭৭২২২৪২৮২ নাম্বারে ফোন করতে হবে।
কীভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা হয়ে ঢাকা-কাপাসিয়া মহাসড়কের রাজাবাড়ী বাজারে নামতে হবে। বাজার থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে চিনাশুখানিয়া গ্রামের বাঙালপাড়া এলাকায় নক্ষত্রবাড়ির অবস্থান। ঢাকা থেকে গাজীপুরে দিনের ২৪ ঘণ্টাই বিভিন্ন বাস চলাচল করে।