হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত তোফায়েল আহমেদ জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পাওয়ার পর তা নিয়ে সামাজিক নেটওয়ার্কসহ বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, রাষ্ট্রপতি তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতা বা এখতিয়ারবলে ক্ষমা করেছেন।আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা এই দুই মেয়াদে ২০ জনের বেশি মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় ছাড়া পেয়েছেন।
রাষ্ট্রপতির এই এখতিয়ার কিভাবে প্রয়োগ করা হয়, আর প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা কতটা থাকে? এসব প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।
হত্যা মামলায় তোফায়েল আহমেদ জোসেফের বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ড হয়েছিল ২০০৪ সালে। ২০১৫ সালে গিয়ে উচ্চতর আদালত তাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়। সেই সাজা ক্ষমা করার জন্য তার মা রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছিলেন।
শেষপর্যন্ত সাজাপ্রাপ্ত এই আসামী রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পেয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সূত্রগুলো বলছে, মুক্তি পাওয়ার পর তোফায়েল আহমেদ জোসেফ ঢাকাতেই রয়েছেন। এখন তিনি বিদেশ চলে যাবেন। তবে কোন দেশে যাচ্ছেন, তা জানা যায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলছেন, নিয়মনীতি মেনেই তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
“এ মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। ক্ষমা প্রার্থনা করলে তাকে তার যে শাস্তি ভোগের মেয়াদ প্রায় ২০ বছরের অধিক হয়ে গেছে। এবং তার যাবজ্জীবন ছিল,” তিনি বলেছেন, “অর্থদন্ড ঠিক রেখে মহামান্য রাষ্ট্রপতি এক বছর কয়েকমাস দুই বছরের কাছাকাছি সময় তাকে মওকুফ করেছেন। এবং তার চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার পারমিশন দিয়েছেন।”
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার ক্ষমতা প্রয়োগের সর্বশেষ এই ঘটনা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। এর আগে ২০১৬ সালে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত একজন আসামীকে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করেছিলেন।
এছাড়া ২০১১ সালে জাতীয় সংসদে একজন সঙসদ সদস্যের প্রশ্নে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দিন খান আলমগীর একটি পরিসংখ্যান দিয়েছিলেন।
সেই অনুযায়ী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ২১জনের মৃত্যুদন্ড মওকুফ করা হয়েছে। এগুলোর ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনার প্রশ্ন উঠেছিল।
সিনিয়র আইনজীবী শাহদ্বীন মালিক বলছিলেন, রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা প্রয়োগের কারণ যেহেতু ব্যাখ্যা করা হয় না, সেখানে এই অস্বচ্ছতার কারণেই জনমনে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।
রাষ্ট্রপতি এই ক্ষমতা কিভাবে প্রয়োগ করা যায়, সেই প্রশ্নে শাহদ্বীন মালিক বলেছেন, “এই ক্ষমতা ব্যবহার বা প্রয়োগ করা দু’টো কারণে। একটি হলো, কারও বিচারে শাস্তি হয়েছে। এর পনেরো বিশ বছর পর হঠাৎ বোঝা গেলো যে, তার বিচারে ভুল হয়েছে। তখন আবার বিচারে তাকে নির্দোষ প্রমাণে না গিয়ে রাষ্ট্রপতি তাকে ক্ষমা করতে পারেন।”
“আরেকটা একবারে মানবিক কারণে হতে পারে। কারও সাজার বড় অংশ খাটার পর ক্যান্সার বা দূরারোগ্য কোনো ব্যধি হয়েছে। ডাক্তার বলেছে সে আর বাঁচবে না। তখন রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করতে পারেন।”
“আমাদের দুর্ভাগ্যবশত, এ ধরণের কোন কারণ বলা হয় না। তখন ঐ সন্দেহটা জাগে যে রাজনীতি বা অন্যান্য বিবেচনা থেকে হতে পারে, সেজন্য জনমনেও প্রশ্ন জাগে।”
কয়েক বছর আগে এই ইস্যু নিয়ে হাইকোর্ট থেকে একটি রায় এসেছিল।
তাতে বলা হয়, সাজা মওকুফের ক্ষেত্রে কারণ ব্যাখ্যা করা উচিত।
এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশও ছিল সেই রায়ে। সেই নীতিমালা এখনও হয়নি বলে জানা গেছে।
তবে আইন মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংবিধানেই রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে পরিস্কার বলা আছে এবং সব নিয়ম মেনেই কারও সাজা মওকুফের সিদ্ধান্ত আসে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলছিলেন, সাজা মওকুফের সিদ্ধান্ত নিয়ে নানান প্রশ্ন যে উঠে, সেটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
“এই ক্ষমতাগুলো প্রয়ো করার ক্ষেত্রেও কিন্তু এক ধরণের সুবিবেচনাপ্রসূত হতে হয়।সেটা যদি না হয়, তাহলে কিন্তু নৈতিকতার দিক থেকে সেগুলো দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হয়।সেটি আইনে শাসনের জন্য কোন সুখ-বার্তা বহন করে না।”
তিনি আরও বলেন, “সাধারণ জনগণের মধ্যেও নানান প্রশ্ন তৈরি করে যে, কেন ক্ষমা করা হলো? কার প্রভাবে ক্ষমা করা হলো?কোন স্বার্থে ক্ষমা করা হলো, ইত্যাদি ইত্যাদি।এই যে বাড়তি প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হতে হয়।এটি কিন্তু আইনের শাসনের জন্যে এবঙ বিচার বিভাগের জন্যে খুব একটা সুখকর ব্যাপার নয়।”
তবে আইন মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, স্বচ্ছ্বতার সাথে এবং সংবিধান অনুযায়ী সাজা মওকুফের সিদ্ধান্তগুলো হয়ে থাকে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা