ঢাকা ০২:৩৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শুধু পাস নয়, নৈতিকতার বোধ জাগ্রত হোক

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:১৭:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ মে ২০১৮
  • ৪১১ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ যে-কোনো শাসনব্যবস্থায় জনগণের প্রতিবাদী চিন্তাভাবনা, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো শিক্ষাব্যবস্থা। এ কারণে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য শাসক শ্রেণি সব সময়ই তাকে নিজেদের প্রয়োজন মতো তৈরি ও ব্যবহার করে থাকে। এটা করতে গিয়ে তারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় চিন্তাভাবনার ওপর প্রভাব বিস্তার এবং ইতিহাস নিজেদের মতো করে সাজিয়ে-গুছিয়ে ছাত্রদের কাছে উত্থাপিত করার ওপর। বাংলাদেশ এদিক দিয়ে কোনো ব্যতিক্রম নয়। এখানকার শাসক শ্রেণি প্রথম থেকেই এ দুই বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য যা কিছু প্রয়োজনীয় মনে করেছে তা-ই করেছে এবং এখন পর্যন্ত করে চলেছে।’ এই কথামালা আমার নয়, বলেছেন বর্ষীয়ান চিন্তাবিদ বদরুদ্দীন উমর।

আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় এসএসসি এবং এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এর যে-কোনো একটি দুর্বল হলেই শিক্ষাব্যবস্থা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। শিক্ষাব্যবস্থাকে ঘিরে, পরীক্ষা পদ্ধতিকে ঘিরে সংঘটিত অনিয়ম জিইয়ে রাখলে শিক্ষাব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। এছাড়াও অনিয়মের মধ্য দিয়ে উতরে যাওয়া পরীক্ষাকে মানুষ সম্মানের চোখে দেখে না। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অবতীর্ণদের বরাতেও এমন তকমাই লেগে গেল। এমন তকমা যারা শিক্ষার্থীদের বরাতে লাগিয়ে দিল তারা মূলত জবাবদিহির পরিবর্তে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের প্রতি করুণা বর্ষণ করলেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ৪-৫ হাজার পরীক্ষার্থী পেয়ে থাকতে পারে। তাই আবার পরীক্ষা নিয়ে ২০ লাখ ছেলেমেয়ে এবং তাদের অভিভাবকদের বিড়ম্বনায় ফেলতে চাই না- এমন স্বগতোক্তিই এখন মানসম্মত শিক্ষার মানদ-। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা বিজ্ঞানী মনীষী জন ফ্রেডারিক হারবার্ট শিক্ষা সম্পর্কে যে উক্তি করেছেন, তা সর্বকালে সর্বজনগ্রাহ্য। ‘শিক্ষা জীবিকা অর্জনে সাহায্য করে এবং জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি আনে।’ এটা স্পষ্ট যে, জন হারবার্টের শিক্ষাদর্শন মানসম্মত জীবন-ঘনিষ্ঠ শিক্ষার কথাই বলে, প্রকৃত শিক্ষার কথাই বলে। প্রকৃত শিক্ষায় লোকদেখানো শিক্ষার কোনো স্থান নেই। আমাদের দুঃখ হলো, আজ পর্যন্ত আমরা শিক্ষার সর্বজনগ্রাহ্য মানদ-ই স্থির করত পারলাম না। ফলে বছর বছর ছকে বাঁধা পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে লাখ লাখ শিক্ষার্থী চমকপ্রদ ফলাফল করছে; কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা অর্জিত হচ্ছে না।

আমাদের জানা দরকার, প্রকৃত শিক্ষা কেন অর্জিত হচ্ছে না। ফাঁকিটা কোথায়? উল্লেখযোগ্য উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ে বেকার কেন? দেশের উচ্চশিক্ষিত লোক কাজের খোঁজে বিদেশে পাড়ি জমায়, দুর্দশা ভোগ করে; কিন্তু দেশে বিভিন্ন পেশায় উচ্চপর্যায়ে বিদেশিদের চাহিদা বাড়ছে কেন? এর কারণ হচ্ছে, আমরা ছেলেমেয়েদের উচ্চতর ডিগ্রি দিতে পারদর্শী; কিন্তু দক্ষমান সম্পদে পরিণত করায় মনোযোগী নই। প্রশ্ন ফাঁস প্রমাণিত জেনেও চমকপ্রদ সার্টিফিকেট দিয়ে তরতর করে শিক্ষা বৈতরণী পার করিয়ে দিচ্ছি পাবলিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে। অথচ নৈতিকতা বোধের তোয়াক্কা করছি না। এ বিষয়টি সংক্রমিত হচ্ছে ধীরে ধীরে শিক্ষার সবক’টি স্তরে।

আমরা সর্বজনীন শিক্ষার কথা বলি বাস্তবে না হলেও কাগজে-কলমে, সেই ধারণাও একদিনে প্রতিষ্ঠা পায়নি। আমাদের শিক্ষার ইতিহাস বলে, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের উত্তাল দিনে উদ্দীপ্ত করার স্লোগান ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এক ও অভিন্ন শিক্ষার দাবি সংবলিত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কেরানি তৈরির শিক্ষাও পাকিস্তানি শোষণের অবসানকে উদ্দিষ্ট করে।

ঐতিহাসিক ১১ দফায়ও যুক্ত হয়েছিল যুগোপযোগী মানবসম্পদ সৃষ্টির শিক্ষার কথা এবং সবার জন্য অভিন্ন শিক্ষার দাবি। স্বাধীনতার পাঁচ দশকেও আমাদের সেসব দাবি কার্যকর হয়নি, বরং আরও কিছু দুষ্টু উপসর্গ ঢুকে পড়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। অভিন্ন শিক্ষাটা ঘুরে গিয়ে সবার জন্য শিক্ষায় রূপান্তরিত হয়েছে। সেই সঙ্গে হয়েছে এর আন্তর্জাতিকীকরণ, বিশেষ করে ৯০-এর দশক থেকে।

১৯৯০ সালে থাইল্যান্ডের জমতিয়েনে অনুষ্ঠিত ‘সবার জন্য শিক্ষা’ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে। সেই সম্মেলনের পর থেকে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ স্লোগানটি পৃথিবীব্যাপী ব্যাপক আলোচনায় চলে আসে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করার নতুন ক্ষেত্র খুঁজে পায়। দেশে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বিশেষ করে বয়স্ক সাক্ষরতা নতুন মাত্রা লাভ করে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণে তেমন কোনো গুণগত মান পরিবর্তনে সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচি ভূমিকা রাখতে পারেনি।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুন নতুন পাবলিক পরীক্ষা সম্পৃক্ত করায় বেড়েছে ঘুষ, দুর্নীতি, প্রশ্ন ফাঁস, জিপিএ ফাইভ পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, কোচিং ব্যবসা এবং প্রক্সি পরীক্ষার মতো অনৈতিক ঘটনার খবর, যা গণমাধ্যমে উঠে এসে শিক্ষাব্যবস্থার বাইরের চাকচিক্য ভাব ও ভেতরের কালিমাকে জনসমক্ষে উন্মোচিত করেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে ঘটতে থাকা বৈষম্য ও বিভক্তিকে উন্মুক্ত করেছে।

সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা দৃশ্যমান বিভক্তির কারণে সম্পূর্ণ অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক হওয়ার পরও সবাইকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। উচ্চবিত্তের এবং অভিজাত শ্রেণির আলাদা একটা শিক্ষা ধারা এরই মধ্যে প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেই ধারার নাম ইংলিশ মিডিয়াম। উচ্চবিত্ত শ্রেণি শিক্ষার শুরু থেকেই আলাদা হয়ে যাওয়ার বিনামূল্যের বই ও বিনামূল্যের শিক্ষার সঙ্গে উচ্চমূল্যের শিক্ষার একটা তফাত শিক্ষার গোড়াতেই ভয়ংকর রূপে দৃশ্যমান এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শেষাবধি বিদ্যমান। তাই বিরাজমান পরিস্থিতিতে জাতীয়ভাবে ঘোষিত সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা সত্যিই সর্বজনীন- একথা বলার তেমন সুযোগ নেই।

শিক্ষা মানে মানসম্মত শিক্ষা। বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম বা অন্য যে-কোনো মাধ্যমই হোক। আবার আমরা সবার জন্য শিক্ষার কথা বলছি। এটা আমাদের অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকারের সঙ্গে উন্নত সমাজ নির্মাণ এবং নৈতিক মানসম্পন্ন মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পর্কযুক্ত। কারণ মানসম্মত শিক্ষা সার্বিক উন্নয়নের অন্যতম সূচক।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম ধাপ প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষা মানসম্মত হলে শিশুদের শিক্ষার ভিত্তি মজবুত ও টেকসই হয়। ফলে শিক্ষার পরবর্তী স্তরগুলো মানসম্মত করা অনেকাংশে সহজ হয়, শিক্ষার্থীদের মানসিক দৃঢ়তা, মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়, যা শিশু বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা মানসম্মত নয়। কারণ ঘোষিত শিক্ষা পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না, পাঠদান যথাযথ এবং আকর্ষণীয় নয়; আবার পরীক্ষা পদ্ধতিও যথেষ্ট কার্যকর নয়।

ফলে প্রাথমিক স্তরের শুরুর পর্যায়ে থেকে প্রশ্ন ফাঁস করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যার প্রধান দৃষ্টান্ত গত বছরজুড়ে প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা দেশের সর্বত্র চলতে দেখা গেছে। প্রশ্ন ফাঁস ঝুঁকি এড়াতে হলে শুরুতেই প্রাথমিক শিক্ষাকে কীভাবে মানসম্মত করা সম্ভব সেই উপায়ই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। কারণ প্রাথমিক শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়ন তথা সার্বিক নৈতিকতা বোধ সৃষ্টির চাবিকাঠি। যেনতেনভাবে পাস করে পার পাওয়া নয়, মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণই জনগণের সাংবিধানিক অধিকার।

বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে বিভিন্ন প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সাফল্য অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না। বাংলাদেশে প্রতিটি শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই একমাত্র শৈশবকালীন শিক্ষার স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না।

জবাবদিহিতার ক্ষেত্রগুলো অগোচরে থেকে যাওয়ার ফলে অবকাঠামো উন্নয়ন, অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য, উপবৃত্তি, মেধাবৃত্তি এবং প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা, জুনিয়র, স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা ইত্যাদি কর্মসূচি হাতে নেওয়ার পরও শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের মৌলিক শিক্ষার বিশাল ব্যবস্থাপনায় গৃহীত কার্যক্রম ত্রুটিযুক্ত থেকে যাচ্ছে।

শ্রেণিভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জিত হচ্ছে না। সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন প্রতিবেদন (২০১৬) সে কথাই বলছে। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মাত্র ৪০ শতাংশ পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে। অর্থাৎ বাকি ৬০ শতাংশ যোগ্যতা শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষের বাইরে কীভাবে অর্জন করছে বা আদৌ অর্জন করছে কি না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। অথবা আমরা ধরে নিতে পারি, ওই ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী পরবর্তী শ্রেণিতে গিয়ে আরও পিছিয়ে পড়ছে। ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে পড়াশোনায় পিছিয়ে থেকেও অনেক প্রশ্ন ফাঁস বা অন্য কোনো অসদুপায়ে ফলাফল ভালো করতে চায়, এখানেই বিপত্তি।

গত ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে এসএসসির লিখিত পরীক্ষা শেষ হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি। ৬ মে এ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। এবার এই পরীক্ষার শুরু থেকেই একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। তখন কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীরকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি করা হয়।

এসএসসি পরীক্ষার ১৭টি বিষয়ের মধ্যে ১২টিতেই নৈর্ব্যক্তিক (বহুনির্বাচনি প্রশ্ন বা এমসিকিউ) অংশের ‘খ’ সেট প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির প্রতিবেদনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে পরীক্ষা বাতিল না করার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এবার অনুষ্ঠিত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা এত অভিযোগ-অনিয়ম মাথায় নিয়েও পাসের হার ৯ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

গত বছরের তুলনায় পাসের হার কমেছে আড়াই শতাংশের বেশি। তবে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে পৌনে ৬ হাজার। ইংরেজি, গণিত ও রসায়নে পাসের হার হ্রাস, উত্তরপত্র মূল্যায়নে কড়াকড়ি, প্রশ্ন ফাঁসের নেতিবাচক প্রভাব, নকলের সুযোগ কমে যাওয়া এবং গ্রামাঞ্চল, বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের ফল খারাপ হওয়া- এ পাঁচ কারণে মূলত সার্বিক পাসের হারের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ফল বিশ্লেষণ বলছে, ১০টি শিক্ষা বোর্ডের ৯টিতেই এবার পাসের হার গত বছরের তুলনায় কমেছে। তবে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে গত বছরের চেয়ে এবার পাসের হার ২১ শতাংশ বেশি হওয়ায় পাসের হারের নিম্নগতি কিছুটা রোধ হয়েছে। এবার মাদ্রাসা ও কারিগরিসহ ১০টি শিক্ষা বোর্ডে ২০ লাখ ২৬ হাজার ৫৭৪ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়।

তাদের মধ্যে পাস করেছে ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ১০৪ জন। পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। গত বছর এ হার ছিল ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। পাসের হার কমেছে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। তবে শুধু সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষার পাসের হার ৭৯ দশমিক ৪০ শতাংশ।

গত বছর এ হার ছিল ৮১ দশমিক ২১ শতাংশ। এবার শুধু এসএসসিতে অংশ নেয় ১৬ লাখ ২৪ হাজার ৪২৩ জন। পাস করেছে ১২ লাখ ৮৯ হাজার ৮০৫ জন। এবার ১০ বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৬২৯ জন। গত বছর পেয়েছিল ১ লাখ ৪ হাজার ৭৬১ জন। গতবারের চেয়ে এ সংখ্যা বেড়েছে ৫ হাজার ৮৬৮টি।

২০১০ সালে পাসের হার এক লাফে বেড়ে যায় ১১ শতাংশ। ওই বছর পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ১৯ ভাগ। ২০০৯ সালে মোট পাস করেছিল ৬৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। ২০১৪ সাল পর্যন্ত পাসের হার বেড়েছে। ২০১৪ সালে আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে এসএসসিতে মোট পাস করেছিল ৯২ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

সেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে এসএসসিতে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পাসের রেকর্ড ছিল। ২০১৫ সালের তুলনায় প্রায় ৩ শতাংশ বেশি পাস করেছিল ওই বছর। ২০১৬ সালের এসএসসিতে পাসের হার ছিল ৮৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। সচরাচর ভালো ফলের সূচক হিসেবে চারটি দিক গণনা করা হয়। যেমন- পাসের হার, মোট জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা। শতভাগ ও শূন্য পাস করানো প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। এবার সবক’টি সূচকই নিম্নমুখী।

এবার শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে, এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ হাজার ৫৭৪টি। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ২ হাজার ২৬৬টি। অর্থাৎ গতবারের চেয়ে কমেছে ৬৯২টি আর সবাই ফেল করেছে, এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১০৯টি। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৯৩টি। আমাদের ধারণা, সার্বিক ব্যবস্থাপনার মান কমে যাওয়ায় শিক্ষা ক্ষেত্রে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

সার্বিক বাস্তবতায় আমাদের মানতে হবে, পাসের হার ও জিপিএ-৫ বৃদ্ধির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, শিক্ষার মান বৃদ্ধি, শিক্ষাব্যবস্থাপনার গুণগত মান উন্নয়ন। শিক্ষার মান এবং শিক্ষাব্যবস্থাপনার মান উন্নত হলে প্রশ্ন ফাঁস রোধ আপনা থেকেই হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাব্যবস্থাপকদের নৈতিক মান এবং নৈতিক গুণও একটা বিবেচ্য বিষয়।

শিক্ষার্থীদের জীবনে মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষার ফলাফল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ স্তর অতিক্রম করে তবেই শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার বৃহত্তর জগতে প্রবেশের পথ সুগম করে। মূলত শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় হলো জীবনের ভিত মজবুত করার উপযুক্ত সময়। যারা সময়ের উত্তম ব্যবহার করে, নিয়মিত পাঠচর্চা করে তারাই ফল ভালো করে। যারা অন্য উপায়ে শিক্ষাজীবনে কালিমা লোপন করে, তাদের জন্য দুঃখ হয়। তাই বলি শুধু পাস নয়, নৈতিকতাই গুরুত্বপূর্ণ।

-শাওয়াল খান

লেখক ও শিক্ষাকর্মী

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

শুধু পাস নয়, নৈতিকতার বোধ জাগ্রত হোক

আপডেট টাইম : ১২:১৭:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ মে ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ যে-কোনো শাসনব্যবস্থায় জনগণের প্রতিবাদী চিন্তাভাবনা, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো শিক্ষাব্যবস্থা। এ কারণে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য শাসক শ্রেণি সব সময়ই তাকে নিজেদের প্রয়োজন মতো তৈরি ও ব্যবহার করে থাকে। এটা করতে গিয়ে তারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় চিন্তাভাবনার ওপর প্রভাব বিস্তার এবং ইতিহাস নিজেদের মতো করে সাজিয়ে-গুছিয়ে ছাত্রদের কাছে উত্থাপিত করার ওপর। বাংলাদেশ এদিক দিয়ে কোনো ব্যতিক্রম নয়। এখানকার শাসক শ্রেণি প্রথম থেকেই এ দুই বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য যা কিছু প্রয়োজনীয় মনে করেছে তা-ই করেছে এবং এখন পর্যন্ত করে চলেছে।’ এই কথামালা আমার নয়, বলেছেন বর্ষীয়ান চিন্তাবিদ বদরুদ্দীন উমর।

আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় এসএসসি এবং এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এর যে-কোনো একটি দুর্বল হলেই শিক্ষাব্যবস্থা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। শিক্ষাব্যবস্থাকে ঘিরে, পরীক্ষা পদ্ধতিকে ঘিরে সংঘটিত অনিয়ম জিইয়ে রাখলে শিক্ষাব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। এছাড়াও অনিয়মের মধ্য দিয়ে উতরে যাওয়া পরীক্ষাকে মানুষ সম্মানের চোখে দেখে না। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অবতীর্ণদের বরাতেও এমন তকমাই লেগে গেল। এমন তকমা যারা শিক্ষার্থীদের বরাতে লাগিয়ে দিল তারা মূলত জবাবদিহির পরিবর্তে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের প্রতি করুণা বর্ষণ করলেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ৪-৫ হাজার পরীক্ষার্থী পেয়ে থাকতে পারে। তাই আবার পরীক্ষা নিয়ে ২০ লাখ ছেলেমেয়ে এবং তাদের অভিভাবকদের বিড়ম্বনায় ফেলতে চাই না- এমন স্বগতোক্তিই এখন মানসম্মত শিক্ষার মানদ-। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা বিজ্ঞানী মনীষী জন ফ্রেডারিক হারবার্ট শিক্ষা সম্পর্কে যে উক্তি করেছেন, তা সর্বকালে সর্বজনগ্রাহ্য। ‘শিক্ষা জীবিকা অর্জনে সাহায্য করে এবং জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি আনে।’ এটা স্পষ্ট যে, জন হারবার্টের শিক্ষাদর্শন মানসম্মত জীবন-ঘনিষ্ঠ শিক্ষার কথাই বলে, প্রকৃত শিক্ষার কথাই বলে। প্রকৃত শিক্ষায় লোকদেখানো শিক্ষার কোনো স্থান নেই। আমাদের দুঃখ হলো, আজ পর্যন্ত আমরা শিক্ষার সর্বজনগ্রাহ্য মানদ-ই স্থির করত পারলাম না। ফলে বছর বছর ছকে বাঁধা পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে লাখ লাখ শিক্ষার্থী চমকপ্রদ ফলাফল করছে; কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা অর্জিত হচ্ছে না।

আমাদের জানা দরকার, প্রকৃত শিক্ষা কেন অর্জিত হচ্ছে না। ফাঁকিটা কোথায়? উল্লেখযোগ্য উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ে বেকার কেন? দেশের উচ্চশিক্ষিত লোক কাজের খোঁজে বিদেশে পাড়ি জমায়, দুর্দশা ভোগ করে; কিন্তু দেশে বিভিন্ন পেশায় উচ্চপর্যায়ে বিদেশিদের চাহিদা বাড়ছে কেন? এর কারণ হচ্ছে, আমরা ছেলেমেয়েদের উচ্চতর ডিগ্রি দিতে পারদর্শী; কিন্তু দক্ষমান সম্পদে পরিণত করায় মনোযোগী নই। প্রশ্ন ফাঁস প্রমাণিত জেনেও চমকপ্রদ সার্টিফিকেট দিয়ে তরতর করে শিক্ষা বৈতরণী পার করিয়ে দিচ্ছি পাবলিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে। অথচ নৈতিকতা বোধের তোয়াক্কা করছি না। এ বিষয়টি সংক্রমিত হচ্ছে ধীরে ধীরে শিক্ষার সবক’টি স্তরে।

আমরা সর্বজনীন শিক্ষার কথা বলি বাস্তবে না হলেও কাগজে-কলমে, সেই ধারণাও একদিনে প্রতিষ্ঠা পায়নি। আমাদের শিক্ষার ইতিহাস বলে, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের উত্তাল দিনে উদ্দীপ্ত করার স্লোগান ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এক ও অভিন্ন শিক্ষার দাবি সংবলিত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কেরানি তৈরির শিক্ষাও পাকিস্তানি শোষণের অবসানকে উদ্দিষ্ট করে।

ঐতিহাসিক ১১ দফায়ও যুক্ত হয়েছিল যুগোপযোগী মানবসম্পদ সৃষ্টির শিক্ষার কথা এবং সবার জন্য অভিন্ন শিক্ষার দাবি। স্বাধীনতার পাঁচ দশকেও আমাদের সেসব দাবি কার্যকর হয়নি, বরং আরও কিছু দুষ্টু উপসর্গ ঢুকে পড়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। অভিন্ন শিক্ষাটা ঘুরে গিয়ে সবার জন্য শিক্ষায় রূপান্তরিত হয়েছে। সেই সঙ্গে হয়েছে এর আন্তর্জাতিকীকরণ, বিশেষ করে ৯০-এর দশক থেকে।

১৯৯০ সালে থাইল্যান্ডের জমতিয়েনে অনুষ্ঠিত ‘সবার জন্য শিক্ষা’ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে। সেই সম্মেলনের পর থেকে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ স্লোগানটি পৃথিবীব্যাপী ব্যাপক আলোচনায় চলে আসে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করার নতুন ক্ষেত্র খুঁজে পায়। দেশে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বিশেষ করে বয়স্ক সাক্ষরতা নতুন মাত্রা লাভ করে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণে তেমন কোনো গুণগত মান পরিবর্তনে সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচি ভূমিকা রাখতে পারেনি।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুন নতুন পাবলিক পরীক্ষা সম্পৃক্ত করায় বেড়েছে ঘুষ, দুর্নীতি, প্রশ্ন ফাঁস, জিপিএ ফাইভ পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, কোচিং ব্যবসা এবং প্রক্সি পরীক্ষার মতো অনৈতিক ঘটনার খবর, যা গণমাধ্যমে উঠে এসে শিক্ষাব্যবস্থার বাইরের চাকচিক্য ভাব ও ভেতরের কালিমাকে জনসমক্ষে উন্মোচিত করেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে ঘটতে থাকা বৈষম্য ও বিভক্তিকে উন্মুক্ত করেছে।

সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা দৃশ্যমান বিভক্তির কারণে সম্পূর্ণ অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক হওয়ার পরও সবাইকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। উচ্চবিত্তের এবং অভিজাত শ্রেণির আলাদা একটা শিক্ষা ধারা এরই মধ্যে প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেই ধারার নাম ইংলিশ মিডিয়াম। উচ্চবিত্ত শ্রেণি শিক্ষার শুরু থেকেই আলাদা হয়ে যাওয়ার বিনামূল্যের বই ও বিনামূল্যের শিক্ষার সঙ্গে উচ্চমূল্যের শিক্ষার একটা তফাত শিক্ষার গোড়াতেই ভয়ংকর রূপে দৃশ্যমান এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শেষাবধি বিদ্যমান। তাই বিরাজমান পরিস্থিতিতে জাতীয়ভাবে ঘোষিত সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা সত্যিই সর্বজনীন- একথা বলার তেমন সুযোগ নেই।

শিক্ষা মানে মানসম্মত শিক্ষা। বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম বা অন্য যে-কোনো মাধ্যমই হোক। আবার আমরা সবার জন্য শিক্ষার কথা বলছি। এটা আমাদের অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকারের সঙ্গে উন্নত সমাজ নির্মাণ এবং নৈতিক মানসম্পন্ন মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পর্কযুক্ত। কারণ মানসম্মত শিক্ষা সার্বিক উন্নয়নের অন্যতম সূচক।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম ধাপ প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষা মানসম্মত হলে শিশুদের শিক্ষার ভিত্তি মজবুত ও টেকসই হয়। ফলে শিক্ষার পরবর্তী স্তরগুলো মানসম্মত করা অনেকাংশে সহজ হয়, শিক্ষার্থীদের মানসিক দৃঢ়তা, মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়, যা শিশু বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা মানসম্মত নয়। কারণ ঘোষিত শিক্ষা পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না, পাঠদান যথাযথ এবং আকর্ষণীয় নয়; আবার পরীক্ষা পদ্ধতিও যথেষ্ট কার্যকর নয়।

ফলে প্রাথমিক স্তরের শুরুর পর্যায়ে থেকে প্রশ্ন ফাঁস করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যার প্রধান দৃষ্টান্ত গত বছরজুড়ে প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা দেশের সর্বত্র চলতে দেখা গেছে। প্রশ্ন ফাঁস ঝুঁকি এড়াতে হলে শুরুতেই প্রাথমিক শিক্ষাকে কীভাবে মানসম্মত করা সম্ভব সেই উপায়ই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। কারণ প্রাথমিক শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়ন তথা সার্বিক নৈতিকতা বোধ সৃষ্টির চাবিকাঠি। যেনতেনভাবে পাস করে পার পাওয়া নয়, মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণই জনগণের সাংবিধানিক অধিকার।

বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে বিভিন্ন প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সাফল্য অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না। বাংলাদেশে প্রতিটি শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই একমাত্র শৈশবকালীন শিক্ষার স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না।

জবাবদিহিতার ক্ষেত্রগুলো অগোচরে থেকে যাওয়ার ফলে অবকাঠামো উন্নয়ন, অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য, উপবৃত্তি, মেধাবৃত্তি এবং প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা, জুনিয়র, স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা ইত্যাদি কর্মসূচি হাতে নেওয়ার পরও শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের মৌলিক শিক্ষার বিশাল ব্যবস্থাপনায় গৃহীত কার্যক্রম ত্রুটিযুক্ত থেকে যাচ্ছে।

শ্রেণিভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জিত হচ্ছে না। সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন প্রতিবেদন (২০১৬) সে কথাই বলছে। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মাত্র ৪০ শতাংশ পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে। অর্থাৎ বাকি ৬০ শতাংশ যোগ্যতা শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষের বাইরে কীভাবে অর্জন করছে বা আদৌ অর্জন করছে কি না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। অথবা আমরা ধরে নিতে পারি, ওই ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী পরবর্তী শ্রেণিতে গিয়ে আরও পিছিয়ে পড়ছে। ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে পড়াশোনায় পিছিয়ে থেকেও অনেক প্রশ্ন ফাঁস বা অন্য কোনো অসদুপায়ে ফলাফল ভালো করতে চায়, এখানেই বিপত্তি।

গত ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে এসএসসির লিখিত পরীক্ষা শেষ হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি। ৬ মে এ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। এবার এই পরীক্ষার শুরু থেকেই একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। তখন কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীরকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি করা হয়।

এসএসসি পরীক্ষার ১৭টি বিষয়ের মধ্যে ১২টিতেই নৈর্ব্যক্তিক (বহুনির্বাচনি প্রশ্ন বা এমসিকিউ) অংশের ‘খ’ সেট প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির প্রতিবেদনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে পরীক্ষা বাতিল না করার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এবার অনুষ্ঠিত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা এত অভিযোগ-অনিয়ম মাথায় নিয়েও পাসের হার ৯ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

গত বছরের তুলনায় পাসের হার কমেছে আড়াই শতাংশের বেশি। তবে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে পৌনে ৬ হাজার। ইংরেজি, গণিত ও রসায়নে পাসের হার হ্রাস, উত্তরপত্র মূল্যায়নে কড়াকড়ি, প্রশ্ন ফাঁসের নেতিবাচক প্রভাব, নকলের সুযোগ কমে যাওয়া এবং গ্রামাঞ্চল, বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের ফল খারাপ হওয়া- এ পাঁচ কারণে মূলত সার্বিক পাসের হারের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ফল বিশ্লেষণ বলছে, ১০টি শিক্ষা বোর্ডের ৯টিতেই এবার পাসের হার গত বছরের তুলনায় কমেছে। তবে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে গত বছরের চেয়ে এবার পাসের হার ২১ শতাংশ বেশি হওয়ায় পাসের হারের নিম্নগতি কিছুটা রোধ হয়েছে। এবার মাদ্রাসা ও কারিগরিসহ ১০টি শিক্ষা বোর্ডে ২০ লাখ ২৬ হাজার ৫৭৪ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়।

তাদের মধ্যে পাস করেছে ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ১০৪ জন। পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। গত বছর এ হার ছিল ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। পাসের হার কমেছে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। তবে শুধু সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষার পাসের হার ৭৯ দশমিক ৪০ শতাংশ।

গত বছর এ হার ছিল ৮১ দশমিক ২১ শতাংশ। এবার শুধু এসএসসিতে অংশ নেয় ১৬ লাখ ২৪ হাজার ৪২৩ জন। পাস করেছে ১২ লাখ ৮৯ হাজার ৮০৫ জন। এবার ১০ বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৬২৯ জন। গত বছর পেয়েছিল ১ লাখ ৪ হাজার ৭৬১ জন। গতবারের চেয়ে এ সংখ্যা বেড়েছে ৫ হাজার ৮৬৮টি।

২০১০ সালে পাসের হার এক লাফে বেড়ে যায় ১১ শতাংশ। ওই বছর পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ১৯ ভাগ। ২০০৯ সালে মোট পাস করেছিল ৬৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। ২০১৪ সাল পর্যন্ত পাসের হার বেড়েছে। ২০১৪ সালে আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে এসএসসিতে মোট পাস করেছিল ৯২ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

সেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে এসএসসিতে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পাসের রেকর্ড ছিল। ২০১৫ সালের তুলনায় প্রায় ৩ শতাংশ বেশি পাস করেছিল ওই বছর। ২০১৬ সালের এসএসসিতে পাসের হার ছিল ৮৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। সচরাচর ভালো ফলের সূচক হিসেবে চারটি দিক গণনা করা হয়। যেমন- পাসের হার, মোট জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা। শতভাগ ও শূন্য পাস করানো প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। এবার সবক’টি সূচকই নিম্নমুখী।

এবার শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে, এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ হাজার ৫৭৪টি। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ২ হাজার ২৬৬টি। অর্থাৎ গতবারের চেয়ে কমেছে ৬৯২টি আর সবাই ফেল করেছে, এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১০৯টি। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৯৩টি। আমাদের ধারণা, সার্বিক ব্যবস্থাপনার মান কমে যাওয়ায় শিক্ষা ক্ষেত্রে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

সার্বিক বাস্তবতায় আমাদের মানতে হবে, পাসের হার ও জিপিএ-৫ বৃদ্ধির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, শিক্ষার মান বৃদ্ধি, শিক্ষাব্যবস্থাপনার গুণগত মান উন্নয়ন। শিক্ষার মান এবং শিক্ষাব্যবস্থাপনার মান উন্নত হলে প্রশ্ন ফাঁস রোধ আপনা থেকেই হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাব্যবস্থাপকদের নৈতিক মান এবং নৈতিক গুণও একটা বিবেচ্য বিষয়।

শিক্ষার্থীদের জীবনে মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষার ফলাফল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ স্তর অতিক্রম করে তবেই শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার বৃহত্তর জগতে প্রবেশের পথ সুগম করে। মূলত শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় হলো জীবনের ভিত মজবুত করার উপযুক্ত সময়। যারা সময়ের উত্তম ব্যবহার করে, নিয়মিত পাঠচর্চা করে তারাই ফল ভালো করে। যারা অন্য উপায়ে শিক্ষাজীবনে কালিমা লোপন করে, তাদের জন্য দুঃখ হয়। তাই বলি শুধু পাস নয়, নৈতিকতাই গুরুত্বপূর্ণ।

-শাওয়াল খান

লেখক ও শিক্ষাকর্মী