হাওর বার্তা ডেস্কঃ এগিয়ে আসছে পবিত্র মাহে রমজান। কোরআন নাজিলের মাসে মসজিদে মসজিদে শুরু হবে খতমে তারাবি। খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছে হাফেজদের। মসজিদে মসজিদে মধুর কণ্ঠে তেলাওয়াত করবেন হাফেজ সাহেব।
রাজধানী এবং গোটা দেশেই শোনা যাবে কোরআনের মিষ্টিমধুর সুর। প্রতি রমজানে হাফেজদের কদর বেড়ে যায়। তিন হাফেজের তিনরকম তারাবির অভিজ্ঞতা জানাচ্ছি পাঠকদের আজকের লেখায়।
হাফেজ মাওলানা বায়েজিদ আহমদ কাসেমী (২৩)। ২০০৬ সালে কৈগ্রাম মাহতাবীয়া নূরানি ও হাফেজিয়া মাদ্রাসা থেকে হেফজ শেষ করেছেন ওস্তাদ হাফেজ শহিদুল ইসলামের কাছে। তার পর থেকেই একটানা তারাবি নামাজের ইমামতি করছেন। নওগাঁর নাজিরপুর থানা মসজিদে চার বছর তারাবি পড়িয়ে চলে এসেছেন মিরপুর শেওড়াপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। এখানে তারাবি পড়াচ্ছেন ছয় বছর ধরে। হাফেজ বায়েজিদ জন্ম নিয়েছেন নওগাঁ জেলার ধামইরহাট থানায়।
তিনি ২০১৭ সালে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দাওরা হাদিস সমাপ্ত করেছেন। রাজধানীতে তারাবি পেয়েছেন কীভাবে জানতে চাইলে হাফেজ বায়েজিদ বলেন, ৯০ জন হাফেজের সঙ্গে ইন্টারভিউ দিয়ে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন।
এ বছর তারাবির প্রস্তুতি কীভাবে নিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সারা বছরই তারাবির জন্য মনে মনে একটা প্রস্তুতি থাকে। বছরজুড়ে নিয়মিত এক পারা করে তেলাওয়াত করেন। বিশেষ করে রমজানের আগে আগে রজব ও শাবান মাস এলে ১০ বা ১৫ খতম করে ফেলেন একটানা। খতমে তারাবির গুরুত্ব ও কোরআনের মর্মার্থ মুসলিমদের কাছে তুলে ধরার ব্যাপারে এই হাফেজ বলেন, প্রতিটা মসজিদে তারাবির আগে ইমাম সাহেব অথবা হাফেজ সাহেব ওই দিনের তেলাওয়াতের শানেনজুলটুকু বর্ণনা করে দিলে মুসল্লিরা কোরআনের অর্থ জেনে উপকৃত হবেন। একজন মুসল্লি যদি প্রতিবছর কোরআনের অর্থগুলো শুনতে থাকেন একপর্যায়ে এসে তারা পুরো কোরআনের অর্থ জেনে যাবেন তারাবির মাধ্যমে।
হাফেজ মাওলানা মাহমুদ হুজাইফা (২৪)। ২০০৫ সালে পাকিস্তানের করাচি জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা থেকে তিনি হেফজ শেষ করেন। এই হাফেজের ওস্তাদ ছিলেন তার পিতা হাফেজ মাওলানা ইউনুস। চার বোন ও তিন ভাইসহ পরিবারের সবাই হাফেজ। গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার পরশুরাম থানায়। হেফজ শেষ করার পর থেকেই একটানা তারাবি পড়াচ্ছেন। বারিধারা জামে মসজিদ ও ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারে ৬ বছর ধরে তারাবি নামাজের ইমামতি করছেন তিনি।
তারাবির নামাজে কতটা মধুর তেলাওয়াত হওয়া উচিত এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাড়াহুড়া না করে ধীরস্থিরভাবে মধুর সুরে পড়তে হবে। আল্লাহতায়ালা তারতিলসহকারে কোরআন পড়তে বলেছেন। যাতে মুসল্লিরা তেলাওয়াতের সুমধুর সুরে মুগ্ধ হয়ে কোরআন বুঝার চেষ্টা করেন। রমজানে নফল নামাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, রমজানের শেষ দশকে আমরা কিয়ামুল লাইল শুরু করি। দীর্ঘ সময় নফল নামাজে কোরআন তেলাওয়াত করা হয়। এতে অনেক মুসল্লি অংশগ্রহণ করে থাকেন। এবারের রমজানকে ঘিরে তার ভাবনাগুলো কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশেষ করে হাফেজদের জন্য রমজান মাস বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কে কোথায় তারাবি পড়াবেন এ নিয়ে সবাই পেরেশান থাকেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও অনেকেরই তারাবি হয় না।
দু-একবার তারাবি না পড়ালে ইয়াদে দুর্বলতা এসে যায়। এ ক্ষেত্রে আমার মতামত খতমে তারাবির জন্য প্রতিটা মসজিদে তিন থেকে চারজন হাফেজ নেয়া হলে বাংলাদেশের অনেক হাফেজ উপকৃত হবেন। দেশের হাফেজরা বেশি সম্মানিত হবেন। কোরআনের মর্যাদা বাড়বে।
হাফেজ মাওলানা মুফতি ইউসুফ (২৫)। জন্ম বরিশাল বিভাগের মুলাদী থানায়। রাহাত হুসাইন তাহফীমুল কোরআন মাদ্রাসা থেকে ২০০৯ সালে হেফজ শেষ করেছেন। হাফেজ হওয়ার পর থেকেই কোনো বছর তিনি তারাবি পড়ানো বাদ দেননি। গত বছর তারাবি পড়িয়ে ছিলেন সাভার ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি মসজিদে। এ বছর কোথায় তারাবি পড়াবেন জানতে চাইলে মুচকি হেসে হাফেজ ইউসুফ বলেন, আল্লাহ জানেন, এখনও ঠিক হয়নি। খোঁজাখুঁজি করছি।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, খুব কষ্ট হয় আজকালকার ইন্টারভিউয়ে ভালো হাফেজদের তেমন কোনো মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। দীর্ঘ সময় লাগিয়ে ইন্টারভিউ চলে। কিন্তু কোনো হাফেজের জন্যই আপ্যায়নের ন্যূনতম ব্যবস্থা রাখা হয় না। কোথাও কোথাও ইন্টারভিউ দিতে এসে হাফেজদের নানারকম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। ইন্টারভিউয়ের নামে চলে স্বজনপ্রীতি। পূর্ব থেকে ঠিক করে রাখা হাফেজদের নিয়োগ দিয়ে যোগ্য হাফেজদের বঞ্চিত করা হয়। এ ঘটনা এখন বেশি বেশি হচ্ছে।
এ রমজানে যদি তারাবি পড়ানোর সুযোগ না হয় কেমন লাগবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোরআনকে মুখস্থ ধরে রাখার জন্য তারাবি পড়ানো অন্যতম একটি মাধ্যম। প্রতি রমজানে তারাবিকে কেন্দ্র করে তেলাওয়াতটা অনেক বেশি হয়। কোনো রমজানে তারাবি না হলে একটা ব্যথা থেকে যায় কলিজায়। হায়! আমার কোরআন না জানি কেমন আছে? আল্লাহতায়ালা একশ্রেণীর সৌভাগ্যবান হাফেজের মাধ্যমে কোরআনকে সংরক্ষণ করিয়ে থাকেন। যাদের সিনায় পবিত্র কোরআন রুহের ভেতর রুহ হয়ে বিরাজ করে। আল্লাহর কাছে তাদের মর্যাদা অনেক বেশি। যেহেতু তারা রুহ করে কোরআন জিন্দা রাখেন, তাই সমাজের ও রাষ্ট্রের উচিত হাফেজদের সেবা করা। হাফেজদের সেবা করলে কোরআনের সেবা হবে। তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে কোরআনের সঙ্গে ভালো ব্যবহার হবে।
শুধু রমজানে নয়- বছরজুড়ে, জীবনজুড়ে তাদের খোঁজখবর রাখা সমাজ-রাষ্ট্রের উচিত। হাফেজদের প্রতি মুসলমানের ভালোবাসা শুধু রমজানকেন্দ্রিক না হয়ে জীবনব্যাপী হোক। এই প্রত্যাশা করছি এ রমজান থেকে।