ঢাকা ১১:৩৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কয়লার ইস্ত্রিতে শুকুর আলীর ভাগ্য বদল

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৫৯:৫৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ এপ্রিল ২০১৮
  • ৩৩৫ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ যশোরের শার্শা উপজেলার বসতপুর এক নম্বর কলোনি এলাকার বাসিন্দা তিনি। গ্রামে বিদ্যুতের প্রশ্নই ওঠে না। ছোট ভাই সে সময়ে ১২শ’ টাকা দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে একটি কয়লার ইস্ত্রি এনে দেন। নির্দিষ্ট করে সালটা মনে নেই। দেশ স্বাধীনের ৯-১০ বছর পরের কথা। এরপর তিনি সেই ইস্ত্রি দিয়ে লন্ড্রির কাজ শুরু করেন। এখনো করে চলেছেন একই কাজ।

শুকুর আলীর বাবা আব্দুর রহিম মিজি ও মা নূরজাহান বেগম কেউই বেঁচে নেই। গ্রামের বাজারের মধ্যে ছোট একটি দোকান। তার মধ্যে দুটো টেবিল আর দেওয়াল ঘেঁষে জমিয়ে রাখা হয়েছে কয়লা। এই কয়লার আগুন ইস্ত্রির ভেতর ঢুকিয়ে কাপড় ইস্ত্রি করেন শুকুর আলী। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এ কাজ করে চলেছেন। এ আয় দিয়েই কিনেছেন দুই বিঘা ধানিজমি। ছোট ছেলে জামির হোসেনকে পড়াচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

শুকুর আলী (৬২) জানান, দেশ স্বাধীনের ৯-১০ বছর পর ছোট ভাই মনসুর আলী চট্টগ্রাম থেকে পিতলের তৈরি কয়লার ইস্ত্রি নিয়ে আসে। ১২শ’ টাকা দাম। সেই থেকে বসতপুর বাজারে কাপড় ইস্ত্রির কাজ শুরু, এখনো চলছে। বছর দুই আগে বসতপুর বাজারে ছোট একটি দোকান ভাড়া নেন তিনি। মাসে ৫০০ টাকা ঘর ভাড়া আর পাশের দোকান থেকে লাইন টেনে একটি বাল্ব জ্বালান। দোকানিকে মোটে ৩০ টাকা দেন। এর আগে তিনি বাজারের বিভিন্ন দোকানের সামনে লোকজনকে বলে একটু জায়গা নিয়ে এ কাজ করতেন।

তিনি জানান, ইস্ত্রির কাজ শুরুর বছর খানেক পর বেনাপোল পোর্ট থানার ঘিবা গ্রামের জবেদা বেগমের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সংসার জীবনে তার দুই মেয়ে এবং দুই ছেলে। দু’টো মেয়ে ও বড় ছেলের বিয়ে হয়েছে। ছোট ছেলে জামির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিবিএ অনার্স পাস করেন) পড়াশোনা করেন। এ মাসে তিনি মাস্টার্স পরীক্ষা দেবেন।

তিনি আরো জানান, প্রথম দিকে কাপড় প্রতি আটআনা পরে একটাকা করে নিতেন। এখন পাঁচ টাকা। আর শাড়ি প্রতি দশ টাকা। তখন প্রতিদিন ২০-৫০ টাকা আয় হতো। সংসার চলে যেত। বিয়ের পর বাড়িতে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালতেন স্ত্রী। সংসারের খরচ থেকে টুকটাক জমিয়ে প্রথমে কেনেন পাঁচ কাঠা জমি। এরপর আবার কিছু সঞ্চয়, তারপর আস্তে আস্তে এখন দুই বিঘা ধানিজমির মালিক তিনি। সেই জমিতে নিজেরাই উৎপাদন করেন ধান। এতে তাদের বছরের খোরাকিটা হয়ে যায়।

সবসময় প্রাণোচ্ছল মানুষটির জীবনে একটিই চাওয়া ছিল, অন্তত একটা ছেলেকে তিনি লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবেন। তার সেই আশা এখন পূরণের দিকে। ছোট ছেলে জামির লেখাপড়ায় বেশ ভালো। এরইমধ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিসিএস পরীক্ষার। তিনি চান- একটি ভালো চাকরি জুটিয়ে পরিবারের হাল ধরতে। তার মতে, বাবা হচ্ছেন সহজ-সরল মানুষ। খুবই সৎ আর কর্মঠ। কখনো তিনি কোনো বিষয়কে জটিল করে দেখতে চান না।

জানা যায়, এলাকায় কোনো বাড়িতে বিয়ে বা অন্য কোনো অনুষ্ঠান হলে তিনি সেখান থেকে বস্তায় ভরে কয়লা সংগ্রহ করেন। সংকট দেখা দিলে মাঝেমধ্যে বস্তাপ্রতি ১৬০ টাকা দরে কেনেন। ইস্ত্রি কেনার পর একবার হাত থেকে পড়ে কাঠের হাতলটি ভেঙে যায়। ওই একবারই সেটি মেরামত করতে হয়েছে। এছাড়া আর কোনো সমস্যা হয়নি।

প্রতিবেশী কলেজ শিক্ষক আবু আব্দুল্লাহ বলেন, ‘মানুষটা খুব নিরীহ। কারো সঙ্গে কোনোদিন উচ্চৈঃস্বরে কথা বলেননি। সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে বিশেষ করে তার সততার জন্য। এই বাজারে একমাত্র তারই ইস্ত্রির দোকান রয়েছে। বসতপুর ছাড়াও আশপাশের গ্রামের লোকজন তার কাছে কাপড় ইস্ত্রি করাতে আসেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

কয়লার ইস্ত্রিতে শুকুর আলীর ভাগ্য বদল

আপডেট টাইম : ১১:৫৯:৫৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ এপ্রিল ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ যশোরের শার্শা উপজেলার বসতপুর এক নম্বর কলোনি এলাকার বাসিন্দা তিনি। গ্রামে বিদ্যুতের প্রশ্নই ওঠে না। ছোট ভাই সে সময়ে ১২শ’ টাকা দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে একটি কয়লার ইস্ত্রি এনে দেন। নির্দিষ্ট করে সালটা মনে নেই। দেশ স্বাধীনের ৯-১০ বছর পরের কথা। এরপর তিনি সেই ইস্ত্রি দিয়ে লন্ড্রির কাজ শুরু করেন। এখনো করে চলেছেন একই কাজ।

শুকুর আলীর বাবা আব্দুর রহিম মিজি ও মা নূরজাহান বেগম কেউই বেঁচে নেই। গ্রামের বাজারের মধ্যে ছোট একটি দোকান। তার মধ্যে দুটো টেবিল আর দেওয়াল ঘেঁষে জমিয়ে রাখা হয়েছে কয়লা। এই কয়লার আগুন ইস্ত্রির ভেতর ঢুকিয়ে কাপড় ইস্ত্রি করেন শুকুর আলী। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এ কাজ করে চলেছেন। এ আয় দিয়েই কিনেছেন দুই বিঘা ধানিজমি। ছোট ছেলে জামির হোসেনকে পড়াচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

শুকুর আলী (৬২) জানান, দেশ স্বাধীনের ৯-১০ বছর পর ছোট ভাই মনসুর আলী চট্টগ্রাম থেকে পিতলের তৈরি কয়লার ইস্ত্রি নিয়ে আসে। ১২শ’ টাকা দাম। সেই থেকে বসতপুর বাজারে কাপড় ইস্ত্রির কাজ শুরু, এখনো চলছে। বছর দুই আগে বসতপুর বাজারে ছোট একটি দোকান ভাড়া নেন তিনি। মাসে ৫০০ টাকা ঘর ভাড়া আর পাশের দোকান থেকে লাইন টেনে একটি বাল্ব জ্বালান। দোকানিকে মোটে ৩০ টাকা দেন। এর আগে তিনি বাজারের বিভিন্ন দোকানের সামনে লোকজনকে বলে একটু জায়গা নিয়ে এ কাজ করতেন।

তিনি জানান, ইস্ত্রির কাজ শুরুর বছর খানেক পর বেনাপোল পোর্ট থানার ঘিবা গ্রামের জবেদা বেগমের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সংসার জীবনে তার দুই মেয়ে এবং দুই ছেলে। দু’টো মেয়ে ও বড় ছেলের বিয়ে হয়েছে। ছোট ছেলে জামির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিবিএ অনার্স পাস করেন) পড়াশোনা করেন। এ মাসে তিনি মাস্টার্স পরীক্ষা দেবেন।

তিনি আরো জানান, প্রথম দিকে কাপড় প্রতি আটআনা পরে একটাকা করে নিতেন। এখন পাঁচ টাকা। আর শাড়ি প্রতি দশ টাকা। তখন প্রতিদিন ২০-৫০ টাকা আয় হতো। সংসার চলে যেত। বিয়ের পর বাড়িতে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালতেন স্ত্রী। সংসারের খরচ থেকে টুকটাক জমিয়ে প্রথমে কেনেন পাঁচ কাঠা জমি। এরপর আবার কিছু সঞ্চয়, তারপর আস্তে আস্তে এখন দুই বিঘা ধানিজমির মালিক তিনি। সেই জমিতে নিজেরাই উৎপাদন করেন ধান। এতে তাদের বছরের খোরাকিটা হয়ে যায়।

সবসময় প্রাণোচ্ছল মানুষটির জীবনে একটিই চাওয়া ছিল, অন্তত একটা ছেলেকে তিনি লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবেন। তার সেই আশা এখন পূরণের দিকে। ছোট ছেলে জামির লেখাপড়ায় বেশ ভালো। এরইমধ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিসিএস পরীক্ষার। তিনি চান- একটি ভালো চাকরি জুটিয়ে পরিবারের হাল ধরতে। তার মতে, বাবা হচ্ছেন সহজ-সরল মানুষ। খুবই সৎ আর কর্মঠ। কখনো তিনি কোনো বিষয়কে জটিল করে দেখতে চান না।

জানা যায়, এলাকায় কোনো বাড়িতে বিয়ে বা অন্য কোনো অনুষ্ঠান হলে তিনি সেখান থেকে বস্তায় ভরে কয়লা সংগ্রহ করেন। সংকট দেখা দিলে মাঝেমধ্যে বস্তাপ্রতি ১৬০ টাকা দরে কেনেন। ইস্ত্রি কেনার পর একবার হাত থেকে পড়ে কাঠের হাতলটি ভেঙে যায়। ওই একবারই সেটি মেরামত করতে হয়েছে। এছাড়া আর কোনো সমস্যা হয়নি।

প্রতিবেশী কলেজ শিক্ষক আবু আব্দুল্লাহ বলেন, ‘মানুষটা খুব নিরীহ। কারো সঙ্গে কোনোদিন উচ্চৈঃস্বরে কথা বলেননি। সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে বিশেষ করে তার সততার জন্য। এই বাজারে একমাত্র তারই ইস্ত্রির দোকান রয়েছে। বসতপুর ছাড়াও আশপাশের গ্রামের লোকজন তার কাছে কাপড় ইস্ত্রি করাতে আসেন।