ঢাকা ০৫:৩৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শরৎ : রৌদ্র ছায়ার খেলা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৩৯:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫
  • ৮৬৬ বার

প্রকৃতিপ্রাণতা জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ধর্ম-কর্ম, শাস্ত্র-সংবেদ, শিক্ষা-দীক্ষা, জীবনযাপন- প্রায় সব কিছু জুড়েই প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য জড়িয়ে আছে। এ দেশের জাতিগত কৃষ্টি-সংস্কৃতিও অনেকাংশে এর ওপর নির্ভরশীল। ঋতুবৈচিত্র্যের বহুবর্ণিল আবহ সমাচ্ছন্ন হয়ে আছে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে মুগ্ধপ্রাণ প্রকৃতি কেবলই আবেশ ছড়িয়ে দেয়। এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। আনন্দযজ্ঞের এই লীলানিকেতন বাংলাদেশে একের পর এক ঋতুর আগমন ঘটে। এর মধ্যে শরতের আবির্ভাব সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বটে। বিভিন্ন কারণে শরৎ আমাদের জীবনে তাৎপর্য বয়ে আনে।
শরৎ আমাদের মধ্যে একটা মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে। ঘনঘোর বর্ষার অবরোধদশা, দুর্যোগপ্রবণ বিচ্ছিন্নতা ও বিরহবিধুর অবস্থা কাটিয়ে শরৎ যেন আশ্বাসের পাখায় ডানা মেলে। এ সময় প্রকৃতির বুকে এক অন্যরকম আবহ-অবিস্মৃতি লক্ষ করা যায়। স্বচ্ছ-সুনীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়। কেমন একটা হালকা চালে হালকা ভাব নিয়ে ওড়াউড়ি চলে। ভারবিহীন মুক্ত জীবনের ইশারায় প্রকৃতিপ্রাণ মুখর হয়ে ওঠে। নদীতীরে সারি সারি কাশফুলের মন মাতানো ঢেউ এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করে। মাঠে মাঠে পক্বপ্রায় ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে কৃষককুল আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়। প্রতীক্ষার প্রহর যেন শেষ হয়ে আসে। কৃষক-কৃষাণী মিলে গোলায় ধান তোলার প্রস্তুতি নেয়। এ সময় গ্রামবাংলায় হালকা শীতের বিকেল নেমে আসে। মাঠে-ঘাটে ছেলের দল ঘুড়ি ওড়াউড়ি-কাটাকাটি নিয়ে মেতে ওঠে। এপাড়া-ওপাড়া মিলে একটা উৎসবমুখর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। তা ছাড়া শিউলিঝরা শিশিরসিক্ত খোলা রোদ মাখানো সকালবেলার কথা বিস্মৃত হওয়ার মতো নয়। সে এক স্নিগ্ধ পরিবেশ। সেখানে শিশিরস্নাত ছেলেমেয়ের দল শিউলি ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথতে বসে যায়। এ সময় হালকা শীতের মনোরম আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। প্রকৃতির মধ্যে একটা মৃদু শিহরণ লক্ষ করা যায়। গাছের পাতায় সেই কম্পনের খবর পৌঁছে যেতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ বলেন,
‘এসেছে শরৎ, হিমের পরশ
লেগেছে হাওয়ার পরে
সকাল বেলায় ঘাসের ডগায়
শিশিরের রেখা ধরে
আমলকী বন কাঁপে যেন তার
বুক করে দুরু দুরু
পেয়েছে খবর পাতা-খসানোর
সময় হয়েছে শুরু
শিউলির ডালে কুঁড়ি ভরে এলো
টগর ফুটিল মেলা
মালতীলতার খোঁজ নিয়ে যায়
মৌমাছি দুই বেলা।’
শরৎ প্রকৃতির মধ্যে একটা আলো-আঁধারি ভাব লক্ষণীয়। রৌদ্র-ছায়ায় খেলা সারাক্ষণ চলতে থাকে। এর স্বরূপ প্রকৃতি বোঝা বড় মুশকিল। এই স্বভাবপ্রকৃতির সাথে যেন বাঙালি চরিত্র অন্বিষ্ট হয়ে আছে। বাঙালি জাতি এমনিতেই বহুমিশ্র প্রাণের সমবায়ে গড়ে উঠেছে। নানান জাতির মিশ্রণ সঙ্কর সৃষ্টি হিসেবে পরিচিতি পায়। এদের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য বহুবর্ণিল অবয়ব নিয়ে গঠিত। কোমল-কঠোর ও তিক্ত মধুর স্বভাব নিয়ে আবির্ভূত হয়। কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা বুঝে ওঠা কঠিন। নির্দিষ্ট কোনো চরিত্রে এদের সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। শরৎ প্রকৃতির মধ্যেও অনুরূপ ভাবপ্রবণতা লক্ষণীয়। অনেকে আবার শরৎ ঋতুর সাথে শিশুপ্রকৃতির অনুপ্রাণনা খুঁজে পেয়েছেন। মেঘ-বৃষ্টি-রোদ মিলিয়ে একটা কান্না-হাসির ভাব অভিব্যক্তি লাভ করে। নির্মল দুরন্তপনায় গভীর কোনো চিহ্ন নেই। একপ্রকার স্বর্গীয় সুষমা প্রতিভাত হয়ে ওঠে এবং সবাইকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। একপ্রকার বিরাগী সুরের হাতছানিতে কাছে ডাকে। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত চমৎকারভাবে শরতের এই ভাবভঙ্গিমা প্রসঙ্গে বলেন- ‘আমাদের শরতের নীল চোখের পাতা দেউলে হওয়া যৌবনের চোখের জলে ভিজিয়ে উঠে নাই। আমার কাছে আমাদের শরৎ শিশুর মূর্তি ধরিয়া আসে। সে একেবারে নবীন। বর্ষার গর্ভ হইতে একেবারে জন্ম লইয়া ধরণী ধাত্রীর কোলে শুইয়া সে হাসিতেছে। … বলিতেছিলাম শরতের মধ্যে শিশুর ভাব। তার এই হাসি এই কান্না। সেই হাসিকান্নার মধ্যে কার্যকারণের গভীরতা নাই। তাহা এমনি হালকাভাবে আসে এবং যায় যে কোথাও তার পায়ের দাগটুকু পড়ে না। জলের ঢেউয়ের উপরটাতে আলোছায়া ভাইবোনের মতো যেন কেবলই দুরন্তপনা করে অথচ কোনো চিহ্ন রাখে না শরৎ।
শরতের এই ঐতিহ্যিক আগমনে এ দেশের প্রাণ বারবার জেগে ওঠে। ভিন্নতার একটা আমেজ আহ্বান আমাদের কেবলই হাতছানি দিয়ে যায়। উৎসবের নিবিড় একাত্মতা একটি বিন্দুতে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। সবাই আপন আপন স্বভাবের কাছে স্থিতি লাভ করে। কারণ, এ দেশের জনগণ বরাবরই উৎসবপ্রিয় জাতি হিসেবে পরিচিত। শত প্রকার বাধাবিপত্তি বা দুঃখ-দারিদ্র্যও তাদের উৎসববিমুখ করতে পারে না। এ একপ্রকার ঐতিহ্যিক আত্মতৃপ্তি। শরতের আগমন যেন তা-ই আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

শরৎ : রৌদ্র ছায়ার খেলা

আপডেট টাইম : ১১:৩৯:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫

প্রকৃতিপ্রাণতা জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ধর্ম-কর্ম, শাস্ত্র-সংবেদ, শিক্ষা-দীক্ষা, জীবনযাপন- প্রায় সব কিছু জুড়েই প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য জড়িয়ে আছে। এ দেশের জাতিগত কৃষ্টি-সংস্কৃতিও অনেকাংশে এর ওপর নির্ভরশীল। ঋতুবৈচিত্র্যের বহুবর্ণিল আবহ সমাচ্ছন্ন হয়ে আছে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে মুগ্ধপ্রাণ প্রকৃতি কেবলই আবেশ ছড়িয়ে দেয়। এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। আনন্দযজ্ঞের এই লীলানিকেতন বাংলাদেশে একের পর এক ঋতুর আগমন ঘটে। এর মধ্যে শরতের আবির্ভাব সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বটে। বিভিন্ন কারণে শরৎ আমাদের জীবনে তাৎপর্য বয়ে আনে।
শরৎ আমাদের মধ্যে একটা মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে। ঘনঘোর বর্ষার অবরোধদশা, দুর্যোগপ্রবণ বিচ্ছিন্নতা ও বিরহবিধুর অবস্থা কাটিয়ে শরৎ যেন আশ্বাসের পাখায় ডানা মেলে। এ সময় প্রকৃতির বুকে এক অন্যরকম আবহ-অবিস্মৃতি লক্ষ করা যায়। স্বচ্ছ-সুনীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়। কেমন একটা হালকা চালে হালকা ভাব নিয়ে ওড়াউড়ি চলে। ভারবিহীন মুক্ত জীবনের ইশারায় প্রকৃতিপ্রাণ মুখর হয়ে ওঠে। নদীতীরে সারি সারি কাশফুলের মন মাতানো ঢেউ এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করে। মাঠে মাঠে পক্বপ্রায় ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে কৃষককুল আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়। প্রতীক্ষার প্রহর যেন শেষ হয়ে আসে। কৃষক-কৃষাণী মিলে গোলায় ধান তোলার প্রস্তুতি নেয়। এ সময় গ্রামবাংলায় হালকা শীতের বিকেল নেমে আসে। মাঠে-ঘাটে ছেলের দল ঘুড়ি ওড়াউড়ি-কাটাকাটি নিয়ে মেতে ওঠে। এপাড়া-ওপাড়া মিলে একটা উৎসবমুখর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। তা ছাড়া শিউলিঝরা শিশিরসিক্ত খোলা রোদ মাখানো সকালবেলার কথা বিস্মৃত হওয়ার মতো নয়। সে এক স্নিগ্ধ পরিবেশ। সেখানে শিশিরস্নাত ছেলেমেয়ের দল শিউলি ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথতে বসে যায়। এ সময় হালকা শীতের মনোরম আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। প্রকৃতির মধ্যে একটা মৃদু শিহরণ লক্ষ করা যায়। গাছের পাতায় সেই কম্পনের খবর পৌঁছে যেতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ বলেন,
‘এসেছে শরৎ, হিমের পরশ
লেগেছে হাওয়ার পরে
সকাল বেলায় ঘাসের ডগায়
শিশিরের রেখা ধরে
আমলকী বন কাঁপে যেন তার
বুক করে দুরু দুরু
পেয়েছে খবর পাতা-খসানোর
সময় হয়েছে শুরু
শিউলির ডালে কুঁড়ি ভরে এলো
টগর ফুটিল মেলা
মালতীলতার খোঁজ নিয়ে যায়
মৌমাছি দুই বেলা।’
শরৎ প্রকৃতির মধ্যে একটা আলো-আঁধারি ভাব লক্ষণীয়। রৌদ্র-ছায়ায় খেলা সারাক্ষণ চলতে থাকে। এর স্বরূপ প্রকৃতি বোঝা বড় মুশকিল। এই স্বভাবপ্রকৃতির সাথে যেন বাঙালি চরিত্র অন্বিষ্ট হয়ে আছে। বাঙালি জাতি এমনিতেই বহুমিশ্র প্রাণের সমবায়ে গড়ে উঠেছে। নানান জাতির মিশ্রণ সঙ্কর সৃষ্টি হিসেবে পরিচিতি পায়। এদের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য বহুবর্ণিল অবয়ব নিয়ে গঠিত। কোমল-কঠোর ও তিক্ত মধুর স্বভাব নিয়ে আবির্ভূত হয়। কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা বুঝে ওঠা কঠিন। নির্দিষ্ট কোনো চরিত্রে এদের সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। শরৎ প্রকৃতির মধ্যেও অনুরূপ ভাবপ্রবণতা লক্ষণীয়। অনেকে আবার শরৎ ঋতুর সাথে শিশুপ্রকৃতির অনুপ্রাণনা খুঁজে পেয়েছেন। মেঘ-বৃষ্টি-রোদ মিলিয়ে একটা কান্না-হাসির ভাব অভিব্যক্তি লাভ করে। নির্মল দুরন্তপনায় গভীর কোনো চিহ্ন নেই। একপ্রকার স্বর্গীয় সুষমা প্রতিভাত হয়ে ওঠে এবং সবাইকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। একপ্রকার বিরাগী সুরের হাতছানিতে কাছে ডাকে। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত চমৎকারভাবে শরতের এই ভাবভঙ্গিমা প্রসঙ্গে বলেন- ‘আমাদের শরতের নীল চোখের পাতা দেউলে হওয়া যৌবনের চোখের জলে ভিজিয়ে উঠে নাই। আমার কাছে আমাদের শরৎ শিশুর মূর্তি ধরিয়া আসে। সে একেবারে নবীন। বর্ষার গর্ভ হইতে একেবারে জন্ম লইয়া ধরণী ধাত্রীর কোলে শুইয়া সে হাসিতেছে। … বলিতেছিলাম শরতের মধ্যে শিশুর ভাব। তার এই হাসি এই কান্না। সেই হাসিকান্নার মধ্যে কার্যকারণের গভীরতা নাই। তাহা এমনি হালকাভাবে আসে এবং যায় যে কোথাও তার পায়ের দাগটুকু পড়ে না। জলের ঢেউয়ের উপরটাতে আলোছায়া ভাইবোনের মতো যেন কেবলই দুরন্তপনা করে অথচ কোনো চিহ্ন রাখে না শরৎ।
শরতের এই ঐতিহ্যিক আগমনে এ দেশের প্রাণ বারবার জেগে ওঠে। ভিন্নতার একটা আমেজ আহ্বান আমাদের কেবলই হাতছানি দিয়ে যায়। উৎসবের নিবিড় একাত্মতা একটি বিন্দুতে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। সবাই আপন আপন স্বভাবের কাছে স্থিতি লাভ করে। কারণ, এ দেশের জনগণ বরাবরই উৎসবপ্রিয় জাতি হিসেবে পরিচিত। শত প্রকার বাধাবিপত্তি বা দুঃখ-দারিদ্র্যও তাদের উৎসববিমুখ করতে পারে না। এ একপ্রকার ঐতিহ্যিক আত্মতৃপ্তি। শরতের আগমন যেন তা-ই আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়।