ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনাক্তে সরকারের উদ্যোগ আটকে গেছে পরিকল্পনায়। সরকারি চাকরিতে পোষ্যদের জন্য কোটার পাশাপাশি নানা সুযোগ সুবিধার কারণে মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও নানা কৌশলে নাম তুলেছেন বহু মানুষ। সরকারের প্রাথমিক তথ্য বলছে, নানা সময় অন্তত ৫০ হাজার জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে তাদের কাছে।
এই ভুয়াদের মধ্যে যখন খোদ সচিবের নাম আসে তখন স্বভাবতই আলোড়নটা বেশি হয়। সরকারি চাকরির বয়স দুই বছর বাড়ানোর জন্য একাধিক সচিব এই কাজ করেছেন। নানা কৌশলে নাম তুলেছেন মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়, তদন্তে প্রমাণ হওয়ার পর অবসরে যেতে বাধ্য হয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা। তবে এ ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কোন শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি কাউকে।
অন্য মন্ত্রণালয় তো বটেই খোদ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মাসুদ সিদ্দিকীও একই প্রক্রিয়ায় নাম তুলেছেন মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। তারও অবসরে যাওয়া ছাড়া আর কোন সাজা পেতে হয়নি।
এই অবৈধ মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিতে যাচাই বাছাই করে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করার উদোগ নেয় সরকার। যাচাই-বাচায়ের জন্য গত বছর একটি কমিটিও করা হয়। প্রজ্ঞাপনে যাচাই বাছাইয়ের সময় বেঁধে দেয় সরকার। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল থেকে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে আবেদনকারীদেরকে কাগজপত্র পাঠানো হয়। এর পরে শুরু হয় নানা ধরনের জটিলতা।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে নতুন করে তালিকাভুক্তির জন্য জমা পড়া প্রায় এক লাখ ৪৩ হাজার আবেদন সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোতে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগপত্রও রয়েছে। এ সব নতুন আবেদন ও গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাওয়া নানা অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সারা দেশে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
উপজেলা ও মহানগর পর্যায়ে আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ৪৮৭টি উপজেলা ও আটটি মহানগর কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে পাওয়া সব আবেদন প্যাকেট আকারে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রতিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মধ্যে তা বণ্টন করে দেওয়ার কথা রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদাধিকার বলে উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যসচিব হবেন।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রস্তাবিত এ কমিটির প্রধান হবেন সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য। তাকে অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা হতে হবে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা না হলে সে ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে এর আগের যেকোনো মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সদস্য সভাপতি হবেন। তা না পাওয়া গেলে যুদ্ধকালীন কমান্ডার কমিটির সভাপতি হবেন। কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্যদের বিরোধিতার মুখে সেখান থেকে সরে আসে কাউন্সিল।
পরে সিদ্ধান্ত হয়, সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা না হলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মনোনীত প্রতিনিধি কমিটির প্রধান হবেন। কমিটির অন্য সদস্য হবেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের একজন প্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিটের জেলা কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ উপজেলা ইউনিটের উপজেলা কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মনোনীত একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল সদস্য মনোনীত একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি এবং সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
কিন্তু সব কার্যক্রম যখন এগিয়ে যেতে থাকে তখন মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে একটি পক্ষ। এই আবেদন ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ যাচাই-বাছাই কার্যক্রম আটকে থাকার পেছনে আছে আরও দুটি কারণ। মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কামান্ড কাউন্সিল অসহযোগিতা এবং উপজেলা কমিটি গঠনে দ্বন্দ্বের কারণেও স্থবিরতা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল।
জানতে চাইলে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালক মাহফুজুর রহমান সরকার ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আদালতের রিটের জবাব আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে গেছে। নীতিমালা অনুযায়ী উপজেলা পযায়ে স্থা্নীয় সংসদ সদস্যের কমিটির সভাপতির হওয়ার কথা। তবে তিনি মুক্তিযোদ্ধা না হলে সচিবালয় থেকে একজন কর্মকর্তা বা সাংসদ একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি দেবেন। কিন্তু সংসদ সদস্যরা প্রতিনিধি দিতে গরিমসি করছে। আবার মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কামান্ড কাউন্সিল তাদের কমিটির সম্পুর্ণ তালিকা আমাদের দিতে পারেনি। এসব কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদন ও সনদ যাচাই-বাছাই কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ হান্নান ঢাকাটাইমস টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগামী ২৮ মার্চ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদন ও সনদ যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে আমরা রিটের জবাব দিয়েছি। আদালতের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান হলে ভাল হবে।