ঢাকা ১০:৪৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভাটি শার্দুল সকলের প্রিয় হামিদ ভাই

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৩৮:০৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০১৮
  • ৪২৬ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মোঃ আবদুল হামিদ ১৯৪৪ সালের পয়লা জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম হাজী মোঃ তায়েব উদ্দিন এবং মাতার নাম মরহুমা তমিজা খাতুন। যিনি ভাটি এলাকায় ভাটি শার্দুল, ভাটির পিতা ও ছোট-বড় সকলের কাছেই প্রিয় হামিদ ভাই নামেই পরিচিত।

মোঃ আবদুল হামিদ কিশোরগঞ্জ নিকলী জিসি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে আইএ ও বিএ ডিগ্রি এবং ঢাকার সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত হন।
মোঃ আবদুল হামিদ-এর রাজনৈতিক জীবনের শুরু হয় ১৯৫৯ সালে তৎকালীন ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯৬১ সালে কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয়ার কারণে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৬৪ সালে কিশোরগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ১৯৬৫ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি এবং ১৯৬৬-৬৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের কারণে ১৯৬৮ সালে তিনি কারাবরণ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।
মোঃ আবদুল হামিদ ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ৭১-এর মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কিশোরগঞ্জে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ মার্চ কিশোরগঞ্জ শহরের রথখোলা মাঠে ছাত্র জনসভায় হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেন।
২৬ মার্চের প্রথমপ্রহরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঐদিন সকালেই স্বাধীনতার ঘোষণা টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে সর্বাত্মক মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এপ্রিলের প্রথম দিকে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান-এর কিশোরগঞ্জ, ভৈরব ও বাজিতপুর শাখা থেকে আনুমানিক ১১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা সংগ্রহ করে ঐ সময় নিরাপদ স্থান হিসেবে বিবেচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া ন্যাশনাল ব্যাংক শাখায় জমা রাখেন।
এরপর তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতের আগরতলায় চলে যান। তখন বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা-এর অধিকাংশ সংসদ সদস্য সেখানে অবস্থান করছিলেন। জনাব হামিদ মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁদের সাথে আলোচনা ও শলা-পরামর্শ করেন। একই সাথে তিনি আগরতলায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথেও মতবিনিময় করেন। পরে তিনি এপ্রিলের শেষ দিকে বাংলাদেশে এসে আরো কিছু সহযোগীসহ আবার মেঘালয়ের টেকেরহাট, গুমাঘাট, পানছড়া, মৈইলাম হয়ে বালাট পৌঁছান। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ থেকে আগতদের জন্য তিনি ইয়ুথ রিসিপশন ক্যাম্প চালু করেন এবং এর চেয়ারম্যান ছিলেন। মূলত কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আগতদের প্রাথমিক বাছাই কাজ এখানে করা হতো। এছাড়া মেঘালয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে গঠিত জোনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল-এর তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি ভারতের মেঘালয়ে রিক্রুটিং ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হিসেবে তৎকালীন সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলার বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (মুজিব বাহিনী) সাবসেক্টর কমা-ার পদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে তিনি মেঘালয়ে অবস্থানকারী শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবর্তনে উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন ক্যাম্পে সভা করেন। শরণার্থীদের দেশে ফেরা নিশ্চিত করার পর তিনি ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সনে দেশে ফিরে আসেন।
স্বাধীনতার পর তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বপালন করেন। এরপর ১৯৭৪ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর ১৯৭৬-৭৮ সালে তৎকালীন সরকারের সময় তিনি কারারুদ্ধ হন। তিনি ১৯৭৮ সাল থেকে ২০০৯ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত পাঁচবার কিশোরগঞ্জ বার এসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্বপালন করেন।
একজন সমাজসেবক ও শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক মোঃ আবদুল হামিদ মিঠামইন তমিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মিঠামইন বালক উচ্চ বিদ্যালয়, মিঠামইন কলেজসহ এলাকায় প্রায় ৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৪টি উচ্চ বিদ্যালয় ও ৩টি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি অষ্টগ্রাম কলেজ, মিঠামইন ডিগ্রি কলেজ, ইটনা ডিগ্রি কলেজ, মিঠামইন হাইস্কুল, তমিজা খাতুন গার্লস হাইস্কুল, এলংজুড়ি হাইস্কুল, ইটনা গার্লস হাইস্কুল, বারিবাড়ি হাইস্কুল, আবদুল্লাহপুর হাইস্কুল, আবদুল ওয়াদুদ হাইস্কুল, কিশোরগঞ্জ গার্লস হাইস্কুল, ধনপুর হাইস্কুল, শহীদ স্মৃতি হাইস্কুল, মোহনতলা হাইস্কুল এবং ঘাগড়া আঃ গণি উচ্চ বিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকসহ তাঁর নির্বাচনী এলাকার আরও অনেক জুনিয়র হাইস্কুল ও মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষক।
মোঃ আবদুল হামিদ সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট কমিটি, ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ), কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশন (সিপিএ)-এর এক্সিকিউটিভ কমিটি এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি, কিশোরগঞ্জ জেলা পাবলিক লাইব্রেরির আজীবন সদস্য ও নির্বাহী সদস্য। কিশোরগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমী, কিশোরগঞ্জ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং কিশোরগঞ্জ রাইফেলস্ ক্লাবের আজীবন সদস্য। তিনি কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সম্মানসূচক সদস্যসহ বহু সংগঠনের সাথে জড়িত।
তিনি ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা ৭বার সংসদ সদস্য ছিলেন। বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি ১৯৭০ সালে ময়মনসিংহ-১৮ সংসদ নির্বাচনী এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য, ১৯৭২ সালে গণপরিষদ সদস্য, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে, ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০০১ সালের পয়লা অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন।
মোঃ আবদুল হামিদ সপ্তম জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ১৩ জুলাই ১৯৯৬ থেকে ১০ জুলাই ২০০১ পর্যন্ত এ পদে দায়িত্বপালন করেন। পরবর্তীতে তিনি স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ১২ জুলাই ২০০১ থেকে ২৮ অক্টোবর ২০০১ পর্যন্ত দায়িত্বপালন করেন। অষ্টম জাতীয় সংসদে তিনি ২০০১ সালের পয়লা নভেম্বর থেকে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।
তিনি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নবম জাতীয় সংসদে তিনি স্পিকার নির্বাচিত হন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সফলভাবে এ দায়িত্বপালন করেন। নবম জাতীয় সংসদে তিনি কার্য উপদেষ্টা কমিটি, কার্যপ্রণালী-বিধি সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এবং পিটিশন কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।
সরকারি সফর, সেমিনার, সভা ও ব্যক্তিগত কাজে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, কানাডা, ভারত, জিব্রালটার, বার্বাডোজ, মিশর, সিঙ্গাপুর, দুবাই, আবুধাবী, থাইল্যান্ড, মরক্কো, সৌদি আরব, সাউথ আফ্রিকা, নামিবিয়া, সুইজারল্যান্ড, হংকং, কুয়েত, ইরান, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চায়না, সুইডেন, ফিজি, অস্ট্রেলিয়া, কিরিবাতি, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, জাপান, নাউরো প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মোঃ আবদুল হামিদকে স্বাধীনতা পুরস্কার ২০১৩ প্রদান করা হয়।
সদ্যপ্রয়াত রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকাকালে ১৪ মার্চ ২০১৩ থেকে তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপালন করেন। ২০ মার্চ ২০১৩ তারিখে মোঃ জিল্লুর রহমান মৃত্যুবরণ করলে সেদিন থেকে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপালন করেন। ২২ এপ্রিল ২০১৩ তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দি¦তায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ২৪ এপ্রিল ২০১৩ বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
মোঃ আবদুল হামিদ বিবাহিত এবং তিন পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং বিভিন্ন দেশের সংবিধান ও ইতিহাস গ্রন্থ পাঠ করা তাঁর প্রিয় শখ।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

ভাটি শার্দুল সকলের প্রিয় হামিদ ভাই

আপডেট টাইম : ১১:৩৮:০৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মোঃ আবদুল হামিদ ১৯৪৪ সালের পয়লা জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম হাজী মোঃ তায়েব উদ্দিন এবং মাতার নাম মরহুমা তমিজা খাতুন। যিনি ভাটি এলাকায় ভাটি শার্দুল, ভাটির পিতা ও ছোট-বড় সকলের কাছেই প্রিয় হামিদ ভাই নামেই পরিচিত।

মোঃ আবদুল হামিদ কিশোরগঞ্জ নিকলী জিসি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে আইএ ও বিএ ডিগ্রি এবং ঢাকার সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত হন।
মোঃ আবদুল হামিদ-এর রাজনৈতিক জীবনের শুরু হয় ১৯৫৯ সালে তৎকালীন ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯৬১ সালে কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয়ার কারণে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৬৪ সালে কিশোরগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ১৯৬৫ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি এবং ১৯৬৬-৬৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের কারণে ১৯৬৮ সালে তিনি কারাবরণ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।
মোঃ আবদুল হামিদ ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ৭১-এর মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কিশোরগঞ্জে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ মার্চ কিশোরগঞ্জ শহরের রথখোলা মাঠে ছাত্র জনসভায় হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেন।
২৬ মার্চের প্রথমপ্রহরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঐদিন সকালেই স্বাধীনতার ঘোষণা টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে সর্বাত্মক মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এপ্রিলের প্রথম দিকে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান-এর কিশোরগঞ্জ, ভৈরব ও বাজিতপুর শাখা থেকে আনুমানিক ১১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা সংগ্রহ করে ঐ সময় নিরাপদ স্থান হিসেবে বিবেচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া ন্যাশনাল ব্যাংক শাখায় জমা রাখেন।
এরপর তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতের আগরতলায় চলে যান। তখন বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা-এর অধিকাংশ সংসদ সদস্য সেখানে অবস্থান করছিলেন। জনাব হামিদ মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁদের সাথে আলোচনা ও শলা-পরামর্শ করেন। একই সাথে তিনি আগরতলায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথেও মতবিনিময় করেন। পরে তিনি এপ্রিলের শেষ দিকে বাংলাদেশে এসে আরো কিছু সহযোগীসহ আবার মেঘালয়ের টেকেরহাট, গুমাঘাট, পানছড়া, মৈইলাম হয়ে বালাট পৌঁছান। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ থেকে আগতদের জন্য তিনি ইয়ুথ রিসিপশন ক্যাম্প চালু করেন এবং এর চেয়ারম্যান ছিলেন। মূলত কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আগতদের প্রাথমিক বাছাই কাজ এখানে করা হতো। এছাড়া মেঘালয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে গঠিত জোনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল-এর তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি ভারতের মেঘালয়ে রিক্রুটিং ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হিসেবে তৎকালীন সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলার বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (মুজিব বাহিনী) সাবসেক্টর কমা-ার পদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে তিনি মেঘালয়ে অবস্থানকারী শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবর্তনে উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন ক্যাম্পে সভা করেন। শরণার্থীদের দেশে ফেরা নিশ্চিত করার পর তিনি ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সনে দেশে ফিরে আসেন।
স্বাধীনতার পর তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বপালন করেন। এরপর ১৯৭৪ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর ১৯৭৬-৭৮ সালে তৎকালীন সরকারের সময় তিনি কারারুদ্ধ হন। তিনি ১৯৭৮ সাল থেকে ২০০৯ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত পাঁচবার কিশোরগঞ্জ বার এসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্বপালন করেন।
একজন সমাজসেবক ও শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক মোঃ আবদুল হামিদ মিঠামইন তমিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মিঠামইন বালক উচ্চ বিদ্যালয়, মিঠামইন কলেজসহ এলাকায় প্রায় ৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৪টি উচ্চ বিদ্যালয় ও ৩টি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি অষ্টগ্রাম কলেজ, মিঠামইন ডিগ্রি কলেজ, ইটনা ডিগ্রি কলেজ, মিঠামইন হাইস্কুল, তমিজা খাতুন গার্লস হাইস্কুল, এলংজুড়ি হাইস্কুল, ইটনা গার্লস হাইস্কুল, বারিবাড়ি হাইস্কুল, আবদুল্লাহপুর হাইস্কুল, আবদুল ওয়াদুদ হাইস্কুল, কিশোরগঞ্জ গার্লস হাইস্কুল, ধনপুর হাইস্কুল, শহীদ স্মৃতি হাইস্কুল, মোহনতলা হাইস্কুল এবং ঘাগড়া আঃ গণি উচ্চ বিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকসহ তাঁর নির্বাচনী এলাকার আরও অনেক জুনিয়র হাইস্কুল ও মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষক।
মোঃ আবদুল হামিদ সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট কমিটি, ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ), কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশন (সিপিএ)-এর এক্সিকিউটিভ কমিটি এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি, কিশোরগঞ্জ জেলা পাবলিক লাইব্রেরির আজীবন সদস্য ও নির্বাহী সদস্য। কিশোরগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমী, কিশোরগঞ্জ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং কিশোরগঞ্জ রাইফেলস্ ক্লাবের আজীবন সদস্য। তিনি কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সম্মানসূচক সদস্যসহ বহু সংগঠনের সাথে জড়িত।
তিনি ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা ৭বার সংসদ সদস্য ছিলেন। বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি ১৯৭০ সালে ময়মনসিংহ-১৮ সংসদ নির্বাচনী এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য, ১৯৭২ সালে গণপরিষদ সদস্য, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে, ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০০১ সালের পয়লা অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন।
মোঃ আবদুল হামিদ সপ্তম জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ১৩ জুলাই ১৯৯৬ থেকে ১০ জুলাই ২০০১ পর্যন্ত এ পদে দায়িত্বপালন করেন। পরবর্তীতে তিনি স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ১২ জুলাই ২০০১ থেকে ২৮ অক্টোবর ২০০১ পর্যন্ত দায়িত্বপালন করেন। অষ্টম জাতীয় সংসদে তিনি ২০০১ সালের পয়লা নভেম্বর থেকে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।
তিনি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নবম জাতীয় সংসদে তিনি স্পিকার নির্বাচিত হন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সফলভাবে এ দায়িত্বপালন করেন। নবম জাতীয় সংসদে তিনি কার্য উপদেষ্টা কমিটি, কার্যপ্রণালী-বিধি সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এবং পিটিশন কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।
সরকারি সফর, সেমিনার, সভা ও ব্যক্তিগত কাজে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, কানাডা, ভারত, জিব্রালটার, বার্বাডোজ, মিশর, সিঙ্গাপুর, দুবাই, আবুধাবী, থাইল্যান্ড, মরক্কো, সৌদি আরব, সাউথ আফ্রিকা, নামিবিয়া, সুইজারল্যান্ড, হংকং, কুয়েত, ইরান, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চায়না, সুইডেন, ফিজি, অস্ট্রেলিয়া, কিরিবাতি, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, জাপান, নাউরো প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মোঃ আবদুল হামিদকে স্বাধীনতা পুরস্কার ২০১৩ প্রদান করা হয়।
সদ্যপ্রয়াত রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকাকালে ১৪ মার্চ ২০১৩ থেকে তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপালন করেন। ২০ মার্চ ২০১৩ তারিখে মোঃ জিল্লুর রহমান মৃত্যুবরণ করলে সেদিন থেকে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপালন করেন। ২২ এপ্রিল ২০১৩ তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দি¦তায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ২৪ এপ্রিল ২০১৩ বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
মোঃ আবদুল হামিদ বিবাহিত এবং তিন পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং বিভিন্ন দেশের সংবিধান ও ইতিহাস গ্রন্থ পাঠ করা তাঁর প্রিয় শখ।