হাওর বার্তা ডেস্কঃ ‘তখন আমি কিশোরী। ইলিয়াস কাঞ্চন আমাদের বাসায় এসেছেন। তখন সিনেমার অনেকেই আমাদের বাসায় আসতেন যেতেন। দুই বোন সুচন্দা ও ববিতা জনপ্রিয় নায়িকা। তাই খুব একটা আগ্রহ দেখাইনি কে এসেছে। কিন্তু একটা কাজে নিচে নামতে গিয়ে কাঞ্চনকে ভাইকে দেখে কেন জানি বুকটা কেঁপে উঠলো। কী একটা মুগ্ধতা পেয়ে বসেছিলো অন্তরের মধ্যে।
তিনি তো আমার নায়ক হতে আসেননি, বড় বোন ববিতা আপার নায়ক হবেন। তার জন্য আমার কেন মুগ্ধতা তৈরি হয়েছিলো জানি না। তবে সেই মুগ্ধতা আজও কাটেনি আমার। ইলিয়াস কাঞ্চন আমার কাছে অনেক ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার একজন মানুষ।’ চলচ্চিত্রে নিজের প্রিয় নায়কের চল্লিশ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে এসে এসব কথাই বললেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী চম্পা।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার সৌভাগ্য জীবনের প্রথম নায়ক হিসেবে কাঞ্চন ভাইকে পেয়েছি। তখন তিনি অনেক জনপ্রিয়। সব নায়িকাই চাইতো তার নায়িকা হবে। ‘তিন কন্যা’ ছবিতে আমার নায়ক হিসেবে তাকে পেয়ে আমি খুব আনন্দিত ছিলাম। তবে বেশ রাশভারী মানুষ কাঞ্চন ভাই। তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ভয়ে ছিলাম। দিনে দিনে জানা হলো তিনি চমৎকার একজন মানুষ।
সৎ, নিষ্ঠাবান। মজার ব্যাপার ছিলো আমি তার সঙ্গে অনেক গল্প করতে চাইতাম কিন্তু হতো না। তিনি সবসময় সিরিয়াস মুডে থাকেন। যারা ইলিয়াস কাঞ্চনকে চেনেন তারা নিশ্চয়ই এই কথা জানেন। কাঞ্চন ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ জমাতে হয় সিরিয়াস বিষয় নিয়ে। শুটিংয়ের সময় বা সিনেমার যে কাঞ্চন ভাই বাস্তবে তার একেবারেই বিপরীত। রোমান্টিক দৃশ্যের শুটিং শেষ করে তিনি স্পটে বসে তজবিহ টিপতেন। তাকে কেউ ঘাঁটাতো না। আমি শুধু ভাবতাম, সিনেমার ভেতরে এত রোমান্টিক মানুষটি কেমন করে বাস্তবজীবনে এতো আনরোমান্টিক হতে পারে? উত্তর পেতাম না।
চম্পা আরও বলেন, ‘আমার জীবনের সেরা সেরা কাজগুলো আমি কাঞ্চন ভাইয়ের বিপরীতে করেছি। এটা আমার জন্য আনন্দের বিষয়। তার মতো অভিনেতা আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে খুব একটা আসেনি। তাকে এখনো কাজে লাগানো উচিত। তিনি আপাদমস্তক চলচ্চিত্রের মানুষ। চলচ্চিত্রকে তিনি কতোটা ভালোবাসেন সেটা সবাই জানেন। তাকে কাছ থেকে দেখলে, তার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম অনেক কিছু শিখতে পারতো। বিশেষ করে অভিনয়ের দক্ষতা, সময়ানুবর্তিতা।’
চম্পা ইলিয়াস কাঞ্চনকে নিয়ে বলতে গিয়ে শুরুতেই বেশ মজা করেন। তিনি বলেন, ‘কাঞ্চন ভাই, আপনার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক তাতে উচিত ছিলো আজকের এই আয়োজনে বিকেল থেকেই আপনার সঙ্গে থাকা। আপনাকে সাহায্য করা। কিন্তু আমি পারিবারিক ঝামেলায় সেটা পরিনি। আমি দুঃখিত কাঞ্চন ভাই। এখানে আজ কতো বড় বড় মানুষজন আপনাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছেন। ফুল নিয়ে এসেছেন। আমারও উচিত ছিলো ফুল দিয়ে আপনাকে শুভেচ্ছা জানানো।
তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে ফুলও আমি আনতে পারিনি। তবে কাঞ্চন ভাই, আপনার জন্য আমি আমার হৃদয় নিয়ে এসেছি। আমার অন্তর ভরা ভালোবাসা নিয়ে এসেছি। ফুল দিয়ে সেই ভালোবাসার পরিমাপ কোনোদিন করা যাবে না। আপনি চিরদিন আমার কাছে সিনেমার প্রথম আবেগের নায়ক। আপনার পাশে ভাবী বসে আছেন। বাকীটা তিনি আপনাকে বাসায় নিয়ে বলবেন। যদি তিনি আপনার উপর আমার ভালোবাসা দেখে রাগ করেন আমার তাতে দোষ নেই।’
চম্পার এমন রসিকতায় হেসে উঠেন ইলিয়াস কাঞ্চন ও আয়োজনে উপস্থিত সবাই। চম্পা বলে যান, ‘কাঞ্চন ভাই, গাড়িতে করে আপনার অনুষ্ঠানে আসতে আসতে ভাবছিলাম সময় কতো দ্রুত ফুরিয়ে যায়। আমরা ভাবি জীবন অনেক বড়। কিন্তু জীবন আসলে অতো বড় নয়।
চোখের পলকেই চল্লিশটি বছর কেটে গেল আপনার। কতো চড়াই উৎরাই পার হয়েছেন আপনি। সম্ভবত দেশের মানুষের নিখাদ ভালোবাসা আপনাকে আজও সাহস যুগিয়ে চলেছে। ইন্ডাস্ট্রির অনেক মানুষ আপনার কাছে ঋণি। সবাই আপনার জন্য দোয়া করে আপনি ভালো থাকুন। আমিও মন থেকে দোয়া করি আরও অনেকদিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকুন আপনি।’
চম্পার বলা শেষে ইলিয়াস কাঞ্চন নিজেই ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান তার অসংখ্য সুপারহিট ছবির নায়িকাকে। এসময় উপস্থাপক মুজতবা সৌদ চম্পাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠেন, ‘প্রিয় চম্পাকে বলতে চাই, আপনি আমাদের নায়কের জন্য ফুল নিয়ে আসতে পারেননি বলে দুঃখ করবেন না। চম্পা নিজেই একটি ফুলের নাম। আপনি এসেছেন আপনার নায়ককে অভিনন্দিত করতে এরবেশি আর কী সুন্দরতর দৃশ্য হতে পারে!’
গতকাল ঢাকা ক্লাবে আয়োজিত হয় ইলিয়াস কাঞ্চনের চলচ্চিত্রে চল্লিশ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান। আবেগঘন সেই সন্ধ্যায় তিন প্রজন্মের নায়ককে শুভেচ্ছা জানাতে হাজির হয়েছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ চলচ্চিত্রের শতাধিক মানুষ। ফারুক, চম্পা, আহমেদ শরীফ, জাভেদ, কাজী হায়াৎ, মুশফিকুর রহমান গুলজার, সোহানুর রহমান সোহান, শাবনাজ, আমিন খান, শাবনূর, পপি, মিশা সওদাগর, জায়েদ খান, ফেরদৌস, পূর্ণিমা, ফাহমিদা নবীসহ ইলিয়াস কাঞ্চনের চলচ্চিত্র জীবনের প্রযোজক ও নির্মাতাদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানস্থল হয়ে উঠেছিলো এক টুকরো ফিল্মপাড়া।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর ‘বসুন্ধরা’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় তার। বিপরীতে ছিলেন তখনকার মোস্ট গ্ল্যামারাস নায়িকা ববিতা। ছবিটির পরিচালক ছিলেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের অমর নির্মাতা সুভাষ দত্ত।