হাওর বার্তা ডেস্কঃ যে দর্শক নিয়মিত সিনেমা দেখেন কিংবা নিয়মিত গান শোনেন তাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, গত পাঁচ বছরে বাংলা ছবির জনপ্রিয় কয়েকটি গানের নাম বলুন? মাথায় হাত উঠে যাবে। বেশকিছু সময় ভাববেন। কোনো গানের নাম খুঁজে পাবেন না। তবে দু’একটি গান পাওয়া যাবে, যেগুলো সামান্য সময়ের জন্য জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু হারিয়ে গেছে আবার। এখনকার সিনেমার গান কেবল ইউটিউবেই ভিউ হয় কিন্তু ভিউয়ার গণ্ডির বাইরে সিনেমার সেসব গান বাজতে দেখা যায় না। অথচ আশি কিংবা নব্বই দশকের ছবির অনেক গান এখনও কানে বাজে। গানগুলো নিয়ে এখনও তারকারা স্টেজে পারফর্ম করে বেড়াচ্ছেন। নতুন রিমেক করে গাওয়া হচ্ছে সে গানগুলো।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সে সময় ফিতার ক্যাসেটের গান ছিল। অ্যালবামের গানের চেয়ে সিনেমার গানই প্রিয় ছিল শ্রোতাদের কাছে। এখন সিনেমার গানে কথা কাজে মিল না থাকার মতো অবস্থা। গল্পের সঙ্গে গানের কোনো সামঞ্জস্য নেই। হুট করেই গান চলে আসে গল্পের মাঝে। অনেক ছবিতে তো সিনেমার দৈর্ঘ্য বাড়ানোর জন্যই গান ব্যবহার করা হয়। গানের কথার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সুরেও নেই নতুনত্ব। আর গানের কথার কথা না বললেই নয়। গীতিকার নিজেই জানেন না তিনি কি লিখছেন। কমার্শিয়াল গীতিকার টাকা পাচ্ছেন আর নকল সুরের ওপর কথা বসিয়ে ৩০ মিনিটে লিরিক ডেলিভারি দিয়ে যাচ্ছেন। গানের কথা নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। চর্চাও নেই আজকাল।
তবে কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। ভালো করার চেষ্টা ও চর্চা দেখা যাচ্ছে। যার সংখ্যা একেবারেই কম। ভালোর চর্চা কম বলে সিনেমার গান জনপ্রিয় হওয়ার আশাও কম। আগামী এক দশকেও সিনেমার গানের সোনালি দিন ফিরবে কী না সন্দেহ। সিনেমার গল্প টেনে তুলতে গানের প্রয়োজন হয়। গান গল্পে প্রাণ জাগায়। আড়াই বা তিন ঘণ্টা সিনেমা দেখতে দর্শকদের মাঝে বোরিং লাগাকে বিদায় জানায় গান। গানে নায়ক-নায়িকার পারফর্ম দর্শকদের প্রাণে অন্যরকম আনন্দ সঞ্চার করে। প্রেক্ষাগৃহ থেকে বের হয়ে তারা গুনগুনিয়ে সেই গান গাইতে থাকেন। এখন সেটা দেখা যায় না।
দেখা গেছে, ষাট থেকে নব্বই দশকেও সিনেমার নির্মাতারা সুরকার ও গীতিকারদের নিয়ে গবেষণা করতেন। গানের ওপর ভিত্তি করে অনেক সময় সিনেমার গল্পও সাজানো হতো। আবার গানকে প্রাধান্য দিয়ে সিনেমায় বাড়তি সিক্যুয়েন্স যুক্ত করা হতো। আর এখন সিনেমা দীর্ঘ করতে গান কিংবা অবস্থার জন্য গান, যা সিনেমার গানের অবক্ষয় ডেকে আনছে। এখন লেখা, সুর দেয়া আর গাওয়া যার যার মতো করে চলছে। গানের কথার গভীরতা নেই। তা ছাড়া এখন সবচেয়ে বড় যে ধাক্কা, সবকিছুই আধুনিক হয়ে পড়ছে। এই আধুনিকতার কারণে সব কিছুতেই পরিবর্তন আসছে। এই পরিবর্তন ভালো হলে তাকে মন্দ বলব না। কিন্তু সঙ্গীতশিল্প এখন তথাকথিত আধুনিকতার ছোঁয়ায় ক্রমেই বিবর্ণ হচ্ছে।
বর্তমানে গানের মৌলিকত্ব দুঃখজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। তাই শ্রোতাদের মনেও স্থায়ী আসন গড়ে নিতে পারছে না। এর অনেক কারণ রয়েছে। যোগ্য গীতিকার ও সুরকারের অভাব। গানের কথা ও সুরে এখন মেলোডি কিংবা জীবন বোধের অভাব। কথা ও সুরে নেই গভীরতা। মান ও প্রাণহীন গান শ্রোতারা গ্রহণ করবে কেন? এখন আর সানাই, সেতার, বাঁশি, তবলা, হারমোনিয়ামসহ কোনো অ্যাকোয়িস্টিক ইন্সট্রু–মেন্ট ব্যবহার করা হয় না। এখন সবই কি-বোর্ডনির্ভর হয়ে পড়েছেন। এখন যে কেউ ইচ্ছা করলেই গান লিখে ফেলছেন। মনে রাখতে হবে, কোনো কিছু সহজলভ্য হয়ে গেলে তার মান আর থাকে না। চলচ্চিত্রের গানের ক্ষেত্রে এখন তাই হয়েছে। নকল কথা ও সুরের সঙ্গে গেল কয়েক বছর ধরে যুক্ত হয়েছে কলকাতার আদলে কথা। তুমি কে তুই বলা, হিন্দি শব্দ ব্যবহার তো আছেই। এসবের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের গান যেমন হারাচ্ছে স্বকীয়তাম, তেমনি হারাচ্ছে প্রাণ।
গীতিকার কে জি মোস্তফা, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, খান আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আমজাদ হোসেন, আহমেদ জামান চৌধুরী, রফিকুজ্জামানসহ অনেকের লেখা গান চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কালজয়ী হয়ে আছে। তেমনি সুরের ক্ষেত্রে সত্য সাহা, রবীন ঘোষ, সুবল দাস, আলাউদ্দিন আলী, বশীর আহমেদ, আলম খান, আনোয়ার পারভেজ, খান আতাউর রহমান, হ্যাপি আকন্দ, লাকি আখন্দ, আলতাফ মাহমুদ, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, শেখ সাদী খানদের সুর করা গান আজও মানুষের হৃদয় লেগে আছে।
এ প্রজন্মের সুরকার, গীতিকাররাও যে ভালো করছেন না এমনটা নয়। কিন্তু সেটা তুলনায় খুবই কম। হয়তো একটি সিনেমার প্রডিউসার কিংবা পরিচালকরা চাচ্ছেন না যথেষ্ট সময় দিতে। যেটা খুব জরুরি। চলচ্চিত্রের গানের জন্য বিদেশ বিভুঁইয়ে শুটিংটাই যথেষ্ট নয়, সেটা কি জানে না পরিচালকরা! গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালকরা সংখ্যার দৌড়ে না ছুটে মানের দিকটা খেয়াল রাখলে হয়তো আজকালকার কোনো গানও বেঁচে থাকবে আরও কয়েক যুগ। গানও কোনো সিনেমাকে বানাতে পারে ব্যবসাসফল।