ঢাকা ০৬:৫১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
সাদপন্থীদের নিষিদ্ধ ও বিচারের দাবিতে মদনে আবারও বিক্ষোভ মিছিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বর্ডারে দুর্নীতির কারণে ঠেকানো যাচ্ছে না ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আব্রাম না থাকলে তাকে আমার যোগ্য বলেও মনে করতাম না ওমরাহ শেষে গ্রামে ফিরে খেজুর-জমজমের পানি বিতরণ করল শিশু রিফাত বিদেশে প্রশিক্ষণে ঘুরে-ফিরে একই ব্যক্তি নয়, জুনিয়রদের অগ্রাধিকার কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়ে সড়ক ছাড়লেন চিকিৎসকরা রেমিট্যান্সে জোয়ার, ২১ দিনে এলো ২ বিলিয়ন ডলার গণমাধ্যমের পাঠক-দর্শক-শ্রোতার মতামত জরিপ জানুয়ারিতে বুয়েট শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৩ আসামি রিমান্ডে বিয়ের আগে পরস্পরকে যে প্রশ্নগুলো করা জরুরি

কৃষ্ণচূড়া গ্রামের স্বপ্ন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:২৮:১২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫
  • ৪৫৩ বার

আর সব গ্রামের মতো তার গ্রামেও সবুজ গাছপালার কমতি নেই। তবে এসব সবুজের সঙ্গে লালের সম্মিলন ঘটানোর স্বপ্ন দেখেন তিনি। তাই গ্রামের পথে পথে লাগাচ্ছেন কৃষ্ণচূড়ার গাছ। তিনি ভাবতে ভালোবাসেন, একদিন গাছগুলো বড় হবে, কৃষ্ণচূড়ার লালে রঙিন হবে তার গ্রাম। আশপাশের মানুষ গ্রামকে চিনবে কৃষ্ণচূড়ার গ্রাম বলে।

ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার উমেদপুর ইউনিয়নের লক্ষণদিয়া গ্রামের একজন আমিনুল ইসলামের স্বপ্ন এটা। সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সর্বান্তকরণে গাছের বন্ধু এই মানুষটি তার গ্রামের পথে পথে লাগাচ্ছেন কৃষ্ণচূড়ার চারা। শুধু কৃষ্ণচূড়া নয়, সব গাছের জন্যই তার মনে রয়েছে অপরিসীম ভালোবাসা। তাই তো গ্রামের বাড়িতে মা আকতার বানুর নামে সেলাই প্রশিক্ষণের জন্য তৈরি করা বাড়িটিকে গাছপালা দিয়ে এমনভাবে সাজিয়েছেন, আশপাশের মানুষের কাছে বাড়িটির নামই হয়ে গেছে গাছের বাড়ি।
আমিনুল ইসলামের মনে গাছের জন্য ভালোবাসাটার জন্ম হয়েছে শৈশবে। সেই সময় একদিন বড় ভাই মোয়াজ্জেম হোসেন টবে লাগানো লিচুর চারা নিয়ে আসার পর গাছ নিয়ে মাতামাতি শুরু হয় তার। যতদূর মনে করতে পারেন, তখন তিনি বিএলকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। তখনও আমিনুলের পৃথিবী বৃষ্ণপুর, লক্ষণদিয়া ও কৃষ্ণপুর _এ তিন গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ গ্রাম তিনটির আদ্যক্ষর দিয়ে করা হয়েছে বিএলকে, যা তিন গ্রামের মানুষের ঐক্যবদ্ধতারও আরেক নাম। ছোটবেলায় এই তিন গ্রামের কোথাও টবে লাগানো গাছ তার চোখে পড়ত না।
বড় ভাইয়ের আনা লিচুর চারা তো টব থেকে মুক্ত হলো। কিন্তু টবের মুক্তি মিলল না। পরিত্যক্ত টবে ফুলের চারা লাগানো হলো। সেই থেকে শুরু। একই সময় অন্য একটা কাজের সঙ্গেও ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন আমিনুল। সেটা সেলাই। সূচিশিল্পের প্রতি মেয়েদের আগ্রহ স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হলেও একটা ছেলে এই কাজ করছে এটা তখন একেবারেই ভালোভাবে নেয়নি পরিবারের লোকজন।
আমিনুল ইসলাম ছোটবেলার ওই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ”আমাদের ছোটবেলায় স্কুলে ‘হাতের কাজ’ বলে একটা পরীক্ষা ছিল। ছাত্রছাত্রীরা মাটি, বাঁশ-বেত ইত্যাদি নানান উপকরণ দিয়ে তৈরি শৈল্পিক কিছু করে নিয়ে যেত। যতদূর এটাও তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময়কার ঘটনা। বার্ষিক পরীক্ষায় আমি নিয়ে গেলাম সেলাইয়ের কাজ।” পরীক্ষায় তাকে আদৌ কোনো নম্বর দেওয়া হয়েছিল কি-না, এটা আর মনে করতে পারেন না আমিনুল। তবে মনে আছে এ জন্য বিদ্রূপ সইতে হয়েছিল।
ঘরে-বাইরে সর্বত্রই বিদ্রূপের তীব্র তীরে বিদ্ধ হয়েছেন আমিনুল। তার প্রধান ভরসা ছিলেন বাবা গোলাম কওছার আলী বিশ্বাস। নানান জনের নানা কথা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন বাবা। আরও একজনের কথা গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করেন আমিনুল, তিনি তার ভাবি ড. জুলিয়া মঈন। এই ভাবির কাছ থেকে বরাবরই উৎসাহ পেয়েছেন।
এক সময় গানও শিখতে চেয়েছিলেন এবং গানের শিক্ষক বুলবুল চৌধুরীর জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন একটি পাঞ্জাবি। সেটা পরে শিক্ষক এক অনুষ্ঠানে গেলে জেলা প্রশাসক পাঞ্জাবিটার প্রশংসা করে এটা কার তৈরি জানতে চান। জেলা প্রশাসককে বিশ্বাস করাতে সময় লেগেছে যে, সূচিকর্মের ওই পাঞ্জাবিটা কোনো ছাত্রীর নয়, একজন ছাত্রই করেছে। পরে অবশ্য আমিনুল ইসলামকে জেলা প্রশাসকের জন্যও একটা পাঞ্জাবি তৈরি করে দিতে হয়েছিল। ওই জেলা প্রশাসকের নাম এখন আর তার মনে নেই।
এভাবেই চলছিল জীবন। সূচিশিল্পে আমিনুলের পারঙ্গমতা প্রকাশ পাচ্ছিল। নিজের জন্য, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের জন্য কাজ করে দিচ্ছিলেন। এরই মধ্যে একদিন তার গানের শিক্ষক বললেন, ‘তুমি ঢাকায় যাও। গিয়ে দেখ আড়ং তোমাকে কোনো কাজ দেয় কি-না। ঢাকায় এই সব কাজের কদর পাবে। দেখবে একদিন তোমারও লাখ লাখ টাকা হবে।’
ঢাকায় আসেন আমিনুল। সেটা আশির দশকের শেষ দিককার কথা। থাকতেন মিরপুরে। আসা-যাওয়ার পথে দেখেন আড়ংয়ের সামনে হাতের কাজের সুন্দর সব পোশাক পরা ম্যানিকিন। একদিন সাহস করে গেলেন আড়ংয়ে কথা বলতে। ততদিনে তিনি মিরপুর ছেড়ে চলে এসেছেন উত্তরার ফায়দাবাদে। আড়ং আমিনুলকে ১০০টি ইয়ক এমব্রয়ডারির কাজ দিল। তখনও কাজগুলো সূচারুভাবে করার অনেক কৌশল অজানা ছিল তার। প্রথমবার তার কাজে সহযোগিতা করার জন্য খুঁজে পেলেন এক নারী সূচিশিল্পীকে। তার নাম জবেদা খাতুন। এই জবেদা খাতুন সেই নব্বুই সাল থেকে আছেন আমিনুলের কাজের সঙ্গে।
আমিনুল ইসলামের বাংলা সেলাই নামে প্রতিষ্ঠানের জন্ম হলো তখন থেকে। তিনি বললেন, প্রথম অর্ডারের কাজগুলো করার মতো টাকাটাও ছিল না তার হাতে। টাকা ধার দিয়েছিলেন এক বন্ধুর খালা ফজিলাতুন নেসা শিরি। ওই বন্ধুর খালাই এখন আমিনুলের খালা-শাশুড়ি। একজন কর্মী নিয়ে ছোট্ট পরিসরে গড়া সেই বাংলা সেলাই এখন এক বিরাট প্রতিষ্ঠান। দুই থেকে তিন হাজার নারী পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বাংলা সেলাইয়ের কর্মযজ্ঞে জড়িত আছেন। উত্তরার ফায়দাবাদে বাড়ি করেছেন আমিনুল। ছয়তলা ওই বাড়ির দুটি ফ্লোরে তিনি স্ত্রী সি্নগ্ধা ইসলাম এবং দুই সন্তান আকিক ও জয়ীকে নিয়ে বাস করেন। বাকিটাজুড়ে তার ওয়ার্কশপ ও অফিস। গ্রামের বাড়িতেও করেছেন সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেখানেও কাজ হয়। কাজ হয় ঝিনাইদহ শহরে আমিনুলের বন্ধু আবদুর রহিমের বাড়িতে। ওই বাড়িতে কাজ হয় আবদুর রহিমের স্ত্রী মনোয়ারা বেগমের তত্ত্বাবধানে। বাংলা সেলাইয়ের সেলাই কাজে যারা যুক্ত রয়েছেন, তাদের অনেকেই নিজেদের ঘরে বসেও কাজ করেন। কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আসেন। এক আড়ং দিয়ে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে দেশি-বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান।
আর্থিকভাবে থিতু হওয়ার পর আবারও গাছ নিয়ে ছোটবেলার অপূর্ণ শখটাকে পূর্ণ করায় মেতেছেন আমিনুল ইসলাম। ঢাকার বাড়ির ছাদে বাগান করেছেন। শুধু ছাদে নয়, তার বাড়ির ভেতরে গাছপালা এমনভাবে রাখা হয়েছে, মনেই হয় না, ইট-পাথরে এই নগরের একটি বাড়ি এটি। গ্রামে যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সেখানে তো অনেক জায়গা এবং সর্বত্রই আছে দুর্লভ সব গাছ। অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া_ যখন যেখানে গেছেন, সেখান থেকেই নিয়ে এসেছেন নানান গাছপালা।
গ্রামে আমিনুল ইসলামের গাছের বাড়ি দেখতে আসেন অনেকেই। তার বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে এসেছিলেন শৈলকূপা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সন্দ্বীপ কুমার সরকার। তিনি লিখে রেখে গেছেন, ‘আজ আমিনুল ইসলামের উদ্যোগে গ্রামের প্রবেশ পথ ও বাঁধের বিভিন্ন স্থানে কৃষ্ণচূড়া গাছ রোপণ করলাম। বৃক্ষ ও সৌন্দর্যপ্রেমী এই মানুষটির আগ্রহে ও উদ্যোগে আমি অভিভূত। একজন মানুষ তার স্বপ্ন নিয়ে নিজে, তার সঙ্গে এই গ্রামের মানুষগুলোকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। তার স্বপ্ন ও সৌন্দর্যবোধ সবাইকে স্পর্শ করুক।’

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

সাদপন্থীদের নিষিদ্ধ ও বিচারের দাবিতে মদনে আবারও বিক্ষোভ মিছিল

কৃষ্ণচূড়া গ্রামের স্বপ্ন

আপডেট টাইম : ১০:২৮:১২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

আর সব গ্রামের মতো তার গ্রামেও সবুজ গাছপালার কমতি নেই। তবে এসব সবুজের সঙ্গে লালের সম্মিলন ঘটানোর স্বপ্ন দেখেন তিনি। তাই গ্রামের পথে পথে লাগাচ্ছেন কৃষ্ণচূড়ার গাছ। তিনি ভাবতে ভালোবাসেন, একদিন গাছগুলো বড় হবে, কৃষ্ণচূড়ার লালে রঙিন হবে তার গ্রাম। আশপাশের মানুষ গ্রামকে চিনবে কৃষ্ণচূড়ার গ্রাম বলে।

ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার উমেদপুর ইউনিয়নের লক্ষণদিয়া গ্রামের একজন আমিনুল ইসলামের স্বপ্ন এটা। সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সর্বান্তকরণে গাছের বন্ধু এই মানুষটি তার গ্রামের পথে পথে লাগাচ্ছেন কৃষ্ণচূড়ার চারা। শুধু কৃষ্ণচূড়া নয়, সব গাছের জন্যই তার মনে রয়েছে অপরিসীম ভালোবাসা। তাই তো গ্রামের বাড়িতে মা আকতার বানুর নামে সেলাই প্রশিক্ষণের জন্য তৈরি করা বাড়িটিকে গাছপালা দিয়ে এমনভাবে সাজিয়েছেন, আশপাশের মানুষের কাছে বাড়িটির নামই হয়ে গেছে গাছের বাড়ি।
আমিনুল ইসলামের মনে গাছের জন্য ভালোবাসাটার জন্ম হয়েছে শৈশবে। সেই সময় একদিন বড় ভাই মোয়াজ্জেম হোসেন টবে লাগানো লিচুর চারা নিয়ে আসার পর গাছ নিয়ে মাতামাতি শুরু হয় তার। যতদূর মনে করতে পারেন, তখন তিনি বিএলকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। তখনও আমিনুলের পৃথিবী বৃষ্ণপুর, লক্ষণদিয়া ও কৃষ্ণপুর _এ তিন গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ গ্রাম তিনটির আদ্যক্ষর দিয়ে করা হয়েছে বিএলকে, যা তিন গ্রামের মানুষের ঐক্যবদ্ধতারও আরেক নাম। ছোটবেলায় এই তিন গ্রামের কোথাও টবে লাগানো গাছ তার চোখে পড়ত না।
বড় ভাইয়ের আনা লিচুর চারা তো টব থেকে মুক্ত হলো। কিন্তু টবের মুক্তি মিলল না। পরিত্যক্ত টবে ফুলের চারা লাগানো হলো। সেই থেকে শুরু। একই সময় অন্য একটা কাজের সঙ্গেও ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন আমিনুল। সেটা সেলাই। সূচিশিল্পের প্রতি মেয়েদের আগ্রহ স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হলেও একটা ছেলে এই কাজ করছে এটা তখন একেবারেই ভালোভাবে নেয়নি পরিবারের লোকজন।
আমিনুল ইসলাম ছোটবেলার ওই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ”আমাদের ছোটবেলায় স্কুলে ‘হাতের কাজ’ বলে একটা পরীক্ষা ছিল। ছাত্রছাত্রীরা মাটি, বাঁশ-বেত ইত্যাদি নানান উপকরণ দিয়ে তৈরি শৈল্পিক কিছু করে নিয়ে যেত। যতদূর এটাও তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময়কার ঘটনা। বার্ষিক পরীক্ষায় আমি নিয়ে গেলাম সেলাইয়ের কাজ।” পরীক্ষায় তাকে আদৌ কোনো নম্বর দেওয়া হয়েছিল কি-না, এটা আর মনে করতে পারেন না আমিনুল। তবে মনে আছে এ জন্য বিদ্রূপ সইতে হয়েছিল।
ঘরে-বাইরে সর্বত্রই বিদ্রূপের তীব্র তীরে বিদ্ধ হয়েছেন আমিনুল। তার প্রধান ভরসা ছিলেন বাবা গোলাম কওছার আলী বিশ্বাস। নানান জনের নানা কথা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন বাবা। আরও একজনের কথা গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করেন আমিনুল, তিনি তার ভাবি ড. জুলিয়া মঈন। এই ভাবির কাছ থেকে বরাবরই উৎসাহ পেয়েছেন।
এক সময় গানও শিখতে চেয়েছিলেন এবং গানের শিক্ষক বুলবুল চৌধুরীর জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন একটি পাঞ্জাবি। সেটা পরে শিক্ষক এক অনুষ্ঠানে গেলে জেলা প্রশাসক পাঞ্জাবিটার প্রশংসা করে এটা কার তৈরি জানতে চান। জেলা প্রশাসককে বিশ্বাস করাতে সময় লেগেছে যে, সূচিকর্মের ওই পাঞ্জাবিটা কোনো ছাত্রীর নয়, একজন ছাত্রই করেছে। পরে অবশ্য আমিনুল ইসলামকে জেলা প্রশাসকের জন্যও একটা পাঞ্জাবি তৈরি করে দিতে হয়েছিল। ওই জেলা প্রশাসকের নাম এখন আর তার মনে নেই।
এভাবেই চলছিল জীবন। সূচিশিল্পে আমিনুলের পারঙ্গমতা প্রকাশ পাচ্ছিল। নিজের জন্য, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের জন্য কাজ করে দিচ্ছিলেন। এরই মধ্যে একদিন তার গানের শিক্ষক বললেন, ‘তুমি ঢাকায় যাও। গিয়ে দেখ আড়ং তোমাকে কোনো কাজ দেয় কি-না। ঢাকায় এই সব কাজের কদর পাবে। দেখবে একদিন তোমারও লাখ লাখ টাকা হবে।’
ঢাকায় আসেন আমিনুল। সেটা আশির দশকের শেষ দিককার কথা। থাকতেন মিরপুরে। আসা-যাওয়ার পথে দেখেন আড়ংয়ের সামনে হাতের কাজের সুন্দর সব পোশাক পরা ম্যানিকিন। একদিন সাহস করে গেলেন আড়ংয়ে কথা বলতে। ততদিনে তিনি মিরপুর ছেড়ে চলে এসেছেন উত্তরার ফায়দাবাদে। আড়ং আমিনুলকে ১০০টি ইয়ক এমব্রয়ডারির কাজ দিল। তখনও কাজগুলো সূচারুভাবে করার অনেক কৌশল অজানা ছিল তার। প্রথমবার তার কাজে সহযোগিতা করার জন্য খুঁজে পেলেন এক নারী সূচিশিল্পীকে। তার নাম জবেদা খাতুন। এই জবেদা খাতুন সেই নব্বুই সাল থেকে আছেন আমিনুলের কাজের সঙ্গে।
আমিনুল ইসলামের বাংলা সেলাই নামে প্রতিষ্ঠানের জন্ম হলো তখন থেকে। তিনি বললেন, প্রথম অর্ডারের কাজগুলো করার মতো টাকাটাও ছিল না তার হাতে। টাকা ধার দিয়েছিলেন এক বন্ধুর খালা ফজিলাতুন নেসা শিরি। ওই বন্ধুর খালাই এখন আমিনুলের খালা-শাশুড়ি। একজন কর্মী নিয়ে ছোট্ট পরিসরে গড়া সেই বাংলা সেলাই এখন এক বিরাট প্রতিষ্ঠান। দুই থেকে তিন হাজার নারী পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বাংলা সেলাইয়ের কর্মযজ্ঞে জড়িত আছেন। উত্তরার ফায়দাবাদে বাড়ি করেছেন আমিনুল। ছয়তলা ওই বাড়ির দুটি ফ্লোরে তিনি স্ত্রী সি্নগ্ধা ইসলাম এবং দুই সন্তান আকিক ও জয়ীকে নিয়ে বাস করেন। বাকিটাজুড়ে তার ওয়ার্কশপ ও অফিস। গ্রামের বাড়িতেও করেছেন সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেখানেও কাজ হয়। কাজ হয় ঝিনাইদহ শহরে আমিনুলের বন্ধু আবদুর রহিমের বাড়িতে। ওই বাড়িতে কাজ হয় আবদুর রহিমের স্ত্রী মনোয়ারা বেগমের তত্ত্বাবধানে। বাংলা সেলাইয়ের সেলাই কাজে যারা যুক্ত রয়েছেন, তাদের অনেকেই নিজেদের ঘরে বসেও কাজ করেন। কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আসেন। এক আড়ং দিয়ে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে দেশি-বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান।
আর্থিকভাবে থিতু হওয়ার পর আবারও গাছ নিয়ে ছোটবেলার অপূর্ণ শখটাকে পূর্ণ করায় মেতেছেন আমিনুল ইসলাম। ঢাকার বাড়ির ছাদে বাগান করেছেন। শুধু ছাদে নয়, তার বাড়ির ভেতরে গাছপালা এমনভাবে রাখা হয়েছে, মনেই হয় না, ইট-পাথরে এই নগরের একটি বাড়ি এটি। গ্রামে যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সেখানে তো অনেক জায়গা এবং সর্বত্রই আছে দুর্লভ সব গাছ। অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া_ যখন যেখানে গেছেন, সেখান থেকেই নিয়ে এসেছেন নানান গাছপালা।
গ্রামে আমিনুল ইসলামের গাছের বাড়ি দেখতে আসেন অনেকেই। তার বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে এসেছিলেন শৈলকূপা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সন্দ্বীপ কুমার সরকার। তিনি লিখে রেখে গেছেন, ‘আজ আমিনুল ইসলামের উদ্যোগে গ্রামের প্রবেশ পথ ও বাঁধের বিভিন্ন স্থানে কৃষ্ণচূড়া গাছ রোপণ করলাম। বৃক্ষ ও সৌন্দর্যপ্রেমী এই মানুষটির আগ্রহে ও উদ্যোগে আমি অভিভূত। একজন মানুষ তার স্বপ্ন নিয়ে নিজে, তার সঙ্গে এই গ্রামের মানুষগুলোকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। তার স্বপ্ন ও সৌন্দর্যবোধ সবাইকে স্পর্শ করুক।’