টানা বর্ষণ, উজানের ঢল ও জোয়ারের কারণে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ ও ভোলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। এসব জেলায় সাত লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। খাদ্য ও খাবার পানির অভাব ও গবাদি পশু নিয়ে তীব্র দুর্ভোগে পড়েছে এসব মানুষ। নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি গতকালও অব্যাহত ছিল। এর পাশাপাশি দেখা দিয়েছে তীব্র নদীভাঙন। মাদারীপুরে স্লাবধসে শহর রক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে।
কুড়িগ্রাম : টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামের নদ-নদীর পানি বাড়তে থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুধকুমোরে ২২ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। জেলার ৯টি উপজেলার আড়াই শতাধিক গ্রামের দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। তীব্র স্রোতে রৌমারী উপজেলার জিঞ্জিরাম নদীর ওপর খাটিয়ামারী স্লুইসগেটটি ভাঙনের মুখ পড়েছে। গত দুই দিনে বিভিন্ন এলাকায় ভাঙনের শিকার হয়েছে দুই শতাধিক পরিবার। কুড়িগ্রাম-যাত্রাপুর সড়কটি ভেঙে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও করতোয়া নদ-নদীর পানি আবারও বৃহস্পতিবার রাত থেকে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে গতকাল বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার এবং ঘাঘট তিন সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার সাতটি উপজেলার ৬২টি ইউনিয়নের ৩৫৩টি গ্রামে দুই সপ্তাহ ধরে পানিতে নিমজ্জিত। পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা আড়াই লাখ। বন্যায় ৩৯ হাজার ৪৪৮ হেক্টর জমির ফসল এখনো জলমগ্ন। নদীতীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে।
মাদারীপুর : আড়িয়াল খাঁ নদের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় মাদারীপুর শহর রক্ষা বাঁধসহ আশপাশের প্রায় ৫০টি বাড়িঘর ভাঙনের মুখে পড়েছে। ইতিমধ্যে লঞ্চঘাটের মূল পয়েন্টে শহর রক্ষা বাঁধের স্লাব নদে তলিয়ে গেছে। এলাকাবাসী সেখানে আরো বেশি পরিমাণে সিসি ব্লক ও জিও ব্যাগ ফেলার দাবি জানিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান জানান, শহর রক্ষা বাঁধের ভাঙা স্থান ইতিমধ্যে মেরামত করা হয়েছে। আরো সি সি ব্লক মজুদ আছে।
জামালপুর : জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এবং ৬০টি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে গতকাল দুপুরে যমুনা নদীর পানি পাঁচ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সারা জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। জেলার ইসলামপুর, সরিষাবাড়ী, মাদারগঞ্জ ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার এখন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি।
শেরপুর : পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের শেরপুর ফেরিঘাট পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সদর উপজেলার চরাঞ্চলে বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করেছে। ব্রহ্মপুত্র বাঁধের পুরনো ভাঙা অংশগুলো দিয়ে বন্যার পানি ঢুকে চরপক্ষামারী, চরমোচারিয়া, বেতমারী-ঘুঘুরাকান্দি ও বলাইরচর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার কয়েক হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি। ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধির ফলে শাখা নদী মৃগী ও দশানি নদীর পানিও বেড়েছে। গতকাল দুপুরে ২৪ ঘণ্টায় শেরপুর ফেরিঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চার সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ দশমিক ২১ মিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হয়।
সিরাজগঞ্জ : জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আবারও অবনতির দিকে যাচ্ছে। কাজীপুর, বেলকুচি, চৌহালী ও সদর উপজেলার ২৯টি ইউনিয়নের অন্তত ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দি। শাহজাদপুর উপজেলার রেশমবাড়ী প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতির সদস্য সামাদ ফকির জানান, গোচারণ ভূমি ডুবে যাওয়ায় শত শত খামারি প্রায় দুই লক্ষাধিক গরু নিয়ে বিপাকে পড়েছে। যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে গতকাল বিকেলে বিপৎসীমার ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
ভোলা : পূর্ণিমার প্রভাবে সৃষ্ট অস্বাভাবিক জোয়ারে এবং দুই দিনের ভারি বর্ষণের ফলে গতকাল বৃহস্পতিবারও ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সদর উপজেলা, বোরহানউদ্দিন, দৌলতখান, চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলার নদীতীরবর্তী প্রায় ৪০টি গ্রাম ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে অন্তত দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সদর উপজেলার ইলিশা ও রাজাপুর ইউনিয়নের মেঘনাপাড়ে সরেজমিনে গেলে রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দারা জানায়, মেঘনা নদীর ভাঙনে মাত্র দুই সপ্তাহে প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকার সহস্রাধিক ঘরবাড়ি, দুটি মসজিদ, পাঁচটি মক্তব, পুলিশ ফাঁড়ি, ইসলামিক মিশন, ৩০০ একর ফসলি জমি, দুই শতাধিক ব্যবসায়ী দোকানসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দুই শতাধিক পুকুর ও শতাধিক ঘেরের মাছ এবং অন্তত ১০০ গবাদি পশু ভেসে গেছে।