হাওর বার্তা ডেস্কঃ পর পর দু’দফা বন্যায় বোরো ফসল হারিয়ে হতাশাগ্রস্থ চকরিয়া উপজেলার কৃষক-কৃষাণীর মুখে হাসি ফিরিয়েছে আমন ধান। বন্যা পরবর্তী কৃষকরা আমন চাষে মনোযোগী হওয়ায় ও প্রকৃতির আনুকূল্য পাওয়ায় এবার আমনের ফলণ ভালো হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে সোনালি আমন ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কৃষাণ-কৃষাণীরা। আনন্দ আর উৎসাহ নিয়ে আমন ধান কাটা চলছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা, ধানের চিঠাসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ এবার আমন ফসলের মাঠে হানা না দেওয়ায় বছরান্তে চাল কিনে খাওয়ার হতাশা অনেকটা কাটতে শুরু করেছে।
উপজেলার সর্বত্র এখন আমন ফসলের মাঠে পাকা ধানের সোনালি হাসি। অগ্রহায়ণের উজ্জ্বল রোদে সেই হাসি আরও ঝলমল করছে। এতদঞ্চলের আকাশে-বাতাসে এখন নতুন ধানের গন্ধ, গ্রামে-গ্রামে নবান্নের সাজ সাজ রব। মাঠে মাঠে কৃষকেরা কাস্তে নিয়ে ধান কাটার উৎসবে নেমে পড়েছেন। শীতের সকাল থেকে শুরু করে পড়ন্ত বিকেল পর্যন্ত মাঠে-মাঠে ফসল কর্তনের চিরাচরিত দৃশ্য এখন সর্বত্র। ধান মাড়াই, বাছাই আর শুকানোর কাজে এখন মহাব্যস্ত এখানকার সব কৃষক পরিবার। অতীতের চেয়ে লক্ষ্যমাত্রার অধিক জমিতে সোনা রাঙা আমন ধানের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে কিছুটা হলেও হাসি ফুটেছে এবার। কেননা এ বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে একাধিকবার ফসল বিনষ্ট হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে। এরপর সাম্প্রতিক আবহাওয়া ও পরিবেশ অনুকূল থাকায় এবার ধানের ফলন ভালো হয়েছে। এতে কৃষকের মন ভরছে ঠিকই। কিন্তু তা বেশিক্ষণ তাদের পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ তাদের উৎপাদন খরচই মিলছেনা এমনতর অভিযোগ পাওয়া গেছে উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ও কৃষকের সাথে কথা বলে।
কক্সবাজার জেলায় কৃষিক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় ও খাদ্য উদ্বৃত্ত এলাকা হিসাবে খ্যাত চকরিয়া উপজেলা। মাত্র ৬৪৩.৪৬ বর্গ কিঃমিঃ এলাকায় ৫ লক্ষাধিক বিশাল জনগোষ্ঠীর বসবাস এই চকরিয়ায়। এখানে প্রায় ৬৪২৬৬টি পরিবার সরাসরি কৃষিখাতে জড়িত। তৎমধ্যে ২৫১৬৬ পরিবার ভূমিহীন ,২৪০০০ পরিবার প্রান্তিক, ১০০০ পরিবার ক্ষুদ্র, ৪০০০ পরিবার মাঝারি ও ১১০০ বড় আকারের কৃষক পরিবার রয়েছে।
এখানে খুচরা সার বিক্রেতার সংখ্যা ১৪৮ জন, কীটনাশক বিক্রেতার সংখ্যা ২৩৬ জন ও বীজ ডিলারের সংখ্যা ৫জন। মোট খাদ্যচাহিদা ৬৮৯১৪ মেঃটন। মোট খাদ্য উৎপাদন ১৪১৭৯৭ মেঃটন।বীজ ও গো খাদ্য অপচয় ১৬৪২০ মেঃটন। প্রকৃত খাদ্য উৎপাদন ১৪১৭৯৭ মেঃটন।খাদ্য উদ্বৃত্ত্ব(+)ঘাটতি(-)৫৬৪৬৩ মেঃটন।
চকরিয়া উপজেলার কৃষিজমির পরিমাণ
১) মোট চাষযোগ্য জমি ২২২২৩ হেক্টর ২) নীট ফসলি জমি ২২২২৩ হেক্টর ৩) এক ফসলী জমি ১৪৫৯.২০ হেক্টর ৪) দুই ফসলী জমি ২৪৯৯৯.৮৮ হেক্টর ৫) তিন ফসলী জমি ১৯২৯২.৭০ হেক্টর ৬) মোট ফসলী জমি ২২২২৩ হেক্টর ৭) ফসলের নিবিড়তা (%)২৪১% ৮) জমি ব্যাবহারের নিবিড়তা (%)২৬% ৯) চিংড়িঘের চাষ এলাকা ৮৪৩৩ হেক্টর।
চকরিয়া উপজেলা তরিতরকারি তথা সবজি চাষের জন্য বিখ্যাত, এখানে প্রচুর পরিমাণে গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন সবজি উৎপাদিত হয়।প্রতিবছর চট্রগ্রাম, ঢাকা সহ দেশের বিভিন্নস্থানের সবজি ও তরি-তরকারীর চাহিদা চকরিয়ায় উৎপাদিত সবজি ও শস্য হতে মেটানো হয়।সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি চকরিয়ায় ধানের উৎপাদন ও বেশ ভাল হয়। মৌসুমের ভিত্তিতে প্রতিবছরে ধান আবাদের পরিমাণ ও উৎপাদনের মৌসুম জমির পরিমাণ প্রতি হেক্টরে আউশ ১৫৫৭, ৪১৫৭ মেঃটন ধান উৎপাদিত হয়। আমন উৎপাদিত হয় প্রতি হেক্টর জমিতে ১৯০০০,৬৩০৫০ মেঃটন। বোরো উৎপাদিত হয় প্রতি হেক্টর জমিতে ১৭০০০,৭৪৫৯৫ মেঃটন।
অন্যান্য উপজেলার ন্যায় চকরিয়া উপজেলা প্রাকৃতিক দূর্যোগের কবলে পড়ে। বিশেষকরে মাতামহুরী নদীতে যখন বন্যা নেমে আসে তখন ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি লক্ষ করা যায়। এখানে বন্যা উপদ্রূত এলাকায় ১২২৮০ হেক্টর, বন্যামুক্ত এলাকা ৯৯৪৩ হেক্টর, খরা উপদ্রূত এলাকা ১৪৫০ হেক্টর, খরামুক্ত এলাকা ২০৭৬৮ হেক্টর জমিতে কৃষি চাষ হয়ে থাকে। চকরিয়া কৃষিজমি উর্বর হওয়া সত্ত্বেও আশানরূপ ফলন উৎপাদন হচ্ছেনা, কারণ যারা কৃষকাজে জড়িত বলতে গেলে প্রায় অশিক্ষিত এবং অধিকাংশ কৃষকদের মধ্যে কৃষি সম্পর্কিত জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর কৃষি বিষয়ক তথ্য প্রদানের জন্য সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে, কিন্তুু অনেক কৃষকই অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মনগড়া কৃষিকার্য পরিচালনা করে থাকে যার দরুণ বাম্পার ফলন হচ্ছেনা। তাই কৃষিক্ষেত্রে সাফল্য পেতে হলে আমাদেরকে প্রচুর পরিমাণে কৃষি বিষয়ক সেমিনারের আয়োজন করতে হবে ও মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। অনাবাদকৃত জমিকে চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত করতে হবে এবং সেচের আওতায় বৃদ্ধি করতে হবে।
স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চাষাবাদ কমেছে। তবে এবার ধানের উৎপাদন তুলনামূলক ভালো হয়েছে। ধানে পোকার আক্রমণ না হওয়া, জমিতে সুষম সার ব্যবহারে কৃষকের দক্ষতা বৃদ্ধির কারণে উৎপাদনে কিছুটা সুফল মিলেছে। একই কথা কৃষকদেরও। মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ভালো ফলন আর কৃষকের মুখে হাসির ঝিলিক দেখা গেছে। যেদিকে চোখ যায়, আমন ধানের পাকধরা বিস্তৃত সোনালি রঙের ঢেউ।অনেকে উৎসবের আনন্দে ধান কাটতে শুরু করেছেন।
যখনই উৎপাদন খরচের প্রসঙ্গটি আসছে তখনই তাদের মন ভারী হয়ে উঠে। উপজেলার কিছু পতিত জমি দেখিয়ে বেশ কয়েকজন কৃষক জানালেন, ধান উৎপাদন করে প্রকৃত খরচটাই তোলা যায় না বলে অনেকে চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। ভবিষ্যতে এ রকম পতিত জমির পরিমাণ বাড়বে।
মাঠে ধান কাটতে আসা কৃষক বলেন, এখন যে অবস্থা চাষ করে জমি বিক্রি করে সংসার চালাতে হবে। তিনি আরো জানান, তার এক কানি জমিতে প্রায় ১৬হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এখন এই ১ কানির জমি থেকে খরচের টাকা তোলাই কঠিন হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, এবার ফলন আশানুরূপ না হলেও মোটামুটি ভালা হইছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আতিক উদ্দিন জানান, উপজেলার আবাদকৃত জমিতে নতুন জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এবার ব্রি ধান এর বাম্পার ফলনে কৃষকরা আগামীতে এই জাতের ধান চাষ করতে আরও আগ্রহী হবেন বলে আশাবাদী কৃষি অফিস। তবে উপজেলায় রোপা আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও কিন্তু আবাদ হয়েছে কম।