বাঘ শিকারীরা বাঘ ও হরিণ শিকারে সাধারণত ৩ ধরণের ফাঁদ ব্যবহার করে। এরমধ্যে অন্যতম হলো ‘বিষ টোপ’। বিষ টোপ হলো হরিণ বা ছাগলকে বিষ অথবা চেতনানাশক দিয়ে ‘টোপ’ হিসেবে ব্যবহার করে বাঘ শিকার করা। যেমন একটি জীবিত ছাগলের শরীরের বহিরাংশে বিষ মেখে সে ছাগলকে বনের ভিতরে বাঘের বিচরণ পথে বাচলাচলের রাস্তায় বেঁধে রাখা হয়। একটি সময়ে বাঘ শিকারে প্রলুব্ধ হয় এবং সহজলভ্য শিকারের জন্য ছাগলের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ছাগলের বিষক্রিয়ার মারা যায়।
এছাড়া হরিণকেও বিষটোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই বিষটোপ সুন্দরবনের প্রাণী নিধনে বহুল পরিচিত একটি পদ্ধতি।স্থানীয়দের মতে, বাঘ বা হরিণ শিকারের আরেকটি পরিচিত কৌশল হলো বনের মধ্যে জাল দিয়ে ব্যারিকেড তৈরী যা স্থানীয়ভাবে ‘দেওয়ান ফাঁদ’ নামে পরিচিত। খুবই শক্ত নাইলনের সুতা দিয়ে তৈরী এই জালঞ্চ বিশেষ ব্যবস্থায় বনের মধ্যে পেতে রাখা হয়। প্রায় অদৃশ্য জালটি এমনভাবে ফাঁদ হিসেবে পেতে রাখা হয় যে এই ফাঁদ ফাঁকি দেয়া প্রাণীদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এই জালে হরিণ শিকার অপেক্ষাকৃত সহজ হলেও হিংস্র বাঘও আটকা পড়ে এই ফাঁদে। বাঘ বা হরিণ যাই হোক ফাঁদে একবার আটকা পড়লে রেহাই নেই। আটকা পড়া হরিণ ফাঁদের জালে জড়িয়ে গেলে সহজেই ধরে ফেলে শিকারীরা।
আর হিংস্র্র বাঘ জালে জড়িয়ে গেলে একসময় দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন ট্রাঙ্কুলাইজিং-এর মাধ্যমে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা অথবা চেতনানাশক দিয়ে অজ্ঞান করে পরে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। পরবর্তীতে তার চামড়া এবং অন্যান্য অংশ বিশেষ পদ্ধতি প্রক্রিয়াকরণ করে পাচার করে।‘সিটকা কল’ বাঘ বা হরিণ শিকারে আরেকটি স্থানীয় অথচ অভিনব পন্থা। সম্পূর্ণ স্থানীয় জ্ঞানে উদ্ভাবিত এই ‘সিটকা কল’ দিয়ে বাঘ-হরিণ শিকার করলে তা’ জীবিত পাওয়া যায় না। কলটি তৈরীর কৌশল এরকম- সুন্দরবনের কোন একটি সরু এবং খুব শক্ত অথচ সহজে বেঁকে যায় বা ব্যান্ড করা যায় এমন গাছ দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় ‘সিটকা কল’ তৈরী করা হয়।
এই কলে পা পড়লেই প্রচন্ড বেগে ব্যান্ড করা গাছটি সজোরে প্রাণীটিকে আঘাত করে এবং প্রাণীটি পরবর্তীতে মারা যায়।সূত্রের অভিমত উপরোক্ত প্রক্রিয়া ছাড়াও অনেক সময় শিকারীরা ভরা গোণের (অমাবশ্যা-পূর্ণিমা) উচ্চ জোয়ারের সুযোগ নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হরিণ শিকার করে। উচ্চ জোয়ারে বনের অভ্যন্তরে পানি চাপে শুকনা জায়গার অভাব দেখা দেয়। হরিণ তখন অপেক্ষাকৃত উচু জায়গায় আশ্রয় নেয়। শিকারীরা এই সুযোগে নৌকায় করে সীমাবদ্ধ স্থানে আটকা পড়া হরিণ লাঠি দিয়ে পিটিয়ে অথবা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
সুন্দরবন সন্নিহিত গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে আরও জানা যায়, শিকারীরা বাঘ-হরিণ হত্যায় এখন আর বন্দুক ব্যবহার করে না। কারণ এতে শিকারকৃত প্রাণীর চামড়ার বিক্রয়মূল্য কমে যায়। এ জন্য তারা আগ্নেয়াস্ত্র এড়িয়ে নানা ধরনের ফাঁদ এবং কৌশল প্রয়োগ করে বন্য প্রাণী হত্যা করে থাকে। সূত্র বলছে, বাঘ-হরিণ হত্যায় আরও অভিনব কোন পদ্ধতি থাকতে পারে। শিকারকৃত বন্য প্রাণী কিভাবে গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হয় সে ব্যাপারে সূত্রের তথ্য, সাধারণত বাঘ বা হরিণের মাংস, চামড়া, হাড় বা অন্যান্য দেহের অংশ ট্রলারযোগে মাছের ড্রাম এবং ট্রলারের তলদেশে বরফ দিয়ে উপজেলা সদরের স্থলভাগে নিয়ে আসা হয়। যেখান থেকে হাত বদল হয়ে ব্যাগে করে মটর সাইকেলযোগে অথবা নৌযানযোগে অথবা স্থলপথে অন্য কোন মাধ্যমে জেলা শহরে আনা হয়। পরবর্তীতে কয়েক হাতে ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছানো হয়। এ কাজে মাছের ট্রলার এবং জেলেদের সহায়তা অনেক সময় থাকে বলে সূত্র জানায়।
উল্লেখ্য, একই পদ্ধতিতে পাচারকালে কিছুদিন পূর্বে খুলনা থেকে ৩টি বাঘের চামড়া ও প্রচুর পরিমাণে বাঘের হাড়গোড় পুলিশ তা’ উদ্ধার করে। এর ক’দিন পর আরও ১টি বাঘের চামড়া খুলনা থেকে পুলিশ উদ্ধার করে। এছাড়াও মাসখানেক পূর্বে দাকোপের কালাবগীর এক ব্যক্তিরঞ্চ লেট্রিন থেকে ৩টি বাঘের হাড় পুলিশ কর্তৃক উদ্ধার হয়। সুন্দরবন হতে বাঘ-হরিণের চামড়া, হাড়, মাংস ইত্যাদি সংগৃহীত হয়ে দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছা, মোংলা হয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে পাচারের উদ্দেশ্যে ‘ট্রানজিট রুট’ হিসেবে খুলনাকে ব্যবহার করা হয়- উল্লেখিত ঘটনাগুলো তারই প্রমাণ। পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত, খুলনা বিভাগীয় শহর হিসেবে দেশের বিভিন্নস্থানে যাতায়াতের সকল মাধ্যম এখানে সহজলভ্য। সে কারণে পাচারকারী সিন্ডিকেটের উইং খুলনায় বসে তাবৎ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে-এমনটিই ধারণা করা হয়।