হাওর বার্তা ডেস্কঃ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে ও সংকটের স্থায়ী সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের প্রধান শর্তগুলোর একটিও নেই। এর মধ্যে মিয়ানমার কত দিনের মধ্যে এবং কতজন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে, সেটির যেমন উল্লেখ নেই; তেমনি ফেরত প্রক্রিয়ার সঙ্গে কোনো তৃতীয় পক্ষকে রাখেনি দেশটি। বাংলাদেশের দাবি ছিল, শরণার্থী ক্যাম্পে নয়; ফেরত নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে বাড়িঘর তৈরি করে রাখতে হবে। সে ব্যাপারেও সমঝোতা স্মারকে কিছু উল্লেখ নেই। বরং মিয়ানমার পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য শরণার্থী ক্যাম্প তৈরি করছে।
রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশের নতুন চুক্তির শর্তও মানেনি মিয়ানমার। বাংলাদেশ বলে আসছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতি আর ১৯৯২ সাল এক নয়। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অধিকাংশেরই কোনো পরিচয়পত্র নেই। হাতেগোনা কিছু রোহিঙ্গার কাছে ‘সাদা রঙের’ যে পরিচয়পত্র ছিল, ২০১৫ সালে নির্বাচনের পর সেটির মেয়াদও বাতিল করা হয়েছে। অথচ স্মারকে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ১৯৯২ সালের চুক্তিকেই মানদন্ড হিসেবে রেখেছে মিয়ানমার।
গত বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে দেশটির স্টেট কাউন্সেলরের দফতরের মন্ত্রী চ টিন্ট সোয়ে ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে এই সমঝোতা স্মারকে সই করেন। স্বাক্ষর শেষে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের জানান, তিন মাসের মধ্যে ফেরত পাঠানো প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে অং সান সু চির দফতরের ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে, রাখাইনের বাস্তুচ্যুত লোকজনকে ফিরিয়ে আনতে নিয়মতান্ত্রিক ব্যাপারে তাদের পরিচয় যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ১৯৯২ সালের চুক্তির আলোকে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে।
সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর বিশ্বজুড়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। স্মারকের ভালো-মন্দ দিক তুলে ধরেন দেশ-বিদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও নানাভাবে বিশ্লেষণ করে স্মারকটির। প্রতিক্রিয়া জানায় আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ বিভিন্ন দেশ। এতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
সমঝোতা স্মারক নিয়ে কথা বলেছেন দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক, সাবেক কূটনীতিক ও রোহিঙ্গা গবেষকরাও। সমঝোতা স্মারককে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখলেও সংকট সমাধানে ‘টেকসই’ নয় বলে জানিয়েছেন তারা। তাদের মতে, স্মারকে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত গুরুত্বপূর্ণ শর্তগুলো না থাকায় সংকট সমাধান প্রলম্বিত হবে। তবে মিয়ানমার যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে, সেটি ‘শুভ লক্ষণ’ এবং বাংলাদেশের ‘কূটনৈতিক সাফল্য’ বলেও মনে করেন তারা। তারা বলেন, এখন সমঝোতা স্মারককে ধরে বাংলাদেশকে সামনে এগোতে হবে এবং স্মারক বাস্তবায়নে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।
এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক এম হুমায়ূন কবীর বলেন, একটি চুক্তি হয়েছে। এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে পারি। কিন্তু কীভাবে বাস্তবায়ন হবে ও বাস্তবায়নে মিয়ানমার কীভাবে আশ্বস্ত করবে, তার ওপর সমঝোতা স্মারকের সফলতা নির্ভর করছে। এই স্মারককে টেকসই ও বাস্তবায়ন করতে হলে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তবেই সমাধান হতে পারে। সে পথে গেলে সংকট সমাধানে মিয়ানমারের সদিচ্ছা প্রকাশ পাবে। ‘দুই দেশ একটি সমঝোতায় পৌঁছেছে। এখন সেটা কীভাবে বাস্তবায়নযোগ্য করব, কীভাবে লক্ষ্যের দিকে পৌঁছাব, সেটাই বিবেচ্য বিষয়’-বলেও মত দেন এই সাবেক কূটনীতিক।
সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হওয়া ও জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে মিয়ানমার যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে, তা ইতিবাচক বলে মনে করেন মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই উদ্যোগ বাংলাদেশের কূটনৈতিক অর্জন বটে। শুভ লক্ষণ। সংকট সমাধানে সমঝোতায় পৌঁছতে পেরেছি। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক তৎপরতা, বিশ্ব সম্প্রদায়কে পক্ষে এনে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার ফলে। আন্তর্জাতিক চাপ মিয়ানমারকে ভয়ের মধ্যে ফেলেছে।
‘তবে এ ধরনের সমঝোতা সংকট সমাধানকে দীর্ঘসূত্রতা করার পথ’ বলেও মনে করেন এই সাবেক কূটনীতিক। তিনি বলেন, স্বাক্ষর হওয়া সমঝোতা স্মারকে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয়ই নেই। এগুলো হলো কত দিনের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া হবে ও কতজনকে ফেরত নেবে-এ ব্যাপারে কোনো উল্লেখ নেই। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে তৃতীয় পক্ষকেও রাখা হয়নি। ফলে সংকট সমাধানে মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। এই সমঝোতা স্মারক সত্যিকার অর্থেই বাস্তবায়ন করতে হলে তৃতীয় পক্ষকে রাখতেই হবে। কারণ ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের খাদ্য, বাসস্থান ও নিরাপত্তাসহ নানা সহযোগিতার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা লাগবে। এ ধরনের কাজে বিশ্বজুড়ে তৃতীয় পক্ষকে রাখার নিয়ম রয়েছে।
তৃতীয় পক্ষকে রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে এই সাবেক কূটনীতিক বলেন, সমঝোতা স্মারক ও পরবর্তীতে গঠন হওয়া জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ ঠিকমতো কাজ করছে কি না, এ ব্যাপারে কোনো পক্ষের কোনো অভিযোগ আছে কি না-এসব যাচাই-বাছাই করতে এবং সার্বিক কর্মকান্ড মনিটরিং করার জন্য তৃতীয় পক্ষকে রাখতে হবে। এটি আন্তর্জাতিক আইন। সব দেশে হয়। সংশ্লিষ্ট দেশগুলো চাপে থাকে। রোহিঙ্গাদের দ্রুত নিরাপদে ফেরত নিতে হবে। প্রলম্বিত হলে মিয়ানমার আরো একটি ২৫ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে এবং রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখাতে পারে। সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
‘এসব শর্ত সমঝোতা স্মারকে চলে এলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া প্রলম্বিত হতো না। এখনো সুযোগ রয়েছে। তবে সময় লাগবে। বিশেষ করে মিয়ানমারকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতেই হবে। এই লোকগুলো কি দিয়ে প্রমাণ করবে যে তারা নাগরিক? তাদের তো নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতিই দেয়নি মিয়ানমার সরকার। ১৯৯১ সাল থেকে জন্মসনদও বাতিল করা হয়েছে’-উল্লেখ করেন মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম।
যে সমঝোতা স্মারক হয়েছে সেটি টেকসই নয় বলে উল্লেখ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও রোহিঙ্গা গবেষক অধ্যাপক জাকির হোসেন। তার মতে, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ওপর যে বর্বর নির্যাতন চালিয়েছে, সেটিকে জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায় ও সংস্থা জাতিগত নিধন বলছে। এর জন্য তাদের শাস্তি পেতে হতে পারে। তা ছাড়া যে আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রয়েছে, সেটিও একটি ভয়ের কারণ। এমনকি মিত্র চীনও গোপন বৈঠক করে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বলেছে। সুতরাং এসব চাপ প্রশমন করতে এবং দৃষ্টি অন্যত্র সরাতে মিয়ানমার এমন সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সংকট সমাধানে দেশটির সদিচ্ছা প্রকাশ পায়নি।
এখন বাংলাদেশের করণীয় কী-জানতে চাইলে এই গবেষক বলেন, শিগগিরই বাংলাদেশ এ সংকট থেকে মুক্তি পাবে না। এখন এই সমঝোতা স্মারককে ধরে বাংলাদেশকে সামনে এগোতে হবে এবং সমঝোতা স্মারক বাস্তবায়নে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে এই স্মারককে টেকসই করতে হবে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির কারণেই বাংলাদেশ সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে না। সুতরাং বাংলাদেশকে ধৈর্য ধরে থাকতে হবে।
এই গবেষক বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে, সেগুলোর একটিও মিয়ানমার সমঝোতা স্মারকে মেনে নেয়নি। এর মধ্যে মিয়ানমার কত রোহিঙ্গা ফেরত নেবে, কত দিনের মধ্যে নেবে, ফেরত নেওয়ার পর কোথায় রাখবে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সংকটের স্থায়ী সমাধানে তৃতীয় পক্ষকে যুক্ত রাখা হবে কি না; এসবের কিছুই সমঝোতা স্মারকে নেই। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বারবার বলা সত্ত্বেও মিয়ানমার এসব মানেনি। ফলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের সদিচ্ছা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। যদি সদিচ্ছা থাকত তাহলে তৃতীয় পক্ষকে রাখত।
তৃতীয় পক্ষকে রাখা দরকার-উল্লেখ করে এই গবেষক বলেন, ফেরত নেওয়ার পর এসব রোহিঙ্গার খাদ্য, বাড়িঘর তৈরি ও নিরাপত্তাসহ নানা ধরনের সহযোগিতা দরকার। বিশেষ করে নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে তৃতীয় পক্ষকে দরকার। কারণ মিয়ানমার সরকার এটি করবে না বলেই যে লোকগুলোর নাগরিকত্বই দেওয়া হয়নি, তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ চাইছে।
‘মিয়ানমার যদি সত্যি রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চায়, তাহলে নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে এবং নিরাপত্তা দিতে হবে। এসব রোহিঙ্গার জন্য শরণার্থী ক্যাম্প তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে রাখা যাবে না। নিজ ভূমিতে বাড়িঘর তৈরি করে রাখতে হবে’-মত দেন অধ্যাপক জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ফেরত নেওয়ার পর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে এসব রোহিঙ্গা পুনরায় ফিরে আসবে। অতীতে এমন হয়েছে।