নিজে গুম-খুন হতে পারেন, এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে দেশের সব গুমের ঘটনার জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু তদন্ত হবে না, তারা তা করবেও না। সেজন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি করতে হবে। কমিটিতে দেশের নিরপেক্ষ তদন্তকারীদেরও রাখতে হবে।’
বিশ্ব গুম দিবস উপলক্ষে রোববার সন্ধ্যায় বিএনপি নেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি এ দাবি তোলেন। দেশে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সহমর্মিতা জানাতে ‘অনন্ত অপেক্ষা… বাংলাদেশে গুম ২০০৯-২০১৫’ শিরোনামে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিকেল সাড়ে ৫টায় কার্যালয়ে উপস্থিত হন। গুমের শিকার হওয়া ২৬ ব্যক্তির পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা গুলশান কার্যালয়ের ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। এর আগে গুম বিষয়ক একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘যারা গুম হয়েছে, তাদের সান্ত্বনা দিতে পারি, আশ্বাস দিতে পারি; কিন্ত এর বেশি আমাদের কিছু করার নেই। জানি না, আমরাও এমন থাকব কি না, গুম বা খুন হবো কি না। আল্লাহ তায়ালা জানেন, তার ওপর ভরসা করেই চলি।’
সরকার বিএনপির তরুণ ও মেধাবী নেতা-কর্মীদের বেছে বেছে গুম করছে বলেও অভিযোগ করেন এই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী।
এই সরকারের সময়েই প্রথম দেশে গুমের ঘটনা শুরু হয়েছে, দাবি করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘এর আগে গুমের ঘটনা ছিল না। র্যাব-পুলিশ সরকারের নির্দেশ ছাড়া গুম-খুন করতে পাওে না। অবশ্যই অন্যায়ের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দিতে হবে।’
ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে বিএনপি প্রধান বলেন, ‘গুম হওয়া ব্যক্তিরা কেমন আছে জানি না। একদিন না একদিন এর বিচার হবে। যারা অন্যায়-অবিচার করেছে তাদের প্রত্যেকের শাস্তি হবে। স্বজনহারারা অন্তত জানতে পারবেন তাদের ছেলেদের কীভাবে কী করা হয়েছে। তাদের যদি মরদেহও পাওয়া যায় তবুও সান্ত্বনা পাবেন। আমরা সেই কাজই করব।’
বিশ্ব গুম দিবস সরকারিভাবে পালন করা হচ্ছে না কেন, এ প্রশ্ন তুলে বিএনপির নেত্রী বলেন, ‘সরকার কেন বিশ্ব গুম দিবস পালন করছে না। তারা গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত। সেজন্য ভয়, লজ্জা পেয়ে গুম দিবস পালন করছে না।’
দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাস, খুন-গুম চলছে। খবরের কাগজ খুললেই খুন, গুম, নারী নির্যাতন। এর সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ জড়িত। তারা তাদের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পাওে না। দেশে গণতন্ত্র নেই, মৌলিক অধিকার নেই, কারো কোনো অনুষ্ঠান করারও অধিকার নেই। শুধু যারা জোর করে ক্ষমতায় আছে, তারাই করতে পারবে।’
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সরকারবিরোধী আন্দোলনে সৃষ্ট নাশকতার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দায়ী করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘মানুষকে বিভ্রান্ত করতে এবং আন্দোলনকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার জন্য তারাই (আওয়ামী লীগ) নাশকতা করেছে। পুলিশও এটা স্বীকার করেছে যে, তারা নাশকতা করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা প্রেট্রোল বোমাসহ ধরা পড়েছে। কিন্তু তাদের গ্রেফতার করা হয়নি। তাদের না ধরে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।’
গুম হওয়াদের স্বজনরা যা বললেন :
বিএনপি নেত্রী বক্তব্য দেওয়ার আগে ভুক্তভোগী পরিবারের স্বজনরা তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেন।
নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহমিনা রুশদীর লুনা বলেন, ‘তিন বছর পার হলেও তার (ইলিয়াস আলী) কোনো খোঁজ মেলেনি। সবসময় শাশুড়ি জানতে চায়। মেয়েটি বাবা কবে আসবে- সেই প্রশ্ন করে। উত্তর দিতে পারি না। একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছি, তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। সরকারের কাছে বলব, আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিন।’
ছাত্রদল নেতা নিজাম উদ্দিন মুন্নার বাবা মো. শামসুদ্দিন জানান, ছেলেকে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। বিমানবন্দর এলাকার পুলিশের থেকে তথ্য পেয়ে চুয়াডাঙ্গার কয়েকটি হাসপাতালে খুঁজেও তার কোনো হদিস মেলেনি। রোগী আছে, লাশ আছে, কিন্ত ছেলে নেই।
ভাই গুম হওয়ার পর স্বাধীন দেশে নিজের নাগরিক অধিকার আছে কিনা, এ প্রশ্ন তুলে ছাত্রদল নেতা সুমনের বোন মারুফা ইসলাম বলেন, ‘দরজায় দরজায় গিয়েছি কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। স্বাধীন দেশের নাগরিকের অধিকার ভুলে যাই। এই বিষয়গুলো খুবই কষ্টের।’
ভাইকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার কথা বলেন সুমনের আরেক বোন সানজিদা আক্তার তুলি।
গুম হওয়া ছাত্রদল নেতা রাসেলের বোন লাবনী আক্তার বলেন, ‘প্রতিটি দিন আশা নিয়ে থাকি। প্রতিটি মুহূর্ত যে কতটা বেদনাদায়ক তা কেউ বোঝে না।’
সেলিম রেজার বোন রেহেনা বানু মুন্নী তার গুম হয়ে যাওয়া ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, ‘অপক্ষোয় আছি কখন ভাইকে ফেরত পাব। আমরা পাথরের টুকরো হয়ে গেছি। কোনো অনুভূতি নেই। সামনে থেকে গুম-খুন হচ্ছে কেউ কিছুু বলছে না। সবার অনুভূতি নষ্ট হয়ে গেছে।’
এ ছাড়া ছাত্রদল নেতা মাহবুব হাসানের স্ত্রী তানজিনা আক্তার, যুবদল নেতা ইকবাল মাহমুদ জুয়েলের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম, ছাত্রদল নেতা খালিদ হাসানের স্ত্রী সৈয়দা শাম্মী সুলতানা, মাহফুজুর রহমান সোহেলের বাবা শামসুর রহমান, স্বেচ্ছ সেবক দলের নেতা এ এম আদনান চৌধুরীর বাবা রুহুল আমিন চৌধুরী, হুমায়ুন কবির পারভেজের স্ত্রী শাহানা আক্তার তাদের বেদনা ও ক্ষোভের কথা জানান।
অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতাদের মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, মাহবুবুর রহমান, নজরুল ইসলাম খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল নোমান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, আহমদ আযম খান, যুগ্ম-মহাসচিব মো. শাহজাহান, বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল, সাংবাদিক শফিক রেহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।