ঢাকা ০৩:৩৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বৃক্ষরোপণে বাংলাদেশ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৮:০২:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ অগাস্ট ২০১৫
  • ৩৪৩ বার

নদীবিধৌত পলিভূমি বাংলাদেশ একসময় ছিল গ্রামভিত্তিক ও কৃষি নির্ভর। সে সময় আমাদের গ্রামগুলো বনবাদাড়ে ঘেরা ছিল। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির আশপাশে ছিল ফসলি জমি। বাড়ির একটা অংশ জুড়ে থাকত আম,জাম, কাঁঠাল, বাতাবিলেবু, পেয়ারাসহ বারো মাসের রকমারি ফলের গাছ। বনবাদাড়ে ছিল করমচা, লটকন, গাবসহ আরও অসংখ্য দেশি প্রজাতির গাছ। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ দেশ এমনই সোনাফলা যে অনাদর-অবহেলায় পড়ে থাকা ভূমিতে সকলের অগোচরে জন্ম নেয় বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন তরুলতা, বৃক্ষ। কারো পরিচর্যায় নয় বরং গাছ থেকে বীজ পড়ে বর্ষার জলমগ্ন পরিবেশে অসংখ্য চারায় ভরে ওঠে পতিত জমি। এমনি করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রকমারি বনজ-ফলদ বৃক্ষের সমারোহে পরিপূর্ণ একেকটি এলাকা এক সময় গ্রামীণ বনভূমি হিসেবে নিজস্ব রূপ নেয়।

বর্তমানে সময়ের সাথে সাথে মানুষের চাহিদা বাড়ছে। এখন আর আগের মতো কৃষিজমি নেই। বাড়ির পাশের জমিতে পিতার পূর্বপুরুষের স্মৃতি জড়ানো ছায়াশোভিত আম-কাঁঠালের বাগান আর নেই। ওসব জমি এখন দালান-কোঠার দখলে। মেহগনি কাঁঠালের লগ এখন দরজা জানালার কপাট। ঝোঁপঝাড় আর অজানা গাছের জঙ্গল এখন উনুনের গ্রাসে। গ্রামীণ বনভূমির কাঠ এখন ইটের ভাঁটায় পুড়ে কয়লা। চারিদিকে নগর জীবনের নাভিশ্বাস, প্রকৃতিতে বাড়ছে গরমের মাত্রা। হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের স্বস্তিময় স্বাভাবিক জীবনের আয়েশ।

সভ্যতার নানা আয়োজনে আমাদের ভোগবিলাসিতা যতই বাড়ছে নতুন নতুন কলকারখানায় পণ্যের উৎপাদনও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। পরিণতিতে আমাদের প্রশান্তিময় বিচরণক্ষেত্র আজ বৃক্ষহীন এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি। অস্তিত্ব বিপন্ন হবার আশংকায় সরকার, পরিবেশবিদসহ সাধারণ নাগরিকও এখন সচেতন। এ সচেতনতা থেকেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে বৃক্ষরোপণ আন্দোলন। কারণ পরিবেশ-প্রতিবেশ উন্নয়ন, জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বৃক্ষের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য গাছ লাগানো যেমন জরুরি, তেমনি গাছ সংরক্ষণেও প্রয়োজন সচেতনতা।

এ দেশে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে সারা দেশের জেলা-উপজেলাতে রয়েছে অসংখ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খোলা জায়গায় উল্লেযোগ্য কোনো গাছ নেই। অনেক জায়গায় বর্ষা মৌসুমে গাছ লাগানো হলেও সংরক্ষণের অভাবে তা খুব বেশি দিন টিকে থাকে না। একটা বিষয় লক্ষণীয়, গাছের ছায়া না থাকায় স্কুলের ছেলেমেয়েদের প্রচ- রোদে দাঁড়িয়ে শরীরচর্চা করতে হয় এবং জাতীয় সংগীত গাইতে হয়। বাংলার আকাশ, বাতাস প্রকৃতির যে অপরূপ বর্ণনা জাতীয় সংগীতে রয়েছে তার সাথে প্রতিটি শিক্ষার্থীর একাত্ম হতে দরকার ছায়াঘেরা, সুনিবিড়, মনোরম প্রকৃতির অনাবিল সাহচর্য। অনুকূল পরিবেশ-প্রকৃতি মানুষের মনকে যেমন উজ্জীবিত করে, তেমনি শরীরচর্চা জন্ম দেয় শৃঙ্খলাবোধের। তাই প্রতিটি বিদ্যালয়ে বৃক্ষরোপণ এবং গাছ সংরক্ষণে অবশ্যই কেন্দ্রীয়ভাবে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে এবং প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে।

বাংলাদেশ পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। বর্তমানে দেশে বনজ, ফলদ ও ঔষধি সম্পদ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের অভিমত অনুযায়ী একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এর পরিমাণ বর্তমানে মাত্র ১৭.৫ ভাগ। সুতরাং বনজ সম্পদ বৃদ্ধির জন্য বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অপরিসীম। সেই সাথে রোপিত চারা গাছের যতœ এবং পরিচর্যার গুরুত্ব আরও বেশি। আমাদের অসচেতনতায় আশির দশকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বিরূপ প্রভাব দেখা দেয়। অবাধে গাছ কাটার ফল সারাদেশেই মারাত্মক আকার ধারণ করে। পরিবেশের বিরূপ প্রভাবে শংকিত হয়ে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। একটি গাছ কাটলে দুটি গাছ লাগানোর আহবান জানানো হয়। স্কুলে-স্কুলে শিক্ষার্থীদের স্কুলের আঙিনাতেই নিজের হাতে গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। শুরু হয় বৃক্ষরোপণ অভিযান। সেই থেকেই প্রতিবছর বর্ষায় রাষ্ট্রীয়ভাবে আয়োজিত হচ্ছে বৃক্ষমেলা। পরিবেশ রক্ষায় অবদানের জন্য দেওয়া হচ্ছে পরিবেশ পদক, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য দেওয়া হচ্ছে বঙ্গবন্ধু পদক এবং বৃক্ষরোপণের জন্য দেওয়া হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী পদক। নব্বই দশকে পালিত বৃক্ষরোপণ অভিযান সময়ের চাহিদায় ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে বর্তমানে সামাজিক আন্দোলনে রূপ লাভ করেছে।

পরিবেশ সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয়ভাবে সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে এবং একে কার্যকর করতে সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করে গণসচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালাতে হবে। প্রতিটি এলাকায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বন গড়ে তুলতে হবে। আবাসন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাড়ির নকশা প্রণয়নের সময় বৃক্ষের জন্য সংরক্ষিত এলাকাসহ অনুমোদন করানোর বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। গ্রামীণ কৃষিজমি বা বনজভূমিতে আবাসন গড়ে না-তুলতে পরিবেশ আইন বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগী হতে হবে। আমাদের দেশে একই ব্যক্তির একাধিক বাড়ি তৈরির প্রবণতায় কমে যাচ্ছে কৃষিজমি ও বনভূমি। জমির অপর্যাপ্ততার পরিপ্রেক্ষিতে কেউ বাড়ি করার আগে অন্য কোথাও তার বাড়ি আছে কি না সে বিষয়ে প্রত্যয়ন দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করার সময় এসেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার পাশে বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রাস্তার উন্নয়নের সাথে গাছ লাগানো এবং পরিচর্যার নীতিমালা একীভূত করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা গেলে দ্রুত সুফল পাওয়া যাবে। বড়ো বড়ো মহাসড়কে গাছের পরিচর্যায় এলাকাভিত্তিক টহল এবং নজরদারি বাড়ানোসহ বৃক্ষরোপণে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা এনজিওদের দায়িত্ব দেওয়া যায়। শহরের রাস্তাগুলোতে আজ বিদ্যুতের খুঁটি, টেলিফোন ও স্যাটেলাইট সংযোগের তারের জঞ্জালে আকাশ দেখা যায় না। এগুলো অপসারণ করে মাটির নীচ দিয়ে কেবল লাইন স্থাপন করে রাস্তার দু’ধারে ছায়াদানকারী গাছ লাগালে পরিবেশ ঠান্ডা ও ধুলাবালিমুক্ত থাকবে। প্রচ- রোদে পথচারী এবং রিক্সাভ্যান চালক, মুটেমজুরসহ সকল শ্রমজীবী মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারবে।

কর্মসংস্থান আর দারিদ্র্য বিমোচন একে অপরের পরিপূরক। বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। এ লক্ষ্য পূরণে গাছের ভূমিকা অসামান্য। ফলের বাগান করে চাষি যেমন সফলতার মুখ দেখছে, তেমনি ঔষধি গাছের পরিচর্যা আর সংরক্ষণে অর্জিত বিপুল লভ্যাংশে অনেক তরুণ-যুবক বেকারত্বের হতাশা থেকে মুক্তি পাচ্ছে। গাছ লাগালেই শুধু হবে না একে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে প্রয়োজন যথাযথ পরিচর্যা। এক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে প্রতিটি নাগরিককে হতে হবে সচেতন।

মানুষের জীবন প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলতে, সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে, ষড়ঋতুর বৈচিত্রের সাথে পরিচিত হতে, প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্য পেতে বৃক্ষের তুলনা নেই। আসুন ঘর থেকেই পরিকল্পনা করি আমার বাড়ি, আমার এলাকা, আমার দেশের প্রতিটি মানুষের পরিচর্যায় এদেশ হবে বনজ, ফলদ ও ঔষধি গাছের মস্ত বড়ো এক বাগান।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

বৃক্ষরোপণে বাংলাদেশ

আপডেট টাইম : ০৮:০২:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ অগাস্ট ২০১৫

নদীবিধৌত পলিভূমি বাংলাদেশ একসময় ছিল গ্রামভিত্তিক ও কৃষি নির্ভর। সে সময় আমাদের গ্রামগুলো বনবাদাড়ে ঘেরা ছিল। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির আশপাশে ছিল ফসলি জমি। বাড়ির একটা অংশ জুড়ে থাকত আম,জাম, কাঁঠাল, বাতাবিলেবু, পেয়ারাসহ বারো মাসের রকমারি ফলের গাছ। বনবাদাড়ে ছিল করমচা, লটকন, গাবসহ আরও অসংখ্য দেশি প্রজাতির গাছ। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ দেশ এমনই সোনাফলা যে অনাদর-অবহেলায় পড়ে থাকা ভূমিতে সকলের অগোচরে জন্ম নেয় বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন তরুলতা, বৃক্ষ। কারো পরিচর্যায় নয় বরং গাছ থেকে বীজ পড়ে বর্ষার জলমগ্ন পরিবেশে অসংখ্য চারায় ভরে ওঠে পতিত জমি। এমনি করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রকমারি বনজ-ফলদ বৃক্ষের সমারোহে পরিপূর্ণ একেকটি এলাকা এক সময় গ্রামীণ বনভূমি হিসেবে নিজস্ব রূপ নেয়।

বর্তমানে সময়ের সাথে সাথে মানুষের চাহিদা বাড়ছে। এখন আর আগের মতো কৃষিজমি নেই। বাড়ির পাশের জমিতে পিতার পূর্বপুরুষের স্মৃতি জড়ানো ছায়াশোভিত আম-কাঁঠালের বাগান আর নেই। ওসব জমি এখন দালান-কোঠার দখলে। মেহগনি কাঁঠালের লগ এখন দরজা জানালার কপাট। ঝোঁপঝাড় আর অজানা গাছের জঙ্গল এখন উনুনের গ্রাসে। গ্রামীণ বনভূমির কাঠ এখন ইটের ভাঁটায় পুড়ে কয়লা। চারিদিকে নগর জীবনের নাভিশ্বাস, প্রকৃতিতে বাড়ছে গরমের মাত্রা। হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের স্বস্তিময় স্বাভাবিক জীবনের আয়েশ।

সভ্যতার নানা আয়োজনে আমাদের ভোগবিলাসিতা যতই বাড়ছে নতুন নতুন কলকারখানায় পণ্যের উৎপাদনও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। পরিণতিতে আমাদের প্রশান্তিময় বিচরণক্ষেত্র আজ বৃক্ষহীন এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি। অস্তিত্ব বিপন্ন হবার আশংকায় সরকার, পরিবেশবিদসহ সাধারণ নাগরিকও এখন সচেতন। এ সচেতনতা থেকেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে বৃক্ষরোপণ আন্দোলন। কারণ পরিবেশ-প্রতিবেশ উন্নয়ন, জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বৃক্ষের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য গাছ লাগানো যেমন জরুরি, তেমনি গাছ সংরক্ষণেও প্রয়োজন সচেতনতা।

এ দেশে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে সারা দেশের জেলা-উপজেলাতে রয়েছে অসংখ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খোলা জায়গায় উল্লেযোগ্য কোনো গাছ নেই। অনেক জায়গায় বর্ষা মৌসুমে গাছ লাগানো হলেও সংরক্ষণের অভাবে তা খুব বেশি দিন টিকে থাকে না। একটা বিষয় লক্ষণীয়, গাছের ছায়া না থাকায় স্কুলের ছেলেমেয়েদের প্রচ- রোদে দাঁড়িয়ে শরীরচর্চা করতে হয় এবং জাতীয় সংগীত গাইতে হয়। বাংলার আকাশ, বাতাস প্রকৃতির যে অপরূপ বর্ণনা জাতীয় সংগীতে রয়েছে তার সাথে প্রতিটি শিক্ষার্থীর একাত্ম হতে দরকার ছায়াঘেরা, সুনিবিড়, মনোরম প্রকৃতির অনাবিল সাহচর্য। অনুকূল পরিবেশ-প্রকৃতি মানুষের মনকে যেমন উজ্জীবিত করে, তেমনি শরীরচর্চা জন্ম দেয় শৃঙ্খলাবোধের। তাই প্রতিটি বিদ্যালয়ে বৃক্ষরোপণ এবং গাছ সংরক্ষণে অবশ্যই কেন্দ্রীয়ভাবে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে এবং প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে।

বাংলাদেশ পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। বর্তমানে দেশে বনজ, ফলদ ও ঔষধি সম্পদ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের অভিমত অনুযায়ী একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এর পরিমাণ বর্তমানে মাত্র ১৭.৫ ভাগ। সুতরাং বনজ সম্পদ বৃদ্ধির জন্য বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অপরিসীম। সেই সাথে রোপিত চারা গাছের যতœ এবং পরিচর্যার গুরুত্ব আরও বেশি। আমাদের অসচেতনতায় আশির দশকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বিরূপ প্রভাব দেখা দেয়। অবাধে গাছ কাটার ফল সারাদেশেই মারাত্মক আকার ধারণ করে। পরিবেশের বিরূপ প্রভাবে শংকিত হয়ে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। একটি গাছ কাটলে দুটি গাছ লাগানোর আহবান জানানো হয়। স্কুলে-স্কুলে শিক্ষার্থীদের স্কুলের আঙিনাতেই নিজের হাতে গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। শুরু হয় বৃক্ষরোপণ অভিযান। সেই থেকেই প্রতিবছর বর্ষায় রাষ্ট্রীয়ভাবে আয়োজিত হচ্ছে বৃক্ষমেলা। পরিবেশ রক্ষায় অবদানের জন্য দেওয়া হচ্ছে পরিবেশ পদক, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য দেওয়া হচ্ছে বঙ্গবন্ধু পদক এবং বৃক্ষরোপণের জন্য দেওয়া হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী পদক। নব্বই দশকে পালিত বৃক্ষরোপণ অভিযান সময়ের চাহিদায় ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে বর্তমানে সামাজিক আন্দোলনে রূপ লাভ করেছে।

পরিবেশ সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয়ভাবে সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে এবং একে কার্যকর করতে সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করে গণসচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালাতে হবে। প্রতিটি এলাকায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বন গড়ে তুলতে হবে। আবাসন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাড়ির নকশা প্রণয়নের সময় বৃক্ষের জন্য সংরক্ষিত এলাকাসহ অনুমোদন করানোর বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। গ্রামীণ কৃষিজমি বা বনজভূমিতে আবাসন গড়ে না-তুলতে পরিবেশ আইন বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগী হতে হবে। আমাদের দেশে একই ব্যক্তির একাধিক বাড়ি তৈরির প্রবণতায় কমে যাচ্ছে কৃষিজমি ও বনভূমি। জমির অপর্যাপ্ততার পরিপ্রেক্ষিতে কেউ বাড়ি করার আগে অন্য কোথাও তার বাড়ি আছে কি না সে বিষয়ে প্রত্যয়ন দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করার সময় এসেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার পাশে বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রাস্তার উন্নয়নের সাথে গাছ লাগানো এবং পরিচর্যার নীতিমালা একীভূত করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা গেলে দ্রুত সুফল পাওয়া যাবে। বড়ো বড়ো মহাসড়কে গাছের পরিচর্যায় এলাকাভিত্তিক টহল এবং নজরদারি বাড়ানোসহ বৃক্ষরোপণে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা এনজিওদের দায়িত্ব দেওয়া যায়। শহরের রাস্তাগুলোতে আজ বিদ্যুতের খুঁটি, টেলিফোন ও স্যাটেলাইট সংযোগের তারের জঞ্জালে আকাশ দেখা যায় না। এগুলো অপসারণ করে মাটির নীচ দিয়ে কেবল লাইন স্থাপন করে রাস্তার দু’ধারে ছায়াদানকারী গাছ লাগালে পরিবেশ ঠান্ডা ও ধুলাবালিমুক্ত থাকবে। প্রচ- রোদে পথচারী এবং রিক্সাভ্যান চালক, মুটেমজুরসহ সকল শ্রমজীবী মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারবে।

কর্মসংস্থান আর দারিদ্র্য বিমোচন একে অপরের পরিপূরক। বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। এ লক্ষ্য পূরণে গাছের ভূমিকা অসামান্য। ফলের বাগান করে চাষি যেমন সফলতার মুখ দেখছে, তেমনি ঔষধি গাছের পরিচর্যা আর সংরক্ষণে অর্জিত বিপুল লভ্যাংশে অনেক তরুণ-যুবক বেকারত্বের হতাশা থেকে মুক্তি পাচ্ছে। গাছ লাগালেই শুধু হবে না একে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে প্রয়োজন যথাযথ পরিচর্যা। এক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে প্রতিটি নাগরিককে হতে হবে সচেতন।

মানুষের জীবন প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলতে, সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে, ষড়ঋতুর বৈচিত্রের সাথে পরিচিত হতে, প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্য পেতে বৃক্ষের তুলনা নেই। আসুন ঘর থেকেই পরিকল্পনা করি আমার বাড়ি, আমার এলাকা, আমার দেশের প্রতিটি মানুষের পরিচর্যায় এদেশ হবে বনজ, ফলদ ও ঔষধি গাছের মস্ত বড়ো এক বাগান।