অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার গ্রামীণফোনের পোস্ট পেইড মোবাইল ফোনে সম্প্রতি ১০ হাজার টাকা বিল এসেছে। বিল দেখে হতবাক ওই কর্মকর্তা সঙ্গে সঙ্গে জানালেন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) কর্মরত তার এক বন্ধুকে। ওই বন্ধুও বিটিআরসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। খবরটি শোনার পর বিটিআরসির ওই কর্মকর্তা গ্রামীণফোনের এক কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবহিত করেন। কিছুক্ষণ পর গ্রামীণফোন থেকে জানানো হয়, পোস্ট পেইড সংযোগে কিছু সমস্যা হওয়ায় বিলটি এসেছে। পরে তার বিলটি ঠিক করে দেয়া হয়। যদিও এই ঘটনার পর গ্রামীণফোন বলেছে, নেটওয়ার্কে কিছু সমস্যা হওয়ার কারণে এমনটি হয়েছিল। এই কর্মকর্তার সমস্যার সামাধান হলেও সাধারণ মানুষের সমস্যার কতটা সমাধান হচ্ছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ!
একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা তার মোবাইল ফোনে ব্যবহার করেন বাংলালিংকের ইন্টারনেট। এক মাস মেয়াদি ৬০০ মেগাবাইটের একটি প্যাকেজ তিনি ব্যবহার করেন ভ্যাট ছাড়া ২০০ টাকায়। প্যাকেজটি মোবাইল ফোনে চালু করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দেখেন তার ৯৮ মেগাবাইট ব্যবহার করা হয়ে গেছে। এই ৯৮ মেগাবাইট কীভাবে খরচ হলো তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না। বিষয়টি নিয়ে ওই কর্মকর্তা মেইল করে বিটিআরসির কাছে অভিযোগও করেছেন। কিন্তু দেড় মাস হয়ে গেলেও কোনো প্রতিকার পাননি। শুধু যে একদিন তা নয় প্রতিনিয়তই ঘটছে এমনটি। একটি ফোন কল করার পর ব্যালান্স অস্বাভাবিকভাবে কমে যাচ্ছে। দু-এক টাকা হরহামেশাই ব্যালান্স থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা শুধু গ্রামীণফোন ও বাংলালিংকের নয়, রবি, এয়ারটেল, টেলিটক ও সিটিসেল সবার। গ্রাহকরা বলছেন, মোবাইল ফোন থেকে টাকা লুট করে নিচ্ছে অপারেটররা! শুধু কি তাই, কল ড্রপ, ইন্টারনেটের গতি ঘোষণা অনুযায়ী না পাওয়াসহ অসংখ্য অভিযোগ গ্রাহকের। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। এর বাইরে এসএমসের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ মানুষ। গড়ে প্রতিদিন ৮-১০টি করে এসএমএস আসে। এ ছাড়া বিরক্তিকর কল তো আছেই। সেখানে শোনাচ্ছে গান।
টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম ইত্তেফাককে বলেন, ‘মন্ত্রীর বাইরেও আমি একজন মোবাইল ফোনের গ্রাহক। সাধারণ মানুষের যেসব অভিযোগ, আমারও একই ধরনের অভিযোগ।’ নিজের অভিযোগের একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেটের একটি প্যাকেজ কেনার পর সেটি শেষ হয়ে গেলে পুনরায় না চাইলেও আবার প্যাকেজটি চালু করে দিয়ে টাকা কেটে নিচ্ছে। টুজি আর থ্রিজি তারা এক করে ফেলেছে। কোনো গ্রাহক কম টাকা দিয়ে ইন্টারনেট নিতে চাইলে সে ব্যবস্থা আর থাকছে না। এমন পরিস্থিতিতে আমি সব মোবাইল ফোন অপারেটরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন বলে তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। ইতোমধ্যে গ্রামীণফোন সে ব্যবস্থাও নিয়েছে। অন্যদেরও এমন ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। এখানে অবশ্যই শৃঙ্খলা আনতে হবে।’
বিটিআরসি সূত্র জানিয়েছে, গত মে থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত বিটিআরসিতে অভিযোগ করেছেন ১৬৭ জন গ্রাহক। এর মধ্যে ইন্টারনেটে মেগাবাইট কেটে নেয়া ও ব্যালান্স অস্বাভাবিক কমে যাওয়া সংক্রান্ত অভিযোগই বেশি। কিছু গ্রাহক ঠিকমতো ইন্টারনেট ব্যবহারের গতি না পাওয়ার অভিযোগও করেছেন। অনেক গ্রাহক সুনির্দিষ্ট করে লিখেছেন— কীভাবে তার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কেটে নেয়া হয়েছে। আর একবার টাকা কেটে নেয়া হলে তা আর ফেরত পাওয়া যায় না। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষার্থী বলেন, সারাদেশে এমন একজন মোবাইল ফোন গ্রাহক খুঁজে পাওয়া যাবে না যার অ্যাকউন্ট থেকে টাকা লুট হওয়ার অভিযোগ নেই। গত বছর দেড় হাজারের মতো অভিযোগ পড়েছিল। এর মধ্যে পাঁচশর বেশি অভিযোগ ছিল গ্রামীণফোনের গ্রাহকদের। আর বাংলালিংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে দুশর বেশি।
গ্রাহকদের অভিযোগ সম্পর্কে গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন সৈয়দ তালাত কামাল ইত্তেফাককে বলেন, টেলিযোগাযোগ খাতের মতো একটি প্রযুক্তিনির্ভর সেবা খাতে গ্রাহকদের অভিযোগ থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে গ্রামীণফোনের সেবা সংক্রান্ত অভিযোগের হার গ্রাহক সংখ্যার অনুপাতে স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে। সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে গ্রামীণফোন গ্রাহকদের প্রতিটি অভিযোগ ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে গুরুত্বের সাথে সমাধান করে থাকে। গ্রামীণফোন মনে করে গ্রাহকদের অভিযোগ গ্রহণ এবং সমাধানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সেবার মান আরও উন্নত করার সুযোগ পাওয়া যায়। আর সে কাজটি করে গ্রামীণফোন।
বিটিআরসির হিসাব অনুযায়ী গত জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের গ্রাহক সংখ্যা ১২ কোটি ৬৮ লাখ। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের ৫ কোটি ৩১ লাখ, বাংলালিংকের ৩ কোটি ২২ লাখ, রবির ২ কোটি ৭৩ লাখ, এয়ারটেলের ৮৭ লাখ, টেলিটকের ৪২ লাখ ও সিটিসেলের ১১ লাখ। আর বাংলাদেশে ইন্টারনেটের গ্রাহক ৪ কোটি ৮৩ লাখ। এর মধ্যে মোবাইল ফোনেই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ৪ কোটি ৬৮ লাখ গ্রাহক। এই বিশাল সংখ্যক গ্রাহকের অভিযোগের জন্য বিটিআরসিতে অল্প কিছু ব্যবস্থা আছে। যে ব্যবস্থা আছে, তাতেও গ্রাহকরা অভিযোগ করে কোনো ফল পাচ্ছেন না।
টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, বিটিআরসির অভিযোগ গ্রহণ ও প্রতিকারের ব্যবস্থাটি খুবই দুর্বল। এ বিষয়ে তিনি মনোযোগ দিচ্ছেন। গ্রাহকের অভিযোগ ও তার প্রতিকারের বিষয়টি আমরা নিশ্চিত করতে চাই।
নিয়ম অনুযায়ী ই-মেইল বা এসএমসে বিটিআরসিতে কোনো অভিযোগ এলে, সেই অভিযোগ সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন অপারেটরের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। তারা কী ব্যবস্থা নিল তার খুব বেশি মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেই। সংশ্লিষ্ট অপারেটর থেকে যদি জানানো হয়, অভিযোগটি ঠিক নয় বা সমাধান হয়ে গেছে, তাহলে বিটিআরসি সেখানেই রণে ভঙ্গ দেয়। আসলে গ্রাহক কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন কি না তা নিশ্চিত করে না বিটিআরসি। তবে সম্প্রতি তিনটি টিম করেছে বিটিআরসি। ওই টিমের সদস্যরা মাঠে গিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগ শুনছেন। আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই টিমের সদস্যরা মাঠে গিয়ে মানুষের কথা শুনবেন। এরপর রিপোর্ট দেবেন। তাদের কাজ মূলত, কোনো অপারেটরের লাইনে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে গ্রাহকের সেটা খুঁজে বের করা।
সেবা নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ ও তার সমাধান প্রসঙ্গে বিটিআরসির সচিব সরওয়ার আলম ইত্তেফাককে বলেন, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে গ্রাহকের অভিযোগ গ্রহণ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। মোট তিন ধাপে গ্রাহকের অভিযোগ নেয়া হচ্ছে। ধাপগুলো হচ্ছে ডাক, ই-মেইল ও ফোন; ওয়েবসাইট এবং শর্ট কোড। গ্রাহক যাতে সহজে অভিযোগ পাঠাতে পারেন সে জন্য অভিযোগ নেয়ার ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিটি অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। কারো অভিযোগই ছোট করে দেখে না বিটিআরসি।