ধান, নদী, খাল– এই তিনে বরিশাল৷ জালের মতো ছড়ানো ছিটানো নদী আর খালের প্রাধান্য থাকায় এ অঞ্চলে আজও চলাচলের প্রধান যান নৌকা৷ আর বর্ষার সময় নদী-খালের পানি বেড়ে যাওয়ায় নৌকার ব্যবহারও যায় বেড়ে৷ বসে নৌকার হাটও৷
ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক
পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার কুড়িয়ানা হাটে নৌকা নিয়ে যাচ্ছেন কারিগররা৷ স্বরূপকাঠির সন্ধ্যা নদীর শাখা খাল ‘কুড়িয়ানা’-তে সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার বসে এ নৌকার হাট৷ প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জলে ও ডাঙ্গায় বসা এ হাট এই অঞ্চলের ঐতিহ্যেরও ধারক৷
নৌকা তৈরি করা যাঁদের পেশা
স্বরূপকাঠি উপজেলার এগারোটি গ্রামের প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি পরিবারের প্রধান পেশা নৌকা তৈরি করা৷ উপজেলার আটঘর, কুড়িয়ানা, আদমকাঠি, জিন্দাকাঠি, ইন্দুরকানি, দলাহার, আতাপাড়া, শেখেরহাট, চামির, গাগর, গগন প্রভৃতি গ্রামের নৌকার কারিগররা সারা সপ্তাহজুড়ে ব্যস্ত থাকেন নৌকা তৈরিতে৷ আর তারপর শুক্রবার সেই সব নৌকা নিয়ে বিক্রি করেন কুড়িয়ানা নৌকার হাটে৷
বর্ষায় রবিবারেও বসে হাট
শুক্রবার খুব সকাল থেকেই কারিগররা কুড়িয়ানার হাটে আসতে শুরু করেন৷ ক্রেতা সমাগম বিকেলে হলেও, ক্রেতা আকৃষ্ট করতে ভালো জায়গা দখলের প্রতিযোগিতা থাকে এখানে৷ কুড়িয়ানার হাট সাধারণত সপ্তাহে মাত্র একদিন, অর্থাৎ শুক্রবার বসলেও বর্ষা মৌসুমে চাহিদা বেশি থাকায় রবিবারেও সীমিত আকারে হাট বসান বিক্রেতারা৷
দুর্লভ হয়ে উঠেছে সুন্দরীশতবর্ষ পুরানো ‘কুড়িয়ানা নৌকার হাট’
আটঘর বাজারে সাধারণত বিক্রি হয় কোষা ও ডিঙ্গি নৌকা৷ এ বাজারের নৌকার কারিগর আশুতোষ জানালেন যে, তাঁর বাপ-দাদারা নৌকা তৈরি করতেন সুন্দরী কাঠ দিয়ে৷ সে সময়ে সুন্দরী কাঠের সবচেয়ে বড় মোকাম ছিল স্বরূপকাঠি৷ তবে দিনে দিনে সুন্দরী কাঠ দুর্লভ হয়ে ওঠায়, তাঁরা এখন নৌকা তৈরি করছেন মেহগনি, চাম্বল, রেইনট্রি, গাব, গুলাব, আমড়া, বাদাম প্রভৃতি কাঠ দিয়ে৷
দু’জন মিলে করি কাজ…
ইন্দুরকানি গ্রাম থেকে আসা নৌকা বিক্রেতা আমজাদ মোল্লা জানান যে, দু’জন মিস্ত্রী দিনে একটি ছোট নৌকা তৈরি করতে পারেন৷ আকার আর কাঠের রকম ভেদে একেকটি নৌকা বিক্রি হয় দেড় হাজার থেকে চার হাজার টাকায়৷ তবে নৌকায় গাব, আলকাতরা কিংবা অন্য কোনো কারুকাজ থাকলে দামের তারতম্য তো হয়-ই৷
নামাজের পর জমে ওঠে বাজার
দিনের প্রথমভাগে নৌকা বিক্রেতারা হাটে এসে অলস সময় কাটান৷ এই ফাঁকে কেউ কেউ আবার একটিখানি জিরিয়ে বা ঘুমিয়েও নেন৷ তবে শুক্রবারের জুম্মার নামাজের পর বাজার জমে উঠলে বিক্রেতাদের ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়৷
মুঠোফোনেও হয় লেনদেন
কুড়িয়ানা নৌকার হাটে ক্রেতার অপেক্ষা করছেন বিক্রেতারা৷ তবে সব সময় এ সব বিক্রেতাকে ক্রেতার অপেক্ষায় থাকতে হয় না৷ মোবাইল নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ ও মুঠোফোন সহজলভ্য হওয়ায় অনেক ক্রেতাই আজকাল কারিগরদের কাছে আগাম চাহিদার কথা জানান৷ পরে হাটের দিনে এসে যাচাই বাচাই করে সে নৌকা বুঝে নেন৷
এক নৌকায় দুই মৌসুম
কুড়িয়ানা হাটে ক্রেতারা নৌকা কেনার আগে ভালো করে যাচাই বাচাই করে নেন৷ স্বল্প আয়ের এ সব মানুষদের প্রতিটি নৌকা দিয়ে কমপক্ষে দুটি মৌসুম পার করতে হয়৷ প্রত্যেক ক্রেতাই তাই তাঁদের টাকার সর্বোচ্চ মূল্য পেতে সচেষ্ট থাকেন৷ তারপর নৈকা কিনে আনন্দে ঘরে ফেরেন তাঁরা৷
বৈঠাও বিক্রি হয় বাজারে
নৌকা চালানোর জন্য দরকার বৈঠা৷ কুড়িয়ানা বাজারে কোনো কোনো বিক্রেতা তাই শুধু নৌকার বৈঠা বিক্রি করেন৷ আর ক্রেতারা নৌকা কেনার পর আকার অনুযায়ী বৈঠা কিনে নেন বাজার থেকে৷ কুড়িয়ানা নৌকার হাটে সাধারণত একেকটি বৈঠার দাম ৮০-২০০ টাকা৷ বলা বাহুল্য, কাঠের ধরণ ও আকার অনুযায়ী বৈঠার দামের তারতম্য হয়৷
নানা কাজে ব্যবহৃত হয় নৌকা
কুড়িয়ানা বাজারে বিক্রি হওয়া নৌকাগুলো এ অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন কাজে বহুল ব্যবহৃত হয়৷ সাধরণত মাছ ধরা, কোথাও বেড়াতে যাওয়া, বাজারে পণ্য সরবাহ, পেয়ারা ধরা, হাট-বাজারে যাওয়াসহ নানান কাজে এ সব নৌকার ব্যবহার হয়৷
ভাসমান হাট বেশি দূরে নয়শতবর্ষ পুরানো ‘কুড়িয়ানা নৌকার হাট’
স্বরূপকাঠির পার্শ্ববতী ঝালকাঠি জেলার ভিমরুলি গ্রামের কৃত্তিপাশা খালে বসে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ভাসমান হাট৷ বর্ষা ও শরতে এ হাটে শত শত নৌকা বোঝাই পেয়ারা আর আমড়া বিক্রি হয়৷ আর এ সব নৌকার বেশিরভাগেরই যোগান আসে কুড়িয়ানার নৌকার হাট থেকে৷
পাশেই রয়েছে আরেক হাট
কুড়িয়ানার পাশেই আরেকটি হাট ‘আটঘর’৷ ভাসমান এ হাটেও ছোট ছোট নৌকায় কৃষিপণ্য নিয়ে জড়ো হন বিক্রেতারা৷ এ বাজারেও কুড়িয়ানা হাটের নৌকারই প্রাধান্য৷ ।ডচভেলে।