ঢাকা ১২:৪৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সৈয়দ নজরুল ইসলামকে দেখার স্মৃতি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৪৪:২৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ নভেম্বর ২০১৭
  • ২৯৩ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সামনে থেকে দেখার সুযোগ ও সৌভাগ্য বেশ কয়েকবার হয়েছে। ১৯৭০ সালের অক্টোবর কিংবা নভেম্বর মাস। করিমগঞ্জ ও তাড়াইল থানা নিয়ে প্রাদেশিক পরিষদে আমাদের নির্বাচনী এলাকা। আমাদের বাড়িটি প্রত্যন্ত গ্রামে। একদিন বিকালে লক্ষ্য করলাম বাড়ির সামনে নদীর পাড় ধরে ৮ থেকে ১০ জন লোক হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। করিমগঞ্জ বাজারের দিক থেকেই তারা এসেছেন এটা নিশ্চিত। তাদের হাঁটা, কথোপকথন এবং আমার পরিচিত ২-৩ জন স্থানীয় নেতাকে দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়নি সবাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। এই দলে এমন একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে লক্ষ্য করলাম, যিনি সবার আগে আগে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলেছেন। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত, গলায় ঝোলানো ভাঁজ করা ঘিয়ের রঙের চাদর, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। সদা হাস্যমুখাবয়বের বিশালদেহী মানুষটিকে এর আগে আমাদের এলাকায় কেউ কখনও দেখেনি। যতক্ষণ দেখা যায়, আমরা ক’জন কিশোর তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সেদিন ছিল বাবুর বাজারের হাটবার। হেমন্তকাল হলেও আকাশে মেঘের আনাগোনা ছিল। বিকালে বাবার সঙ্গে হাটে গিয়ে পৌঁছতে না পৌঁছতেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ধান মহালে কিছুটা ভিড়। সহজেই নজরে পড়ল সেই সৌম্য সুন্দর চেহারার মানুষটিকে, যাকে কিছুক্ষণ আগে আমরা নদীর পাড় ধরে হেঁটে আসতে দেখেছি। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মাঝেই ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে ‘বোম’ (টিন দিয়ে তৈরি চোঙা) মুখে লাগিয়ে সমবেত হাটুরেদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন মানুষটি। বললেন ৬ দফা ও ১১ দফার কথা। আরও বললেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের কথা। গ্রাম্য হাটের ক্ষুদ্র পরিসরের সমাবেশের সেই আকর্ষণীয় চেহারার বক্তাটি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
এর কিছুদিন পর নির্বাচন উপলক্ষে করিমগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনের প্রোগ্রাম হয়। বিকাল ৩টায় জনসভা হওয়ার কথা থাকলেও সৈয়দ নজরুলসহ বঙ্গবন্ধু সভাস্থলে এসে পৌঁছেন রাত ৮টার পর। অপেক্ষমাণ জনস্রোতের সামনে নজরুল ইসলাম কোনো বক্তৃতা করেননি সেদিন। শেখ সাহেবই তার সংক্ষিপ্ত ভাষণে জনগণের কাছে এমএ কুদ্দুসকে ছোটভাই আর সৈয়দ নজরুলকে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে পরিচয় করিয়ে দিয়ে নৌকা মার্কায় ভোটদানের আহ্বান জানান। মাঠভর্তি জনতা সমস্বরে সেদিন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দেন। দুটি দিনের ঘটনাই আমার জীবনে খুবই স্মরণীয়।
দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর সরকার গঠিত হলে সৈয়দ নজরুল ইসলামের ওপর বর্তায় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার। মুক্ত-স্বাধীন দেশের মন্ত্রী হয়ে সৈয়দ নজরুল প্রথমবার করিমগঞ্জ এলে আমরা ছাত্রছাত্রীরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ফুল ছিটিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাই। আমার বেশ মনে পড়ে, ডাকবাংলো থেকে হেঁটে শিক্ষার্থীদের মাঝ দিয়ে সভামঞ্চে আসার সময় তিনি আমার এবং আমার মতো আরও কয়েকজনের মাথা ছুঁয়ে আদর করেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মাত্র আড়াই মাসের ব্যবধানে ৩ নভেম্বর কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় একই দুঃখজনক পরিণতি বরণ করতে হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে। বর্তমান প্রজন্মের কাউকে কি সহজে বিশ্বাস করানো যাবে, দীর্ঘদিন রাজনীতি এবং রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষস্তরে অবস্থান করলেও সৈয়দ নজরুল ইসলামের কোনো ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা ঢাকা শহরে একটি বাড়ি, ফ্ল্যাট বা প্লট ছিল না? স্বামীর হত্যাকাণ্ডের পর সরকারি বাড়ি ছেড়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সহধর্মিণী বেগম নাফিসা নজরুল ময়মনসিংহের কলেজ রোডে তাদের অর্ধনির্মিত প্রায় পরিত্যক্ত একতলা বাড়িটিতে গিয়ে ওঠেন এবং জীবনের শেষ দিনটিও সেখানেই কাটে তার।
বিমল সরকার : সহকারী অধ্যাপক, বাজিতপুর কলেজ; কিশোরগঞ্জ

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

সৈয়দ নজরুল ইসলামকে দেখার স্মৃতি

আপডেট টাইম : ১২:৪৪:২৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ নভেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সামনে থেকে দেখার সুযোগ ও সৌভাগ্য বেশ কয়েকবার হয়েছে। ১৯৭০ সালের অক্টোবর কিংবা নভেম্বর মাস। করিমগঞ্জ ও তাড়াইল থানা নিয়ে প্রাদেশিক পরিষদে আমাদের নির্বাচনী এলাকা। আমাদের বাড়িটি প্রত্যন্ত গ্রামে। একদিন বিকালে লক্ষ্য করলাম বাড়ির সামনে নদীর পাড় ধরে ৮ থেকে ১০ জন লোক হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। করিমগঞ্জ বাজারের দিক থেকেই তারা এসেছেন এটা নিশ্চিত। তাদের হাঁটা, কথোপকথন এবং আমার পরিচিত ২-৩ জন স্থানীয় নেতাকে দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়নি সবাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। এই দলে এমন একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে লক্ষ্য করলাম, যিনি সবার আগে আগে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলেছেন। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত, গলায় ঝোলানো ভাঁজ করা ঘিয়ের রঙের চাদর, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। সদা হাস্যমুখাবয়বের বিশালদেহী মানুষটিকে এর আগে আমাদের এলাকায় কেউ কখনও দেখেনি। যতক্ষণ দেখা যায়, আমরা ক’জন কিশোর তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সেদিন ছিল বাবুর বাজারের হাটবার। হেমন্তকাল হলেও আকাশে মেঘের আনাগোনা ছিল। বিকালে বাবার সঙ্গে হাটে গিয়ে পৌঁছতে না পৌঁছতেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ধান মহালে কিছুটা ভিড়। সহজেই নজরে পড়ল সেই সৌম্য সুন্দর চেহারার মানুষটিকে, যাকে কিছুক্ষণ আগে আমরা নদীর পাড় ধরে হেঁটে আসতে দেখেছি। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মাঝেই ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে ‘বোম’ (টিন দিয়ে তৈরি চোঙা) মুখে লাগিয়ে সমবেত হাটুরেদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন মানুষটি। বললেন ৬ দফা ও ১১ দফার কথা। আরও বললেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের কথা। গ্রাম্য হাটের ক্ষুদ্র পরিসরের সমাবেশের সেই আকর্ষণীয় চেহারার বক্তাটি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
এর কিছুদিন পর নির্বাচন উপলক্ষে করিমগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনের প্রোগ্রাম হয়। বিকাল ৩টায় জনসভা হওয়ার কথা থাকলেও সৈয়দ নজরুলসহ বঙ্গবন্ধু সভাস্থলে এসে পৌঁছেন রাত ৮টার পর। অপেক্ষমাণ জনস্রোতের সামনে নজরুল ইসলাম কোনো বক্তৃতা করেননি সেদিন। শেখ সাহেবই তার সংক্ষিপ্ত ভাষণে জনগণের কাছে এমএ কুদ্দুসকে ছোটভাই আর সৈয়দ নজরুলকে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে পরিচয় করিয়ে দিয়ে নৌকা মার্কায় ভোটদানের আহ্বান জানান। মাঠভর্তি জনতা সমস্বরে সেদিন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দেন। দুটি দিনের ঘটনাই আমার জীবনে খুবই স্মরণীয়।
দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর সরকার গঠিত হলে সৈয়দ নজরুল ইসলামের ওপর বর্তায় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার। মুক্ত-স্বাধীন দেশের মন্ত্রী হয়ে সৈয়দ নজরুল প্রথমবার করিমগঞ্জ এলে আমরা ছাত্রছাত্রীরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ফুল ছিটিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাই। আমার বেশ মনে পড়ে, ডাকবাংলো থেকে হেঁটে শিক্ষার্থীদের মাঝ দিয়ে সভামঞ্চে আসার সময় তিনি আমার এবং আমার মতো আরও কয়েকজনের মাথা ছুঁয়ে আদর করেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মাত্র আড়াই মাসের ব্যবধানে ৩ নভেম্বর কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় একই দুঃখজনক পরিণতি বরণ করতে হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে। বর্তমান প্রজন্মের কাউকে কি সহজে বিশ্বাস করানো যাবে, দীর্ঘদিন রাজনীতি এবং রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষস্তরে অবস্থান করলেও সৈয়দ নজরুল ইসলামের কোনো ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা ঢাকা শহরে একটি বাড়ি, ফ্ল্যাট বা প্লট ছিল না? স্বামীর হত্যাকাণ্ডের পর সরকারি বাড়ি ছেড়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সহধর্মিণী বেগম নাফিসা নজরুল ময়মনসিংহের কলেজ রোডে তাদের অর্ধনির্মিত প্রায় পরিত্যক্ত একতলা বাড়িটিতে গিয়ে ওঠেন এবং জীবনের শেষ দিনটিও সেখানেই কাটে তার।
বিমল সরকার : সহকারী অধ্যাপক, বাজিতপুর কলেজ; কিশোরগঞ্জ