ঢাকা ০২:২০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গ্রামের মানুষ ধার করে চলছে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৫৪:০০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৪ নভেম্বর ২০১৭
  • ২৫৭ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া উপজেলার খোর্দ কৈইডাঙ্গা গ্রামের সিরাজুল ইসলামের সংসারে অনেক উন্নতি হয়েছে। তবুও তাকে মাঝে মাঝে অন্যের কাছ থেকে, অথবা স্থানীয় সমিতি থেকে টাকা ধার করে সংসার চালাতে হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপেও বলা হয়েছে, গ্রামের মানুষের গড় মাসিক আয়ের চেয়ে গড় মাসিক ব্যয় বেশি।

এ প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম হাওর বার্তাকে জানান, তার পরিবারে আয় করার মানুষ একজন,অথচ ব্যয়ের মানুষ পাঁচ জন। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে যে টাকা আয় করেন, তার চেয়ে বেশি টাকা তাকে ব্যয় করতে হয়। তিনি বলেন, ‘আয় করে না এমন ব্যক্তি শহরের পরিবারগুলোতে খুব বেশি দেখা না গেলেও গ্রামের পরিবারে বাবা-মা,ভাই- বোনসহ অনেকে থাকেন, যারা আয় করেন না।’

কেবল সিরাজুল ইসলামই নয়, গ্রামের অধিকাংশ পরিবারকে এখন ধার করে সংসার চালাতে হয়। একই উপজেলার চরপাড়া গ্রামের এখলাস আলীর পরিবার ধার-দেনা থেকে বের হতেই পারছে না। যদিও তাদের সংসারে আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। এখলাস আলী হাওর বার্তাকে জানান, তার সংসার চালাতে গিয়ে মাঝে-মধ্যেই স্থানীয় একটি সমিতির কাছ থেকে টাকা ধার নিতে হয়।

বিবিএস-এর প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সাল শেষে  গ্রামের মানুষের গড় মাসিক আয়ের চেয়ে গড় মাসিক ব্যয় হয়েছে বেশি। ২০১৬ সালে গ্রামীণ এলাকার প্রতি পরিবারের গড় মাসিক আয় ছিল ১৩ হাজার ৩৫৩ টাকা। আর তাদের মাসিক গড় ব্যয় করতে হয়েছে ১৪ হাজার ১৫৬ টাকা। বিবিএস ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে সারাদেশের ৪৬ হাজার ৮০টি পরিবারের আয়-ব্যয়ের ওপর এ জরিপ চালিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত হাওর বার্তাকে বলেন, ‘শহরে যেভাবে শিল্প-কারখানা বা অবকাঠামো গড়ে ওঠে, গ্রামে সেভাবে ওঠে না। ফলে গ্রামের মানুষের যে পরিমাণ কর্মসংস্থান হওয়ার কথা, সেটা হয়নি। আবার বিবিএস-এর জরিপ চলাকালীন সময়ে গ্রামের মানুষ তাদের উৎপাদিত পণ্য ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারেনি। ফলে গ্রামে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে।’

বিবিএস-এর তথ্য মতে, গ্রামের মানুষের ৫০ দশমিক ৪৯ শতাংশ ব্যয় করতে হয় খাদ্য ও পানীয়ের পেছনে।  সাড়ে ৭ শতাংশ ব্যয় হয় পোশাক ও জুতার পেছনে, ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ আবাসন ও বাড়িভাড়ায়, জ্বালানিতে ব্যয় হয় ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ, চিকিৎসায় ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং শিক্ষায় গ্রামের মানুষের ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ ব্যয় করতে হয়।

বিবিএস-এর জরিপ অনুযায়ী, সার্বিকভাবে শহরের একটি পরিবার এখন গ্রামের একটি পরিবারের তুলনায় প্রায় গড়ে ৭০ শতাংশ বেশি আয় করে। শহরের পরিবারের গড় আয় ২২ হাজার ৫৬৫ টাকা। আর গ্রামের পরিবারের  গড়ে আয় ১৩ হাজার ৩৫৩ টাকা।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন হাওর বার্তাকে বলেন, ‘বিবিএস যে সময়ে জরিপটি চালিয়েছে, ওই সময়টাতে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে একটা বড় ধস নেমেছিল। আবার একই সময়ে দেশে কর্মসংস্থানও বাড়েনি। ফলে গ্রামের মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় তখন বেশি করতে হয়েছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘রেমিট্যান্স মূলত গ্রামের মানুষের কাছে যায়। আর আগে যেহেতু গ্রামের মানুষ রেমিট্যান্স থেকে খরচ বৃদ্ধি করেছিল, হঠাৎ রেমিট্যান্সে ধস নামায় তারা বিপাকে পড়ে। বাধ্য হয়ে তাদের ধার করতে হয়েছে, অথবা সঞ্চয় ভেঙে খেতে হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘গ্রামের মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বাড়ার আরেকটি কারণ হলো- জরিপ চালানোর সময়ে দেশে কর্মসংস্থান বাড়েনি।’

বিবিএস-এর জরিপে আয়ের ভিত্তিতে দেশের পরিবারগুলোকে ১২ ভাগে বিভক্ত করে জাতীয় আয়ে কাদের কত অনুপাত, তা দেখানো হয়েছে। মৌলিক চাহিদার ব্যয় (কস্ট অব বেসিক নিডস) পদ্ধতির মাধ্যমে দারিদ্র্য পরিস্থিতি পরিমাপ করেছে বিবিএস।

বিবিএস-এর তথ্য মতে, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা রয়েছে ৩ কোটি ৯৩ লাখ। হতদরিদ্রের সংখ্যা ২ কোটি ৮ লাখ। ২০১৬ সালের শেষে দেশের মোট জনসংখ্যার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ দরিদ্র ছিল।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্যের হার কমলেও এখনও দেশের সাতটি জেলার অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে।  বিবিএসের হিসাব মতে, দেশের সবচেয়ে বেশি গরিব মানুষ রয়েছে উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম জেলায়। এ জেলার ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ এখনও দরিদ্র। দিনাজপুরে ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ, জামালপুরে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ, কিশোরগঞ্জে ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ ও মাগুরায় ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। বান্দরবানের ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ ও খাগড়াছড়ির ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

গ্রামের মানুষ ধার করে চলছে

আপডেট টাইম : ১১:৫৪:০০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৪ নভেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া উপজেলার খোর্দ কৈইডাঙ্গা গ্রামের সিরাজুল ইসলামের সংসারে অনেক উন্নতি হয়েছে। তবুও তাকে মাঝে মাঝে অন্যের কাছ থেকে, অথবা স্থানীয় সমিতি থেকে টাকা ধার করে সংসার চালাতে হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপেও বলা হয়েছে, গ্রামের মানুষের গড় মাসিক আয়ের চেয়ে গড় মাসিক ব্যয় বেশি।

এ প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম হাওর বার্তাকে জানান, তার পরিবারে আয় করার মানুষ একজন,অথচ ব্যয়ের মানুষ পাঁচ জন। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে যে টাকা আয় করেন, তার চেয়ে বেশি টাকা তাকে ব্যয় করতে হয়। তিনি বলেন, ‘আয় করে না এমন ব্যক্তি শহরের পরিবারগুলোতে খুব বেশি দেখা না গেলেও গ্রামের পরিবারে বাবা-মা,ভাই- বোনসহ অনেকে থাকেন, যারা আয় করেন না।’

কেবল সিরাজুল ইসলামই নয়, গ্রামের অধিকাংশ পরিবারকে এখন ধার করে সংসার চালাতে হয়। একই উপজেলার চরপাড়া গ্রামের এখলাস আলীর পরিবার ধার-দেনা থেকে বের হতেই পারছে না। যদিও তাদের সংসারে আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। এখলাস আলী হাওর বার্তাকে জানান, তার সংসার চালাতে গিয়ে মাঝে-মধ্যেই স্থানীয় একটি সমিতির কাছ থেকে টাকা ধার নিতে হয়।

বিবিএস-এর প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সাল শেষে  গ্রামের মানুষের গড় মাসিক আয়ের চেয়ে গড় মাসিক ব্যয় হয়েছে বেশি। ২০১৬ সালে গ্রামীণ এলাকার প্রতি পরিবারের গড় মাসিক আয় ছিল ১৩ হাজার ৩৫৩ টাকা। আর তাদের মাসিক গড় ব্যয় করতে হয়েছে ১৪ হাজার ১৫৬ টাকা। বিবিএস ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে সারাদেশের ৪৬ হাজার ৮০টি পরিবারের আয়-ব্যয়ের ওপর এ জরিপ চালিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত হাওর বার্তাকে বলেন, ‘শহরে যেভাবে শিল্প-কারখানা বা অবকাঠামো গড়ে ওঠে, গ্রামে সেভাবে ওঠে না। ফলে গ্রামের মানুষের যে পরিমাণ কর্মসংস্থান হওয়ার কথা, সেটা হয়নি। আবার বিবিএস-এর জরিপ চলাকালীন সময়ে গ্রামের মানুষ তাদের উৎপাদিত পণ্য ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারেনি। ফলে গ্রামে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে।’

বিবিএস-এর তথ্য মতে, গ্রামের মানুষের ৫০ দশমিক ৪৯ শতাংশ ব্যয় করতে হয় খাদ্য ও পানীয়ের পেছনে।  সাড়ে ৭ শতাংশ ব্যয় হয় পোশাক ও জুতার পেছনে, ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ আবাসন ও বাড়িভাড়ায়, জ্বালানিতে ব্যয় হয় ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ, চিকিৎসায় ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং শিক্ষায় গ্রামের মানুষের ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ ব্যয় করতে হয়।

বিবিএস-এর জরিপ অনুযায়ী, সার্বিকভাবে শহরের একটি পরিবার এখন গ্রামের একটি পরিবারের তুলনায় প্রায় গড়ে ৭০ শতাংশ বেশি আয় করে। শহরের পরিবারের গড় আয় ২২ হাজার ৫৬৫ টাকা। আর গ্রামের পরিবারের  গড়ে আয় ১৩ হাজার ৩৫৩ টাকা।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন হাওর বার্তাকে বলেন, ‘বিবিএস যে সময়ে জরিপটি চালিয়েছে, ওই সময়টাতে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে একটা বড় ধস নেমেছিল। আবার একই সময়ে দেশে কর্মসংস্থানও বাড়েনি। ফলে গ্রামের মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় তখন বেশি করতে হয়েছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘রেমিট্যান্স মূলত গ্রামের মানুষের কাছে যায়। আর আগে যেহেতু গ্রামের মানুষ রেমিট্যান্স থেকে খরচ বৃদ্ধি করেছিল, হঠাৎ রেমিট্যান্সে ধস নামায় তারা বিপাকে পড়ে। বাধ্য হয়ে তাদের ধার করতে হয়েছে, অথবা সঞ্চয় ভেঙে খেতে হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘গ্রামের মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বাড়ার আরেকটি কারণ হলো- জরিপ চালানোর সময়ে দেশে কর্মসংস্থান বাড়েনি।’

বিবিএস-এর জরিপে আয়ের ভিত্তিতে দেশের পরিবারগুলোকে ১২ ভাগে বিভক্ত করে জাতীয় আয়ে কাদের কত অনুপাত, তা দেখানো হয়েছে। মৌলিক চাহিদার ব্যয় (কস্ট অব বেসিক নিডস) পদ্ধতির মাধ্যমে দারিদ্র্য পরিস্থিতি পরিমাপ করেছে বিবিএস।

বিবিএস-এর তথ্য মতে, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা রয়েছে ৩ কোটি ৯৩ লাখ। হতদরিদ্রের সংখ্যা ২ কোটি ৮ লাখ। ২০১৬ সালের শেষে দেশের মোট জনসংখ্যার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ দরিদ্র ছিল।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্যের হার কমলেও এখনও দেশের সাতটি জেলার অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে।  বিবিএসের হিসাব মতে, দেশের সবচেয়ে বেশি গরিব মানুষ রয়েছে উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম জেলায়। এ জেলার ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ এখনও দরিদ্র। দিনাজপুরে ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ, জামালপুরে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ, কিশোরগঞ্জে ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ ও মাগুরায় ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। বান্দরবানের ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ ও খাগড়াছড়ির ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে।