হাওর বার্তা ডেস্কঃ পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা অস্তমিত হয়। মীরমদন, মোহনলালের অসামান্য বীরত্ব সত্ত্বেও মীরজাফর, উমি চাঁদ, রায় দুর্লভদের বিশ্বাসঘাতকতায় সিরাজ বাহিনী ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়।
বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার স্বাধীনতা শুধু নয়, কালক্রমে ভারতবর্ষ ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পদানত হয়ে যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষের মালিক মোক্তার বনে যায়। তবে তখনো দিল্লিতে ছিল মোগল সম্রাটের কাগুজে অস্তিত্ব। ক্ষমতাহীন দিল্লির সম্রাট ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পেনশনভোগী। বছরে এক লাখ টাকা ভাতা পেতেন তিনি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত শাসনের বৈধতা পেয়েছিল দিল্লির মোগল সম্রাটের ফরমান বলে। সে কারণে তারা সম্রাটের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। তবে রাজপ্রাসাদের বাইরে সম্রাটের কোনো কর্তৃত্বই ছিল না। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহী হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এদেশীয় সেনারা।
তারা শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে। দিল্লিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয় বিদ্রোহীদের কর্তৃত্ব। সিপাহি বিদ্রোহ তথা ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের ঢেউ অনুভূত হয় ঢাকা চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশেও। সে বিদ্রোহের স্মৃতি বহন করছে পুরনো ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক।
বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর যেখানে শত শত স্বাধীনতা সংগ্রামীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। লালবাগ দুর্গেও ফাঁসি দেওয়া হয় অসংখ্য সৈনিককে। পলাশী প্রান্তরে নবাব সিরাজউদদৌলার পরাজয় বাংলা বিহার উড়িষ্যার স্বাধীনতার সূর্য নিভিয়ে দেয়। তারপর একে একে সারা ভারতবর্ষও স্বাধীনতা হারায়। সে সময়ও প্রতিবেশী বার্মা বা আজকের মিয়ানমার ছিল স্বাধীন দেশ।
১৯২৮ সালে সে দেশও চলে আসে ইংরেজদের অধীনে। ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত বার্মা ছিল ভারতবর্ষেরই একটি প্রদেশ। রটনা রয়েছে ইংরেজরা বার্মায় অভিযান চালিয়েছিল স্টিমারযোগে। স্টিমারের কালো ধোঁয়া ও হুইসেলের শব্দ শুনে ঘাবড়ে যায় বর্মিরা। এটাকে স্বর্গলোক থেকে আসা দৈত্যদানব ভেবে পালিয়ে যায় তারা। বিনা যুদ্ধেই প্রথম দফায় হার মানে বর্মিরা।
বলছিলাম ভারতবর্ষের স্বাধীনতা হারানোর কথা। সিপাহি বিদ্রোহের মাধ্যমে সে স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার যে চেষ্টা চলে তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ইংরেজরা বৃদ্ধ সম্রাটকে বন্দী করে। মোগল রাজপুত্রদের নির্দয়ভাবে ফাঁসিতে ঝোলায়। কেড়ে নেওয়া হয় সম্রাটের সব অধিকার। মোগল শাসনের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তিও ঘোষণা করে তারা।
বৃদ্ধ সম্রাট শাহ আলম জাফরকে নির্বাসন দেওয়া হয় বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনে। ভারতবর্ষের শেষ মোগল সম্রাট সেখানে অভাব-অনটন আর অনাদর-অবহেলায় প্রাণ হারান। রেঙ্গুনে এখনো রয়েছে হতভাগ্য সম্রাট বাহাদুর শাহের সমাধি স্থল। বাহাদুর শাহ ছিলেন অসামান্য কাব্য প্রতিভার অধিকারী। তার কবরে এপিটাফ হিসেবে লেখা রয়েছে তারই লেখা পঙিক্ত।
যা তিনি মৃত্যুর আগে লিখে গিয়েছিলেন। পঙিক্তটা হলো— ‘কিতনা বদ নসিব হ্যায় জাফর দাফনকে লিয়ে দু’গজ জমিন ভি না মিলি কু ইয়ারমে।’ যার বাংলা করলে দাঁড়ায় কেমন বদ নসিব তোমার জাফর দাফনের জন্য স্বদেশে দুই গজ জায়গাও পেলে না।
বার্মার সরল-সোজা মানুষ স্টিমারের হুইসেল আর কালো ধোঁয়া দেখে স্বর্গালোক থেকে আসা দৈত্য-দানব ভেবে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ না করে পালিয়ে যায়। তবে ঘোর কাটার সঙ্গে সঙ্গে তারা রুখে দাঁড়ায়। ফলে বার্মা দখল ইংরেজদের জন্য খুব একটা সহজ হয়নি। সিপাহি বিদ্রোহের আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও বার্মার দ্বিতীয় যুদ্ধে সে দেশ পুরোপুরিভাবে পদানত হয়।
ভারতবর্ষের পাশাপাশি নিভে যায় বার্মার স্বাধীনতার সূর্য। সে দেশের পরাজিত রাজা থিবোকে নির্বাসনে পাঠানো হয় ভারতে। তাকে বছরে মাসোহারা দেওয়া হতো মাত্র ৬০০ টাকা। বার্মা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৪৮ সালে। ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের এক বছর পরে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চির বাবা জেনারেল অং সান। ভারতের স্বাধীনতার মহানায়ক মহাত্মা গান্ধী, শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপিতা বন্দর নায়েক এবং বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো জেনারেল অং সানকে প্রাণ হারাতে হয় অপঘাতে।
দুই. বিশাল দেশ মিয়ানমারেরই একটি রাজ্য রাখাইন। সাড়ে তিন হাজার ফুট উচ্চ পর্বতমালা এ রাজ্যকে দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। রাখাইনেরই প্রাচীন নাম আরাকান। বাংলাদেশ ও আরাকানকে বিভক্ত করেছে নাফ নদ। শত শত বছর ধরে আরাকানের সঙ্গে বাংলাদেশের গভীর যোগাযোগ ছিল। আরাকান স্বাধীন দেশ হিসেবে নিজের অস্তিত্ব অটুট রেখেছে অন্তত ৪৩০০ বছর ধরে।
খ্রিস্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত এটি ছিল মোটামুটিভাবে স্বাধীন দেশ। ১৭৮৫ সালে আরাকানের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে বার্মারাজ বোধপায়া আরাকান দখল করেন। তার আগে আরাকানের রাজারা টিকে ছিলেন দাপটের সঙ্গে। আরাকান তো বটেই চট্টগ্রামও এক সময় ছিল তাদের দখলে। মগ নামের রাখাইন দস্যুদের উৎপাত ছিল বাংলাদেশজুড়ে। বাংলার মোগল সুবেদার শায়েস্তা খান দুর্বিনীত মগদের শায়েস্তা করেন।
চট্টগ্রামকে তিনি মুক্ত করেন মগ তথা আরাকান রাজের আধিপত্য থেকে। মগ বন্দীদের শায়েস্তা খান ঢাকায় এনে রাখেন যে স্থানে— সেটির নাম এখন মগবাজার। আরাকান বা আজকের রাখাইনের একটি জাতি-গোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গাদের সিংহ ভাগ মুসলমান। তবে তাদের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীও রয়েছে।
মিয়ানমারের সরকার এবং রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক কিংবা স্বীকৃত জাতিসত্তা হিসেবে মানতে নারাজ। বাংলাদেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গার শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণের পেছনে একটি জাতিসত্তাকে অস্বীকার করার অশুভ প্রবণতা। রোহিঙ্গা নিধনেও উঠে পড়ে লেগেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। রাখাইন মিলিশিয়ারা তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের পূর্ব-পুরুষরা ৬০০ বছর আগে আরাকানে গিয়েছিল সে দেশের রাজা নরমেইখলার ডাকে। ১৪০৬ সালে বার্মার রাজা মেং শো আই আরাকানে অভিযান চালান। রাজা নরমেইখলা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বাংলার রাজধানী গৌড়ে পালিয়ে আসেন। সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহর কাছে তিনি আশ্রয় প্রার্থনা করেন। সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ আরাকানকে বর্মি আধিপত্য থেকে মুক্ত করতে রাজা নরমেইখলাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন।
মনে করা হয় এ বাঙালি সৈন্যরা রোহিঙ্গাদের পূর্ব-পুরুষ। এর আগে থেকে অবশ্য রাখাইনের সঙ্গে আরব মুসলমানদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। এমনকি সংখ্যায় ক্ষুদ্র হলেও সে দেশে একটি ক্ষুদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বও ছিল। যারা কালক্রমে রোহিঙ্গা হিসেবেই পরিচিত হয়।
রাজা নরমেইখলার আমলে আরাকান রাজ দরবারে বাংলা ভাষা দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা পায়। শুধু মর্যাদা দেওয়া নয়, মধ্যযুগে বাংলাভাষা চর্চার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় আরাকানের রাজ দরবার। আরাকান রাজাদের আমলে মহাকবি আলাওল রাজ দরবার আলোকিত করেছেন কাব্য রচনার মাধ্যমে। মনে করা হয়, আরাকানের রাজপরিবারের পূর্ব পুরুষরা এসেছিলেন দক্ষিণ বিহারের মগধ থেকে।
ভাষা বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, মগধি ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। মধ্যযুগের আলাওল শুধু নয়, দৌলত কাজীর মতো প্রতিভাবান কবিও আরাকান দরবারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন। তার কবিতায় আরাকান রাজারা যে মগধ বংশের সে পরিচয় স্পষ্ট।
কবি দৌলত কাজীর সতী ময়না কাব্যে উল্লেখ আছে—‘কর্ণফুলী নদী পূর্বে আছে এক পুরী। /রোসাঙ্গ নগরী নাম স্বর্গ-অবতরী/ তাহাতে মগধ বংশ ক্রমে বুদ্ধার চার। /নাম শ্রী সুধর্ম রাজা ধর্মের অবতার/ অনুভব করা যায় সে সময় বাংলা ভাষার বিকাশে আরাকানের রাজ দরবার ছিল এগিয়ে। রাখাইন ও রোহিঙ্গারা শান্তিতে বসবাস করেছে আরাকান বা আজকের রাখাইন রাজ্যে।
তিন. রাখাইনে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের সম্পর্কের অবনতি কখন থেকে শুরু হয় তা সুনিশ্চিত করে বলার অবকাশ নেই। রাখাইন রাজাদের অন্তঃদ্বন্দ্বের সুযোগে ১৭৮৪ সালে বার্মা আরাকান দখল করে। ১৮২৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বার্মায় অভিযান চালায়। কালক্রমে বার্মা ইংরেজ শাসনাধীনে চলে যায়।
বার্মা ভারতবর্ষের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। সে সময় হাজার হাজার বাঙালি তো বটেই ভারতের অন্যান্য রাজ্যের অধিবাসীরা বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন এবং আরাকানের রাজধানী আকিয়াবে ভাগ্যান্বেষণে ছুটে যায়। স্বাধীন বার্মার স্থপতি অং সান নিজে ছিলেন বর্মি। তবে জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে তিনি বার্মার সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সমর্থন আদায়ে সমর্থ হন।
রোহিঙ্গাদের সমর্থনও ছিল অং সানের পেছনে। বার্মার জনসংখ্যার ৩০ ভাগ ১৪০টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতি অং সানের এই মমত্বকে বর্মি রক্ষণশীলরা ভালো চোখে দেখেনি। স্বাধীনতার বছরেই প্রাণ হারান অং সান ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা। ১৯৬২ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করলে সে দেশের সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের স্টিম রোলার নেমে আসে।
রোহিঙ্গাদের তো সামরিক জান্তা সে দেশের কোনো জাতি-গোষ্ঠী বলেই মনে করত না। ১৯৭৮ সালে তাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের বিভীষিকা। সশস্ত্র সংগঠনের অপতৎপরতা ঠেকাতে সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর। লাখ লাখ রোহিঙ্গা সে সময় প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
১৯৯১-৯২, ২০১২ ও ২০১৬ সালেও ঘটে একই ধরনের অভিযান। প্রতিবারই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা দেশত্যাগী হয়। এ বছর রোহিঙ্গা নির্যাতন শুধু জাতিগত নিধন নয়, গণহত্যার পর্যায়ে পৌঁছেছে। রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে মিয়ানমারের ক্ষমতাদর্পী জেনারেলরা।
চার. মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা একটি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী। আরব, বাঙালি ও আরাকান রক্তের উত্তরসূরি তারা। প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের বাংলা ভাষার সঙ্গে রোহিঙ্গা ভাষার মিল থাকলেও তারা নিজেদের বাঙালি বলে মনে করে না। রোহিঙ্গাদের ওপর আজ যে পৈশাচিক নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে তার পেছনে নিজেদের ভুল যেমন দায়ী তেমন দায়ী মিয়ানমারবাসীর বাঙালি বিদ্বেষ।
ব্রিটিশ শাসনামলে মিয়ানমারের প্রশাসনসহ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয় ভারত থেকে যাওয়া লোকজন। যাদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যাই ছিল বেশি। বাঙালি বাবুরা সেখানে সুদের ব্যবসা করে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন। বর্মি মেয়েদের বিয়ে করে পরে পালিয়ে এসেছে দেশে। এ আচরণ বর্মিদের মধ্যে যে বাঙালি বিদ্বেষ সৃষ্টি করে তারই শিকার এখন রোহিঙ্গারা।
তাদের অদূরদর্শিতাও আজকের পরিণামের জন্য কিছুটা হলেও দায়ী। ১৯৪৬ সালে রোহিঙ্গা নেতারা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করে আরাকানকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন করে। দূরদর্শী জিন্নাহ এ প্রস্তাবে রাজি হননি। বার্মার প্রদেশ আরাকানকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ব্যাহত করতে পারে ভেবে জিন্নাহ সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থার মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত হয় আরাকান বা রাখাইন রাজ্য। সে দেশের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোকে মদদ জুগিয়েছে উলঙ্গভাবে। যে তথ্য উঠে এসেছে পাকিস্তানের বিভিন্ন সরকারের আমলে উপদেষ্টাসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনকারী কূটনীতিক হুসেন হাক্কানীর বই ‘পাকিস্তান বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি’ গ্রন্থে।
রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠনগুলোর প্রতি পাকিস্তানি সেনা গোয়েন্দা সংস্থার মদদ এবং আল-কায়েদা ও আইএস কানেকশন রোহিঙ্গাদের প্রতি বর্মি ও রাখাইনদের বিদ্বেষই শুধু বাড়িয়েছে। সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠনের সম্পর্ক না থাকলেও তারাই সব নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলো বর্মি জেনারেলদের শিখণ্ডী হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
মিয়ানমার নেত্রী অং সান সু চি রাখাইনে জাতিগত সংঘাত নিরসনে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিশন গঠন করে দিয়েছিলেন। যে কমিশন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দান এবং অবাধ চলাচলের অধিকার দানের সুপারিশ করে। কমিশন তাদের রিপোর্ট পেশের আট ঘণ্টার মধ্যে সেনাবাহিনী ও পুলিশের ৩০টি স্থাপনায় রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন আরসা হামলা চালায়। তারপর শুরু হয় রোহিঙ্গা নিধন।
সোজা কথায় রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনা ও রাখাইনি রাজাকারদের যে নৃশংসতা নেমে এসেছে তার দায় রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোরও কম নয়। জঙ্গিবাদ একটি বিশ্বজনীন সমস্যা এবং দুনিয়া কোনো দেশ তা থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু হাতেগোনা কিছু দুর্বৃত্তের দায় রোহিঙ্গাদের ওপর চাপিয়ে বর্মি সরকার যেভাবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
পাঁচ. মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধনে সে দেশের সেনাবাহিনীর কলকাঠি নাড়ার বিষয়টি স্পষ্ট। তবে এ ব্যাপারে সু চির ভূমিকাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। এ লেখার সময় এক বন্ধু বললেন, সু চির কর্মকাণ্ডে প্রতিহিংসা পরায়ণতাই প্রকাশ পাচ্ছে। সবারই জানা, সু চির জন্ম এক অসাম্প্রদায়িক পরিবারে। তার বাবা অং সান বৌদ্ধ মুসলিম খ্রিস্টান হিন্দু সব ধর্মাবলম্বীর মানুষকে কাছে ডেকেছিলেন।
বর্মি শুধু নয়, ১৪০টি জাতিসত্তার আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীদের একজন ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। অং সান তাকে শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বর্মি উগ্রজাতীয়তাবাদীরা অং সানের পাশাপাশি আবদুর রাজ্জাককেও হত্যা করে।
অং সান সু চি যখন অক্সফোর্ডের ছাত্রী তখন তার সহপাঠী ছিলেন তারেক হায়দার নামের এক পাকিস্তানি যুবক। দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারেকের প্রেমে সুচি এতটাই হাবুডুবু খেয়েছেন যে, তার পড়াশোনাও লাটে ওঠে। প্রেমিককে বিয়ে করে ঘরসংসার বাঁধার স্বপ্নও দেখতেন তিনি। কিন্তু তারেক সুচিকে দেওয়া ওয়াদা রাখেননি।
পড়াশোনা শেষে তিনি চলে যান স্বদেশে। অক্সফোর্ডে আসার আগে তিনি পাকিস্তানের ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৃত্তি নিয়েই উচ্চশিক্ষার জন্য আসেন লন্ডনে। সু র সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করলেও উচ্চাভিলাষী তারেক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দামি চাকরি হাতছাড়া করতে চাননি। মেধাবী ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও তারেকের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ায় তৃতীয় বিভাগে পাস করেন সুচি।
প্রেমিক তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মানসিকভাবে অসুস্থ হয়েও পড়েন তিনি। এ অবস্থায় পারিবারিক বন্ধু ক্রিস্টোফার সুচিকে হতাশা থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। পরিচয় করিয়ে দেন তার বন্ধু মাইকেল অ্যারিসের সঙ্গে। সুচির শূন্য জীবন ভরিয়ে তোলেন অ্যারিস। পরে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
বলা হয়, তারেক হায়দারের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সুচি মুসলিম-বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার আসল চেহারা তার জানা থাকলেও রোহিঙ্গা নিধনে তিনি তাদের শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন। কারণ রোহিঙ্গাদের সিংহ ভাগই মুসলমান। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। বিডি প্রতিদিন
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।