ঢাকা ১০:৪৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরের বনে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে হিজল গাছ—

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:৫৫:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ অক্টোবর ২০১৭
  • ৯০০ বার

জাকির হোসাইন :ঝিল বিল ডোবা জলাশয় হাওরের এলাকার বন ও অন্যসব তৃণলতার মতো হারিয়ে যাচ্ছে হিজল গাছ। হাওরবেষ্টিত উপজেলা মিঠামইন,অষ্টগ্রাম,ইটনা এখন কোথাও চোখে পড়ে না হিজল গাছ। এক সময় এ উপজেলার নদীর তীরে, খালের পাড়ে, বিল, ঝিল, ডোবা, জলাশয়ের উঁচু জায়গায় দূর হাওরে চোখে পড়তো হিজল গাছ। কিন্তু এখন তার অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে হাওর থেকে।

হাওরে হিজল গাছ প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয়। এই গাছ নানাভাবে হাওরের জীববৈচিত্রের সমৃদ্ধি ও উপকার করে। এটি জলজ প্রকৃতির বৃক্ষ, বর্ষায় মাছের খাবার তৈরিতে সাহায্য করে। পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। জেলে ও কৃষকের বন্ধু। প্রখর রৌদ্রে কৃষক এর ছায়ায় আশ্রয় নিতে পারে। আফাল, ঢেউ, তুফানে ঘরবাড়ি ভাঙ্গনের হাত থেকে এটি প্রতিরক্ষার কাজও করে। হিজল মাঝারি আকারের চিরহরিৎ গাছ। বাকল ঘন ছাই রংঙের ও পুরু ডালপালার বিস্তার চার দিকে। জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে এবং দীর্ঘদিন বাঁচে। এর কাঠ নরম সাদা বর্ণের, উজ্জ্বল ও মসৃণ। নৌকা তৈরি ও সস্তা আসবাব তৈরি করা যায়। জ্বালানী কাজেও ব্যবহার করা যায়।

এর সাইন্টিফিক নাম Barring tonia acutangula gaerin। সংস্কৃতি ভাষায় একে নিচুল বলে। নদীক্রান্ত, জলন্তকার্ম্মক্ত এবং দীর্ঘ পত্রক নামেও পরিচিত। হিজল ফোটে বৈশাখ ও জৈষ্ঠ মাসে। গোলাপী রঙের হিজল লম্বা পুষ্পদণ্ডের মধ্যে অসংখ্য ফুল ঝুলন্ত অবস্থায় ফোটে। রাত বাড়ার সাথে সাথে ফুল ফোটা শুরু হয়। সকালের আলোয় ঝরে যায়। হিজলতলায় সকালে গেলে মনে হবে গোলাপ বিছানো পাতা। রাতে বা ভোরে হিজলতলার সামনে দিয়ে গেলে বা দূর থেকেও এর মাদকতাপূর্ণ মিষ্টি ঘ্রাণে মাতাল হতে হয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় হিজল গাছের বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি কবিতায় লিখেছেন “পিছল পথে কুড়িয়ে পেলাম হিজল ফুলের মালা, কি করি এ মালা নিয়ে বল চিকন কালা…..। এর ফুল শেষে ফল হয় যা দেখতে অনেকটা হরতকির মতো। আজ হাওর থেকে চিরহরিৎ হিজল গাছ নির্মূল হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

সরেজমিনে মিঠামইন উপজেলার হাওরের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গত দশ বছরে যে সব বৃক্ষ লাগানো হয়েছে তার বেশিরভাগ বিদেশী রেইনট্রি, ইউকেলিপটাস বা পরিচিত নাম আকাশী, মেহগনি, নিম প্রভৃতি। পরিবেশবিদের মতে এসকল বৃক্ষ হাওরে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। কারণ আকাশী গাছের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়, এতে করে ভবিষ্যতে সেচের অভাব প্রকট হতে পারে। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে হাওরের কৃষি জমি। সচেতন মহল মনে করেন হাওরের চিরচেনা সবুজ রূপ ও জীববৈচিত্র ফিরিয়ে আনতে হিজল গাছ এখন থেকেই পরিকল্পিতভাবে রোপন করতে হবে। হিজল গাছ কি কারণে হারিয়ে যাচ্ছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়েছিল এলাকার কয়েক জন কৃষকের কাছে। তারা জানান, হিজল গাছ মূলত অযত্ন আর অবহেলার কারণে এর প্রজনন হারিয়ে যাচ্ছে। ক্ষেতের আইল কৃষক ছোট করেছে বলে হিজল গাছ রোপন করার জায়গাও থাকে না। তবে নার্সারীতে চারা উৎপাদন করে পরিকল্পিতভাবে রোপন করলে হাওরে হিজল গাছ বনায়ন তৈরিতে সহায়ক হবে। এবং বিলুপ্ত হওয়া থেকেও বেচে যাবে। মিঠামইনের হাওরগুলোর সৌন্দর্য আর আবহমান নৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টিতে হিজল গাছের বিকল্প আর কোন গাছ হয় না। বর্ষায় হাওর পর্যটকদের মুগ্ধ করতে পারে হিজল গাছ।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

হাওরের বনে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে হিজল গাছ—

আপডেট টাইম : ০৯:৫৫:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ অক্টোবর ২০১৭

জাকির হোসাইন :ঝিল বিল ডোবা জলাশয় হাওরের এলাকার বন ও অন্যসব তৃণলতার মতো হারিয়ে যাচ্ছে হিজল গাছ। হাওরবেষ্টিত উপজেলা মিঠামইন,অষ্টগ্রাম,ইটনা এখন কোথাও চোখে পড়ে না হিজল গাছ। এক সময় এ উপজেলার নদীর তীরে, খালের পাড়ে, বিল, ঝিল, ডোবা, জলাশয়ের উঁচু জায়গায় দূর হাওরে চোখে পড়তো হিজল গাছ। কিন্তু এখন তার অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে হাওর থেকে।

হাওরে হিজল গাছ প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয়। এই গাছ নানাভাবে হাওরের জীববৈচিত্রের সমৃদ্ধি ও উপকার করে। এটি জলজ প্রকৃতির বৃক্ষ, বর্ষায় মাছের খাবার তৈরিতে সাহায্য করে। পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। জেলে ও কৃষকের বন্ধু। প্রখর রৌদ্রে কৃষক এর ছায়ায় আশ্রয় নিতে পারে। আফাল, ঢেউ, তুফানে ঘরবাড়ি ভাঙ্গনের হাত থেকে এটি প্রতিরক্ষার কাজও করে। হিজল মাঝারি আকারের চিরহরিৎ গাছ। বাকল ঘন ছাই রংঙের ও পুরু ডালপালার বিস্তার চার দিকে। জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে এবং দীর্ঘদিন বাঁচে। এর কাঠ নরম সাদা বর্ণের, উজ্জ্বল ও মসৃণ। নৌকা তৈরি ও সস্তা আসবাব তৈরি করা যায়। জ্বালানী কাজেও ব্যবহার করা যায়।

এর সাইন্টিফিক নাম Barring tonia acutangula gaerin। সংস্কৃতি ভাষায় একে নিচুল বলে। নদীক্রান্ত, জলন্তকার্ম্মক্ত এবং দীর্ঘ পত্রক নামেও পরিচিত। হিজল ফোটে বৈশাখ ও জৈষ্ঠ মাসে। গোলাপী রঙের হিজল লম্বা পুষ্পদণ্ডের মধ্যে অসংখ্য ফুল ঝুলন্ত অবস্থায় ফোটে। রাত বাড়ার সাথে সাথে ফুল ফোটা শুরু হয়। সকালের আলোয় ঝরে যায়। হিজলতলায় সকালে গেলে মনে হবে গোলাপ বিছানো পাতা। রাতে বা ভোরে হিজলতলার সামনে দিয়ে গেলে বা দূর থেকেও এর মাদকতাপূর্ণ মিষ্টি ঘ্রাণে মাতাল হতে হয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় হিজল গাছের বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি কবিতায় লিখেছেন “পিছল পথে কুড়িয়ে পেলাম হিজল ফুলের মালা, কি করি এ মালা নিয়ে বল চিকন কালা…..। এর ফুল শেষে ফল হয় যা দেখতে অনেকটা হরতকির মতো। আজ হাওর থেকে চিরহরিৎ হিজল গাছ নির্মূল হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

সরেজমিনে মিঠামইন উপজেলার হাওরের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গত দশ বছরে যে সব বৃক্ষ লাগানো হয়েছে তার বেশিরভাগ বিদেশী রেইনট্রি, ইউকেলিপটাস বা পরিচিত নাম আকাশী, মেহগনি, নিম প্রভৃতি। পরিবেশবিদের মতে এসকল বৃক্ষ হাওরে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। কারণ আকাশী গাছের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়, এতে করে ভবিষ্যতে সেচের অভাব প্রকট হতে পারে। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে হাওরের কৃষি জমি। সচেতন মহল মনে করেন হাওরের চিরচেনা সবুজ রূপ ও জীববৈচিত্র ফিরিয়ে আনতে হিজল গাছ এখন থেকেই পরিকল্পিতভাবে রোপন করতে হবে। হিজল গাছ কি কারণে হারিয়ে যাচ্ছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়েছিল এলাকার কয়েক জন কৃষকের কাছে। তারা জানান, হিজল গাছ মূলত অযত্ন আর অবহেলার কারণে এর প্রজনন হারিয়ে যাচ্ছে। ক্ষেতের আইল কৃষক ছোট করেছে বলে হিজল গাছ রোপন করার জায়গাও থাকে না। তবে নার্সারীতে চারা উৎপাদন করে পরিকল্পিতভাবে রোপন করলে হাওরে হিজল গাছ বনায়ন তৈরিতে সহায়ক হবে। এবং বিলুপ্ত হওয়া থেকেও বেচে যাবে। মিঠামইনের হাওরগুলোর সৌন্দর্য আর আবহমান নৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টিতে হিজল গাছের বিকল্প আর কোন গাছ হয় না। বর্ষায় হাওর পর্যটকদের মুগ্ধ করতে পারে হিজল গাছ।