ইতিহাসের বর্বর ও ভয়াবহতম গ্রেনেড হামলার ১১তম বার্ষিকী আজ ২১ আগস্ট। জাতি শ্রদ্ধাবনতচিত্তে ভয়াবহতম গ্রেনেড হামলা দিবস স্মরণ করবে। ১১ বছর আগে ২০০৪ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়।
সেদিনের ওই ভয়াবহ হামলায় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী ও আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ নেতা-কর্মী নিহত হন। অল্পের জন্য রক্ষা পান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন নেতা ।
সারা দেশে জঙ্গিদের বোমা হামলা এবং গোপালগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক শান্তি সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশের প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান বিকেল ৫টায়।
একটি ট্রাকের ওপর তৈরি মঞ্চে তিনি ২০ মিনিটের বক্তৃতা শেষে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করার ঘোষণা দেন। এরপর তিনি মঞ্চ থেকে নিচে নেমে আসতে থাকেন। ঠিক এমন সময় শুরু হয় মঞ্চ লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড। এতে ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আরো ১২ জন নিহত হন।
এ ঘটনায় তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের প্রাক্তন উপমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি হান্নান ও প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে আকস্মিক গ্রেনেড বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে মারাত্মক বিশৃঙ্খলা, ভয়াবহ মৃত্যু ও দিনের আলো মুছে গিয়ে এক ধোয়াচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
ঢাকার তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ এবং শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাৎক্ষণিকভাবে এক মানববলয় তৈরি করে নিজেরা আঘাত সহ্য করে শেখ হাসিনাকে গ্রেনেডের হাত থেকে রক্ষা করেন।
মেয়র হা্নিফের মস্তিস্কে রক্তক্ষরণজনিত অস্ত্রোপাচার করার কথা থাকলেও গ্রেনেডের স্প্লিন্টার শরীরে থাকার কারণে তার অস্ত্রোপাচার করা সম্ভব হয়নি। পরে তিনি ব্যাংকক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এদিকে শেখ হাসিনা গ্রেনেডের আঘাত থেকে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণ শক্তি নষ্ট হয়ে যায়।
ভয়াল এই গ্রেনেড হামলায় নিহতরা হন- আইভি রহমান, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন এবং ইসাহাক মিয়া প্রমুখ ।
মারাত্মক আহত হন শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, সাঈদ খোকন, মাহবুবা পারভীন, অ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল, নাসিমা ফেরদৌস, শাহিদা তারেক দিপ্তী, রাশেদা আখতার রুমা, হামিদা খানম মনি, ইঞ্জিনিয়ার সেলিম, রুমা ইসলাম, কাজী মোয়াজ্জেম হোসেইন, মামুন মল্লিক প্রমুখ।
অভিযোগ রয়েছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিকারের ব্যাপারে তৎকালীন বিএনপি সরকার নিলিপ্ত ভূমিকা পালন করেছিল। শুধু তাই নয়, এ হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের রক্ষা করতে সরকারের কর্মকর্তারা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত পাঁচটি গ্রেনেড ধ্বংস করে দিয়ে প্রমাণ নষ্ট করার চেষ্টাও করা হয়েছিল।
এই হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠীর সন্ধানদাতার জন্য সে সময় বাবর এক কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। হামলার পর বাবরের তত্ত্বাবধানে একটি তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় এবং এতে জজ মিয়া নামে এক ভবঘুরে, একজন ছাত্র, একজন আওয়ামী লীগের কর্মীসহ ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
পুনরায় তদন্তে পুলিশ এই হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২১ জনকে চিহ্নিত করে। তাদের মধ্যে হুজি প্রধান মুফতি হান্নানসহ ১৪ জন হুজি কর্মী ও বাবর এখন কারাগারে রয়েছেন।
এদিকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার বিচার আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে এমন আশাবাদ ব্যাক্ত করে মামলা পরিচালনাকারী সরকারি কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন বুধবার জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন করতে আর সর্বোচ্চ চার থেকে সাড়ে চার মাস সময় লাগবে। ইতিমধ্যে ১৭৬ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। আর খুব বেশি হলে ৪০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ মামলার চার্জশিটভুক্ত ৫২ আসামির মধ্যে ১৯ জন এখনো পলাতক রয়েছেন। অভিযুক্তদের মধ্যে ২৬ জন কারাগারে আটক রয়েছেন এবং প্রাক্তন তিনজন আইজিপিসহ আটজন জামিনে রয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর (অস্থায়ী এজলাস) বিচারক শাহেদ নুরু উদ্দিনের আদালতে জজ মিয়াসহ দুটি মামলায় ৪৯১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৭৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়েছে। আসামির সংখ্যা ৫২ জন। এর মধ্যে জেল হাজতে আছেন ২৫ জন , জামিনে আছেন ১৯ জন ও পলাতক আছেন আটজন। মামলায় এ পর্যন্ত আটজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা হলেন- মুফতি হান্নান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি,শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল,মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর,আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম,আরিফ হাসান সুমন ও রফিকুল ইসলাম সবুজ।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য তৎকালীন চার দলীয় জোট সরকার এই ন্যক্কারজনক হামলা চালায়। এতে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান সহ ২৪ জন কে হত্যা করা হয়।
মামলার বিলম্বিত বিচার সম্পর্কে তিনি বলেন, তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়া চেষ্টা হয়েছে বার বার এবং অধিকতর তদন্তেই অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এ মামলার কিছু আসামি ১০ ট্রাক অস্ত্র, যুদ্ধাপরাধ, রমনা বটমূল ও ৭৬ কেজি বোমার মামলারও আসামি। তাই ওই মামলাগুলোর বিচারও এক সঙ্গে চলায় সময় নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া আসামিপক্ষ থেকে সাক্ষীদের অপ্রয়োজনীয় জেরা করায়ও সময় নষ্ট হচ্ছে বলেও তিনি মনে করেন।
এ মামলাগুলোর অন্যতম আসামি তারেক রহমানের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, তারেক রহমান এ হামলার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নন। শুধু রাজনৈতিকভাবে হয়রানির জন্যই পরবর্তীতে তাকে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে।
গ্রেনেড হামলা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের জন্য আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনসমূহ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।