বিষয়টার তুলনা চলে ‘অন্ধের হাতি দেখা’র সঙ্গে। টুর্নামেন্টের শুরুতে অনূর্ধ্ব-১৬ বাংলাদেশ দল সম্পর্কে ফুটবল অনুরাগীদের ধারণা এর চেয়ে বেশি ছিল না। সারা দেশ থেকে বাছাই করে ফুটবলার নেওয়া হয়েছে, তাঁরা এও জানতেন দলে বেশ কয়েকজন দুর্দান্ত ফুটবলার আছে। কিন্তু তাতে দল কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠবে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো ধারণা ছিল না। একই প্রক্রিয়ায় তো প্রতিবারই দল গড়া হয়, কিন্তু চূড়ান্ত সাফল্য তো আর আসে না। তাই দলটিকে ঘিরে আকাশচুম্বী প্রত্যাশা ছিল না। ফুটবল কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে খোদ কোচ পর্যন্ত সতর্ক ছিলেন প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বেলায়। পুরো দল নিয়ে কাজ করার পর্যাপ্ত সময় পাননি কোচ। সম্ভাবনার ফুলগুলো তাই কতটা সুবাস ছড়াতে পারবে, তা নিয়ে তাই স্পষ্ট ধারণা করা যাচ্ছিল না। কিন্তু প্রস্তুতিতে প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে পিছিয়ে থেকেও শাওন-নিপু-সাদরা শেষ পর্যন্ত নিজেদের প্রমাণ করেছেন, দেশের পতাকা তুলে ধরেছেন অন্য উচ্চতায়।
এবারের সাফ ফুটবলে অংশ নিয়েছে ভারত, নেপাল, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও স্বাগতিক বাংলাদেশসহ ছয়টি দল। সাফ ফুটবলে অংশ নিতে সব দল যখন প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে তখন পরীক্ষা। ওরাই উজ্জ্বল আগামী তাই স্কুল পড়ুয়া এই ফুটবলারদের জড়ো করে ক্যাম্প শুরু করা যাচ্ছিল না। পরীক্ষা শেষে এবং বাছাইপর্ব শেষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠে আসা তরুণদের নিয়ে যখন দল গড়া হলো তখন টুর্নামেন্ট শুরুর বাকি নেই। সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য কোচের হাতে সময় আছে ১৮ দিনের মতো। এই সময়কে প্রস্তুতির জন্য কোনোভাবেই পর্যাপ্ত বলতে নারাজ কোচ সৈয়দ গোলাম জিলানী। তাই শুরুতে তিনি লক্ষ্য সম্পর্কে বলেছেন বেশ কৌশলের সঙ্গে। বরাবরই বলেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ভালো খেলা।’ এর বেশি কিছু বলেননি। বলবেন কী করে? সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলে অংশ নেওয়া দলগুলোর বেশির ভাগই একাডেমির ফুটবলার, যারা দীর্ঘ সময়ে পরিচর্যা ও প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে নিজেদের তৈরি করেছে। বিপরীতে বাংলাদেশের তরুণরা একেকজন এসেছে একেক জায়গা থেকে। কেউ বাফুফের ফুটবল একাডেমি বা বিকেএসপি থেকে, কেউ সিলেটে ইংল্যান্ডের ক্যানারি ওয়ার্ফ পরিচালিত প্রশিক্ষণ শিবির থেকে আর বাকিরা এসেছে একেবারেই তৃণমূল থেকে বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা তরুণদের ১৮ দিনে এক সুতোয় গেঁথে ফেলা তো চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু কোচ সেই কাজটি বেশ দক্ষতার সঙ্গে করেছেন। শুধু টুর্নামেন্টের শিরোপা জয় নয়, ভারতের মতো দলকে দুইবার হারিয়েছেও বাংলাদেশ।
ভারত আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন এবং টুর্নামেন্টের অন্যতম শক্তিশালী দল। শ্রীলঙ্কাও হেলাফেলা করার দল নয়। কঠিন গ্রুপেই লড়তে হয়েছে বাংলাদেশকে। ‘এ’ গ্রুপের প্রথম ম্যাচে ভারতের কাছে শ্রীলঙ্কা হারে ৫-০ গোলে। নিজেদের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ মুখোমুখি হয় তুলনামূলক দুর্বল শ্রীলঙ্কার। কিন্তু শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ম্যাচের আগেও কোনো আশার বাণী শোনাননি কোচ। জয়ের বিষয়ে মুখে কিছু না বললেও মাঠে জিলানীর শিষ্যরা ৪-০ ব্যবধানে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে দেয়।
বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচে ১৪ হাজারের মতো দর্শক উপস্থিত হয়েছিলেন সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে। প্রথম ম্যাচেই বাংলাদেশ ধারণা দিয়ে দেয় নিজেদের সম্পর্কে। একাই দুই গোল করা নিপুই নয়, দলের প্রতিটি খেলোয়াড় এক দিনেই মন জয় করে নেয় পুরো দেশবাসীর। গতিময় ফুটবল খেলে আলাদাভাবে বোদ্ধাদের নজর কাড়ে সরওয়ার জামান নিপু ও সাদ উদ্দিন।
প্রথম ম্যাচে জয় দিয়েই সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলে বাংলাদেশ। পরের ম্যাচে সামনে শক্তিশালী ভারত। কোচ যথারীতি সতর্ক, প্রত্যাশা নিয়ে সেই একই কথা, ‘আমরা ভালো খেলতে চাই।’ তবে তাঁর শিষ্যরা তত দিনে আত্মবিশ্বাসের জ্বালানি পেয়ে গেছে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে। নিপু, সাদ তাই ভয়ডরহীন, ‘আমাদের স্বাভাবিক খেলাটা মাঠে খেলতে পারলে ভারতকে হারিয়ে দিতে পারব।’ মাঠের খেলায় ভারতকে ১-০ গোলে হারিয়ে দেওয়ার পর দলের প্রতিটি খেলোয়াড়ের শারীরিক ভাষার পরিবর্তনটা ছিল লক্ষণীয়। সেমিফাইনালে নেপাল না আফগানিস্তানকে চাই? এমন প্রশ্নের জবাবে এবার অধিনায়ক শাওন ছুড়ে ফেলে সংযমী কথা বলার মুখোশ। নির্লিপ্ত কণ্ঠে উত্তর দেয়, ‘আমাদের লক্ষ্য চ্যাম্পিয়ন হওয়া। সুতরাং কোনো একটি দলকে ভয় পাওয়ার সুযোগ নেই। যে-ই আসুক আমরা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।’
বাংলাদেশের অধিনায়কের ঘোষণা যে কথার কথা ছিল না তা শাওনরা প্রমাণ করেছে সেমিফাইনালে শক্তিশালী আফগানিস্তানকে ১-০ গোলে হারিয়ে দিয়ে। কোচের ভাষায়, ‘আমার মতে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে শক্তিশালী দল আফগানিস্তান।’ কোচের বিবেচনায় শক্তিশালী দলটিও তেমন পাত্তা পায়নি বাংলাদেশের সামনে। ফাইনালে সেই ভারত যখন বাংলাদেশের মুখোমুখি তত দিনে সারা দেশে চায়ের কাপে ঝড় তুলতে শুরু করেছে নিপু-সাদরা।
ক্রীড়ামোদী হিসেবে সিলেটবাসীর খ্যাতি আছে আগে থেকেই। ক্রিকেট, ফুটবল সব খেলা নিয়েই তাদের বাড়তি উৎসাহ। তাই বলে বয়সভিত্তিক ফুটবল টুর্নামেন্ট নিয়ে এত উন্মাদনা! টুর্নামেন্ট শুরুর আগে সেটা কল্পনাও করেননি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তারাও। সাফ ফুটবলের আয়োজক কমিটির সদস্যসচিব সত্যজিৎ দাশ রূপুর ভাষায়, ‘জানতাম সিলেটে খেলা হলে দর্শক আসবেন। কিন্তু এতটা! সেটা ভাবনায় ছিল না।’
প্রতিটি ম্যাচেই দর্শক সমাগম হয়েছে সিলেটের মাঠে। কিন্তু বাংলাদেশের খেলাগুলোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। সিলেট ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচে ১৩ হাজারের মতো দর্শক উপস্থিত হয়েছিলেন, দ্বিতীয় ম্যাচ ও সেমিফাইনালে গড়ে ১৭ হাজার দর্শক আর ফাইনালে ২৩ হাজার দর্শক মাঠে বসে খেলা দেখেছেন।
ফুটবলের এই পড়ন্ত বেলায়, যখন ক্রিকেট-জৌলুসের আড়ালে ফিকে হয়ে গেছে ফুটবলের সোনালি অতীত তখন ফুটবল নিয়ে এমন উন্মাদনা নতুন স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে দেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে। দর্শক উপস্থিতি দেখে এতটাই মুগ্ধ বাংলাদেশ দলের কোচ ও অধিনায়ক যে প্রতিটি ম্যাচ শেষে দুজনেই নিয়ম করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন দর্শকদের। ফাইনাল শেষে বাংলাদেশ দলের সফল কোচ সৈয়দ গোলাম জিলানী তো বলেই ফেললেন, ‘এই সাফল্যের জন্য সিলেটবাসীকে কৃতজ্ঞতা জানাই। সিলেটবাসীর এই সমর্থন আমার দল কোনো দিন ভুলবে না। আমি অন্তত কোনো দিন ভুলব না। এটি আমার কোচিং জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।’
এমন সফল অর্জনের পর কয়েকটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই সামনে চলে এসেছে। দেশের ফুটবল যখন তলানির দিকে, বড়রা যখন একের পর এক ব্যর্থতায় নিমজ্জিত, তখন আগামী প্রজন্মের এই তরুণদের এমন সাফল্য কি ধরে রাখা সম্ভব হবে? নাকি হঠাৎ চমকে দিয়ে হারিয়ে যাওয়া প্রতিভাগুলোর মতো নিপুরাও হারিয়ে যাবে সময়ের আবর্তে? বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা এই তরুণদের ভবিষ্যৎ কী? যারা একাডেমি থেকে এসেছে তারা না হয় সেখানেই ফিরবে। কিন্তু যারা তৃণমূল থেকে উঠে এসেছে? তাদের কী হবে? নাকি একসময় হারিয়ে যাবে? ফুটবল সচেতন প্রতিটি মানুষের মনে এখন সেই প্রশ্ন।
এই প্রশ্নটি করা হয়েছিল বাংলাদেশ দলের কোচ সৈয়দ গোলাম জিলানীর কাছে। তাঁর উত্তর, ‘এটা বাফুফের ডেভেলপমেন্ট কমিটির বিষয়। তারা নিশ্চয়ই এদের নিয়ে ভাবছেন। কিভাবে তাদের ধরে রাখা যায়, তা নিয়ে পরিকল্পনা করবেন।’
কোচ এর বেশি কিছু না বললেও দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন আশার বাণী শুনিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমি চাইলে তাদের টাকাপয়সা দিয়ে খুশি করতে পারতাম। তারা এত ছোট যে অর্থ পুরস্কার হিতে বিপরীত হতে পারে। বরং তাদের আগামী চার বছরের জন্য বাফুফে একাডেমিতে রেখে আরো বড় ফুটবলার হিসেবে গড়ে তোলা হবে। তাদের জন্য একাডেমিতে আনা হবে বিদেশি কোচিং স্টাফ। এটাই তাদের জন্য আমার পুরস্কার।’
ফুটবলের পড়ন্ত বেলায় একঝাঁক তরুণদের উত্থান হয়তো নতুন ভোরের ইঙ্গিত। আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচে যখন ঢাকায় দর্শকরা গ্যালারিতে পা মাড়ান না তখন ঢাকার বাইরে সিলেটে ফুটবল নিয়ে এমন উন্মাদনা। ফুটবল ম্যাচ দেখতে সিলেট স্টেডিয়ামে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় কি সালাউদ্দিনকে নিয়ে যায় না তাঁর তরুণবেলায়, ফুটবলের সেই সোনালি দিনগুলোতে, যখন ফুটবল মানেই ছিল এমন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস!
হয়তো নিয়ে যায়, যায় বলেই হয়তো এবার আর কাজী সালাউদ্দিন ফুটবলারদের নানা চমকপ্রদ পুরস্কারের ঘোষণায় চমকে দিতে যাননি। ঘোষণা দিয়েছেন তাদের সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের।