ঢাকা ০২:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মিয়ানমারের উপর হস্তক্ষেপ চান নোবেল জয়ীরা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:২৭:২৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭
  • ৩০২ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অংসান সু চির বিরুদ্ধে এবার অবস্থান নিয়েছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। মিয়ানমারের উপর সম্ভাব্য সকল ধরনের হস্তক্ষেপ করতে তারা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে দাবি করেছেন।

রোহিঙ্গা সঙ্কট অবসান করতে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি হস্তক্ষেপ চেয়ে খোলা চিঠি লিখেছেন মুহাম্মদ ইউনূসসহ ৩০ ব্যক্তি, যাদের মধ্যে নোবেলজয়ী ১৮ জনের সঙ্গে রয়েছেন বিভিন্ন দেশের সাবেক মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, সমাজসেবী ও অধিকারকর্মী।

বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) ইউনূস সেন্টারের মাধ্যমে আসা এই খোলা চিঠিতে বলা হয়, ‘মিয়ানমারের রাখাইন এলাকায় মানবীয় ট্রাজেডি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ যে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে, তার অবসানে আপনাদের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আপনাদের এই মুহূর্তের দৃঢ়সংকল্প ও সাহসী সিদ্ধান্তের উপর মানব ইতিহাসের ভবিষ্যত গতিপথ অনেকটাই নির্ভর করছে।’

বাংলাদেশের নোবেলজয়ী ইউনূসের সঙ্গে এই আহ্বানে যুক্ত শান্তিতে নোবেলজয়ীরা হলেন আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু, শিরিন এবাদী, মালালা ইউসাফজাই, মেইরিড মাগুইর, বেটি উইলিয়াম্স, বেটি উইলিয়াম্স, অসকার আরিয়াস সানচেজ, জোডি উইলিয়াম্স, লেইমাহ বোয়ি, তাওয়াক্কল কারমান।

১৯৯৩ সাল চিকিৎসায় নোবেলজয়ী স্যার রিচার্ড জে রবার্টস এবং ২০০৯ সালে চিকিৎসায় নোবেলজয়ী এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্নও এই আহ্বান জানিয়েছেন। পাকিস্তানের মানবাধিকার নেত্রী আসমা জাহাঙ্গীর, ভারতের কবি জাভেদ আখতার ও অভিনেত্রী শাবানা আজমীও এই চিঠিতে যুক্ত হয়েছেন।

অন্যদের মধ্যে রয়েছেন মালয়েশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়েদ হামিদ আলবার, ইতালির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমা বোনিনো, নরওয়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গ্রো হারলেম ব্রান্ডটল্যান্ড, থাইল্যান্ডের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাসিত পিরোমিয়া, আসিয়ানের সাবেক মহাসচিব সুরিন পিটসুয়ান।

তাদের চিঠিতে লেখা হয়, ‘সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পেলে গত বছরের শেষে আমরা কয়েকজন নোবেল লরিয়েট ও বিশ্বের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ এ বিষয়ে জরুরি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে আপনাদের নিকট অনুরোধ জানিয়েছিলাম। আপনাদের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতির প্রেক্ষিতে নিরীহ নাগরিকদের উপর অত্যাচার বন্ধ এবং রাখাইন এলাকায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমরা আবারও আপনাদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।’

এই মাসে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের আগে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টি বিশ্বজুড়ে আলোচিত। আলোচনার জন্য সুইডেন ও যুক্তরাজ্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ফ্রান্স। এই দেশগুলোর যে কোনো প্রস্তাব আটকে দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে।

নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে সুইডেনের সঙ্গে এখন রয়েছে বলিভিয়া, মিশর, ইথিওপিয়া, ইতালি, জাপান, কাজাখস্তান, সেনেগাল, ইউক্রেইন ও উরুগুয়ে।

নোবেলজয়ীসহ বিভিন্ন দেশের সাবেক মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, সমাজসেবী ও অধিকারকর্মীদের সেই চিঠিটি নিচে দেয়া হলো।

নিরাপত্তা পরিষদের প্রিয় সভাপতি ও সদস্যবৃন্দ,

রোহিঙ্গা সংকট পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বান করার জন্য প্রথমে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই যে মিয়ানমারের রাখাইন এলাকায় মানবীয় ট্র্যাজেডি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ যে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে, তার অবসানে আপনাদের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আপনাদের এই মুহূর্তের দৃঢ়সংকল্প ও সাহসী সিদ্ধান্তের ওপর মানবেতিহাসের ভবিষ্যৎ গতিপথ অনেকটাই নির্ভর করছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক আক্রমণে শত শত রোহিঙ্গা জনগণ নিহত হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। বহু গ্রাম সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, বেসামরিক মানুষদের নির্বিচারে আটক করা হচ্ছে এবং শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। আতঙ্কের বিষয়, মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোকে এ এলাকায় প্রায় একবারেই প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না, যার ফলে দারিদ্র্যপীড়িত এই এলাকায় মানবিক সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। স্থানীয় সরকার সূত্রগুলোর মতে, গত দুই সপ্তাহে তিন লাখের বেশি মানুষ তাদের জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মৃত্যুর মুখে নারী, পুরুষ ও শিশুদের এই ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি এবং অভিবাসন থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতি প্রতিদিন আরও খারাপ হচ্ছে।

সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পেলে গত বছরের শেষে আমরা কয়েকজন নোবেল লরিয়েট ও বিশ্বের বিশিষ্ট নাগরিকদের এ বিষয়ে জরুরি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে আপনাদের নিকট অনুরোধ জানিয়েছিলাম। আপনাদের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে নিরীহ নাগরিকদের ওপর অত্যাচার বন্ধ এবং রাখাইন এলাকায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমরা আবারও আপনাদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।

আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সম্ভাব্য সব হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাচ্ছি, যাতে নিরীহ বেসামরিক মানুষদের ওপর নির্বিচার সামরিক আক্রমণ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়, যার ফলে এই অসহায় মানুষগুলোকে নিজ দেশ ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যেতে এবং রাষ্ট্রহীন মানুষে পরিণত হতে না হয়।

মিয়ানমার সরকার যে যুক্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করছে তা একেবারেই আজগুবি। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে বার্মা স্বাধীন হওয়ার পর এবং পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের সময়কালে বার্মা তার সীমানাভুক্ত রোহিঙ্গাসহ সব জাতিগোষ্ঠীকে পূর্ণ নাগরিক বলে স্বীকার করে নেয় এবং সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্বও দেয়।

এটা আশ্চর্যজনক যে ১৯৮০-এর দশকে সে দেশের সামরিক শাসকেরা হঠাৎ করেই আবিষ্কার করে বসে যে রোহিঙ্গারা বার্মিজ নয়। এরপর তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয় এবং তাদেরকে সে দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য বিভিন্ন সামরিক ও রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে। শুরু হয় জাতিগত ও ধর্মীয় নিধনের উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সুপরিকল্পিত নির্যাতন।

জাতিসংঘ মহাসচিব যথার্থই বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও অমীমাংসিত দুর্দশা আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার একটি অনস্বীকার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারের শাসকদের অবশ্যই সহিংসতার এই দুষ্টচক্র বন্ধ করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং নিপীড়িত সবার নিরাপত্তা ও সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।’

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার ২০১৬ সালে যে ‘রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশন’ গঠন করেছিল, তার সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকারকে উদ্বুদ্ধ করতে আপনারা যেন জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন—সে জন্য আমরা আবারও আপনাদের অনুরোধ জানাচ্ছি। কফি আনানের সভাপতিত্বে গঠিত এই কমিশন, যার অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন মিয়ানমারের নাগরিক—রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, অবাধ চলাচলের সুযোগ, আইনের চোখে সমান অধিকার, রোহিঙ্গাদের স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, যার অভাবে স্থানীয় মুসলিমরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং নিজ ভূমিতে ফিরে আসা মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সহায়তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছিল। মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর জঙ্গিদের আক্রমণ এই আশঙ্কাকেই সত্য প্রমাণিত করল। স্থায়ী শান্তির জন্য গঠনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে, যা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীরা নিম্নলিখিত প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপগুলো সুপারিশ করছি:

১. আনান কমিশনের সদস্যদের নিয়ে অবিলম্বে একটি ‘বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করা, যার কাজ হবে কমিশনের সুপারিশগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধান করা।
২. দেশটি থেকে শরণার্থীর প্রবাহ বন্ধ করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ।
৩. আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের নিয়মিতভাবে পীড়িত এলাকাগুলো পরিদর্শন করতে আমন্ত্রণ জানানো।
৪. যেসব শরণার্থী ইতিমধ্যে দেশ ত্যাগ করেছে, তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা।
৫. ফিরে যাওয়া শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘের অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন।
৬. বাস্তবায়ন কমিটির কর্তৃত্বে আনান কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ মোতাবেক রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান।
৭. রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অবাধে চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই ক্রমাগত সহিংসতা বন্ধ করতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কর্মপন্থায় সাহসী পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি। মিয়ানমার সরকারকে জানিয়ে দেওয়া দরকার, সে দেশের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও অর্থায়ন রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক পরিবর্তনের ওপর নির্ভরশীল। অপপ্রচার, ঘৃণা ও সহিংসার উসকানি বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র পরিচালিত সহিংসতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে, বৈষম্যমূলক বিভিন্ন নীতি ও আইন বাতিল করতে হবে এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে।

বিশ্ববাসী জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবিক সমস্যা সমাধানে তার ভূমিকা পালন করেছে—এটা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

মিয়ানমারের উপর হস্তক্ষেপ চান নোবেল জয়ীরা

আপডেট টাইম : ০৫:২৭:২৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অংসান সু চির বিরুদ্ধে এবার অবস্থান নিয়েছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। মিয়ানমারের উপর সম্ভাব্য সকল ধরনের হস্তক্ষেপ করতে তারা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে দাবি করেছেন।

রোহিঙ্গা সঙ্কট অবসান করতে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি হস্তক্ষেপ চেয়ে খোলা চিঠি লিখেছেন মুহাম্মদ ইউনূসসহ ৩০ ব্যক্তি, যাদের মধ্যে নোবেলজয়ী ১৮ জনের সঙ্গে রয়েছেন বিভিন্ন দেশের সাবেক মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, সমাজসেবী ও অধিকারকর্মী।

বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) ইউনূস সেন্টারের মাধ্যমে আসা এই খোলা চিঠিতে বলা হয়, ‘মিয়ানমারের রাখাইন এলাকায় মানবীয় ট্রাজেডি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ যে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে, তার অবসানে আপনাদের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আপনাদের এই মুহূর্তের দৃঢ়সংকল্প ও সাহসী সিদ্ধান্তের উপর মানব ইতিহাসের ভবিষ্যত গতিপথ অনেকটাই নির্ভর করছে।’

বাংলাদেশের নোবেলজয়ী ইউনূসের সঙ্গে এই আহ্বানে যুক্ত শান্তিতে নোবেলজয়ীরা হলেন আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু, শিরিন এবাদী, মালালা ইউসাফজাই, মেইরিড মাগুইর, বেটি উইলিয়াম্স, বেটি উইলিয়াম্স, অসকার আরিয়াস সানচেজ, জোডি উইলিয়াম্স, লেইমাহ বোয়ি, তাওয়াক্কল কারমান।

১৯৯৩ সাল চিকিৎসায় নোবেলজয়ী স্যার রিচার্ড জে রবার্টস এবং ২০০৯ সালে চিকিৎসায় নোবেলজয়ী এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্নও এই আহ্বান জানিয়েছেন। পাকিস্তানের মানবাধিকার নেত্রী আসমা জাহাঙ্গীর, ভারতের কবি জাভেদ আখতার ও অভিনেত্রী শাবানা আজমীও এই চিঠিতে যুক্ত হয়েছেন।

অন্যদের মধ্যে রয়েছেন মালয়েশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়েদ হামিদ আলবার, ইতালির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমা বোনিনো, নরওয়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গ্রো হারলেম ব্রান্ডটল্যান্ড, থাইল্যান্ডের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাসিত পিরোমিয়া, আসিয়ানের সাবেক মহাসচিব সুরিন পিটসুয়ান।

তাদের চিঠিতে লেখা হয়, ‘সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পেলে গত বছরের শেষে আমরা কয়েকজন নোবেল লরিয়েট ও বিশ্বের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ এ বিষয়ে জরুরি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে আপনাদের নিকট অনুরোধ জানিয়েছিলাম। আপনাদের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতির প্রেক্ষিতে নিরীহ নাগরিকদের উপর অত্যাচার বন্ধ এবং রাখাইন এলাকায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমরা আবারও আপনাদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।’

এই মাসে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের আগে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টি বিশ্বজুড়ে আলোচিত। আলোচনার জন্য সুইডেন ও যুক্তরাজ্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ফ্রান্স। এই দেশগুলোর যে কোনো প্রস্তাব আটকে দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে।

নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে সুইডেনের সঙ্গে এখন রয়েছে বলিভিয়া, মিশর, ইথিওপিয়া, ইতালি, জাপান, কাজাখস্তান, সেনেগাল, ইউক্রেইন ও উরুগুয়ে।

নোবেলজয়ীসহ বিভিন্ন দেশের সাবেক মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, সমাজসেবী ও অধিকারকর্মীদের সেই চিঠিটি নিচে দেয়া হলো।

নিরাপত্তা পরিষদের প্রিয় সভাপতি ও সদস্যবৃন্দ,

রোহিঙ্গা সংকট পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বান করার জন্য প্রথমে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই যে মিয়ানমারের রাখাইন এলাকায় মানবীয় ট্র্যাজেডি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ যে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে, তার অবসানে আপনাদের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আপনাদের এই মুহূর্তের দৃঢ়সংকল্প ও সাহসী সিদ্ধান্তের ওপর মানবেতিহাসের ভবিষ্যৎ গতিপথ অনেকটাই নির্ভর করছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক আক্রমণে শত শত রোহিঙ্গা জনগণ নিহত হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। বহু গ্রাম সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, বেসামরিক মানুষদের নির্বিচারে আটক করা হচ্ছে এবং শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। আতঙ্কের বিষয়, মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোকে এ এলাকায় প্রায় একবারেই প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না, যার ফলে দারিদ্র্যপীড়িত এই এলাকায় মানবিক সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। স্থানীয় সরকার সূত্রগুলোর মতে, গত দুই সপ্তাহে তিন লাখের বেশি মানুষ তাদের জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মৃত্যুর মুখে নারী, পুরুষ ও শিশুদের এই ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি এবং অভিবাসন থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতি প্রতিদিন আরও খারাপ হচ্ছে।

সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পেলে গত বছরের শেষে আমরা কয়েকজন নোবেল লরিয়েট ও বিশ্বের বিশিষ্ট নাগরিকদের এ বিষয়ে জরুরি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে আপনাদের নিকট অনুরোধ জানিয়েছিলাম। আপনাদের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে নিরীহ নাগরিকদের ওপর অত্যাচার বন্ধ এবং রাখাইন এলাকায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমরা আবারও আপনাদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।

আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সম্ভাব্য সব হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাচ্ছি, যাতে নিরীহ বেসামরিক মানুষদের ওপর নির্বিচার সামরিক আক্রমণ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়, যার ফলে এই অসহায় মানুষগুলোকে নিজ দেশ ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যেতে এবং রাষ্ট্রহীন মানুষে পরিণত হতে না হয়।

মিয়ানমার সরকার যে যুক্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করছে তা একেবারেই আজগুবি। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে বার্মা স্বাধীন হওয়ার পর এবং পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের সময়কালে বার্মা তার সীমানাভুক্ত রোহিঙ্গাসহ সব জাতিগোষ্ঠীকে পূর্ণ নাগরিক বলে স্বীকার করে নেয় এবং সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্বও দেয়।

এটা আশ্চর্যজনক যে ১৯৮০-এর দশকে সে দেশের সামরিক শাসকেরা হঠাৎ করেই আবিষ্কার করে বসে যে রোহিঙ্গারা বার্মিজ নয়। এরপর তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয় এবং তাদেরকে সে দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য বিভিন্ন সামরিক ও রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে। শুরু হয় জাতিগত ও ধর্মীয় নিধনের উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সুপরিকল্পিত নির্যাতন।

জাতিসংঘ মহাসচিব যথার্থই বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও অমীমাংসিত দুর্দশা আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার একটি অনস্বীকার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারের শাসকদের অবশ্যই সহিংসতার এই দুষ্টচক্র বন্ধ করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং নিপীড়িত সবার নিরাপত্তা ও সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।’

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার ২০১৬ সালে যে ‘রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশন’ গঠন করেছিল, তার সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকারকে উদ্বুদ্ধ করতে আপনারা যেন জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন—সে জন্য আমরা আবারও আপনাদের অনুরোধ জানাচ্ছি। কফি আনানের সভাপতিত্বে গঠিত এই কমিশন, যার অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন মিয়ানমারের নাগরিক—রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, অবাধ চলাচলের সুযোগ, আইনের চোখে সমান অধিকার, রোহিঙ্গাদের স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, যার অভাবে স্থানীয় মুসলিমরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং নিজ ভূমিতে ফিরে আসা মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সহায়তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছিল। মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর জঙ্গিদের আক্রমণ এই আশঙ্কাকেই সত্য প্রমাণিত করল। স্থায়ী শান্তির জন্য গঠনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে, যা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীরা নিম্নলিখিত প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপগুলো সুপারিশ করছি:

১. আনান কমিশনের সদস্যদের নিয়ে অবিলম্বে একটি ‘বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করা, যার কাজ হবে কমিশনের সুপারিশগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধান করা।
২. দেশটি থেকে শরণার্থীর প্রবাহ বন্ধ করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ।
৩. আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের নিয়মিতভাবে পীড়িত এলাকাগুলো পরিদর্শন করতে আমন্ত্রণ জানানো।
৪. যেসব শরণার্থী ইতিমধ্যে দেশ ত্যাগ করেছে, তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা।
৫. ফিরে যাওয়া শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘের অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন।
৬. বাস্তবায়ন কমিটির কর্তৃত্বে আনান কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ মোতাবেক রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান।
৭. রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অবাধে চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই ক্রমাগত সহিংসতা বন্ধ করতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কর্মপন্থায় সাহসী পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি। মিয়ানমার সরকারকে জানিয়ে দেওয়া দরকার, সে দেশের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও অর্থায়ন রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক পরিবর্তনের ওপর নির্ভরশীল। অপপ্রচার, ঘৃণা ও সহিংসার উসকানি বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র পরিচালিত সহিংসতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে, বৈষম্যমূলক বিভিন্ন নীতি ও আইন বাতিল করতে হবে এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে।

বিশ্ববাসী জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবিক সমস্যা সমাধানে তার ভূমিকা পালন করেছে—এটা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে।