হাওর বার্তা ডেস্কঃ তুন খিন রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকের বর্তমান সভাপতি। সংগঠনটি বিশ্বব্যাপী রোহিঙ্গাদের একটি প্রধান কণ্ঠস্বর। লেখক মার্কিন কংগ্রেস এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টকে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে অবহিত করেছেন। তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, সুইডিস পার্লামেন্ট, ইইউ পার্লামেন্ট ও কমিশন এবং জেনেভায় জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের কাছে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয় তুলে ধরেছেন। আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
মিয়ানমার সামরিকবাহিনী বেসামরিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বর্বর নির্যাতন ও পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করার কারণে হাজার হাজার নারী পুরুষ ও শিশু জীবন বাঁচানোর জন্য দেশটি থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। আমার সংগঠন মিয়ানমার-রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন, ইউকে এ পর্যন্ত এক হাজার ব্যক্তির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। কিন্তু মৃতের সংখ্যা সম্ভবত আরো অনেক বেশি হবে। ১০ হাজারেরও বেশি বাড়িঘর, দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে অথবা ধ্বংস করা হয়েছে। সামরিকবাহিনী পরিকল্পিতভাবে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে গিয়ে লুটতরাজ চালাচ্ছে এবং সব কিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। তারা পেছনে আর কিছু ফেলে রেখে যাচ্ছে না। রোহিঙ্গারা যাতে আর ফিরে আসতে না পারে সে জন্য তারা বাড়িঘর বা বসতভিটার চিহ্ন পর্যন্ত ধ্বংস করে দিচ্ছে। মিয়ানমারে অবস্থানরত আমার রোহিঙ্গা ভাই ও বোনেরা এ ধরনের ঘটনা আবার ঘটতে দেয়া হলো কেন তা আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ রাদ আল হোসেইন রাখাইনে এখন যা ঘটছে তা প্রতিরোধযোগ্য বলে আভাস দিয়েছিলেন। ইতিহাস নিজে নিজেই তার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। তবে এই পুনরাবৃত্তি ঘটছে ভয়ঙ্করভাবে, যা সবাইকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
গত বছরের অক্টোবর মাসে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) নামে একটি নতুন সশস্ত্র রোহিঙ্গা সংগঠন একটি বড় ধরনের সামরিক হামলা চালিয়েছিল। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার সৈন্যদের হামলায় কয়েক শ’ লোক নিহত হয়। গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং রোহিঙ্গা নারীরা গণধর্ষণের শিকার হয়। জাতিসঙ্ঘ ওই বর্বরোচিত ঘটনাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে বর্ণনা করেছিল। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিল ঘটনা তদন্তের জন্য একটি তথ্য অনুসন্ধানী মিশন গঠন করেছিল; কিন্তু মিয়ানমার সরকার তাদেরকে তদন্তের জন্য দেশে প্রবেশ করতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
এআরএসএ কর্তৃক আরো হামলা হলে সামরিকবাহিনী নতুন করে হামলা ও দমনাভিযান চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। সেই আশঙ্কাই সত্য প্রমাণ হয় এবং মিয়ানমার সৈন্যরা ২৫ আগস্ট এআরএসএকে টার্গেট করে নতুন করে হামলা চালায়। তারা বেসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ব্যাপক সামরিক হামলা চালিয়েছে। তারা বেসামরিক লোকদের ওপর গণহত্যা চালায় এবং তাদের বাড়িঘর এবং সম্পদ লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে।
২০১৬ সালে অং সান সু চির নেতৃত্বে একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসায় আমরা পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে বলে আশা করছিলাম; কিন্তু তিনি ক্ষমতায় বসার পর পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। তিনি সব আইন ও নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলো এমনভাবে প্রণয়ন ও সংরক্ষণ করেন, যাতে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানো যায়। এমনকি ২০১২ সালে যেসব রোহিঙ্গার বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়ার কারণে তারা আশ্রয়শিবিরে বসবাস করছিলেন, তাদেরকে খাদ্যসহায়তা দেয়ার ব্যাপারেও অং সান সু চি কড়াকড়ি আরোপ করেন। এসব কড়াকড়ি আরোপের মাধ্যমে আশ্রয়শিবিরের শিশুদের ‘হত্যা’ করা হয় এবং অন্যদের অপুষ্টির শিকার হওয়া অবস্থায় শিবির থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে একটিমাত্র ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়; তা হলো: সাবেক জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা। অবশ্য এই কমিশনে কোনো রোহিঙ্গাকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়নি এবং কমিশনকে তাদের কাজের ব্যাপারে একটি সীমিত ম্যান্ডেট দেয়া হয়েছিল।
তাদেরকে গত সপ্তাহে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি দেখার অনুমতি দেয়া হয়নি। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, এটা একটা বিলম্বিত কৌশল এবং নীতি পরিবর্তনে বিলম্বের জন্য এবং জাতিসঙ্ঘের তদন্তকারীদের তদন্ত করতে দেয়ার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানাতে সরকার এটাকে একটা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে। গত সপ্তাহে আনান কমিশন কিছু ইতিবাচক প্রস্তাব সামনে নিয়ে আসে এবং সরকার সেগুলো মেনে নেয়। রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকলে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি ও সঙ্কট সমাধান করা যেতে পারে। এই কাজ সহজ নয়, তবে তা করা যেতে পারে।
একই সময়ে অং সান সু চি সুপারিশে উল্লিখিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তার অফিস ও সরকার রিপোর্টে যে সুপারিশ করা হয়েছে, তার বিরোধিতা করছে। তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ব্যবহার করে ভয়ভীতি, হিংসা ও সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। তার সরকার এমনকি এতই নিচে নেমে গেছে যে, জাতিসঙ্ঘ এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ভুল তথ্য দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ‘চরমপন্থী বাঙালি সন্ত্রাসী’ বলে অপপ্রচার করছে। এসব মনগড়া ও মিথ্যা অভিযোগ এনে কথিত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা হামলা চালাতে পারে বলে হুমকি দিয়ে সাহায্যকর্মীদের হাজার হাজার শিশুসহ অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কাছে জীবনরক্ষাকারী সহায়তা পাঠাতে সরকার বাধা প্রদান করে। এভাবে তাদের জীবনকে মৃত্যুর মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে।
২০১৬ সালের অক্টোবরে সামরিক বাহিনী যখন আমাদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করার পরিবর্তে আমাদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালাল তখন অং সান সু চির সরকার সামরিকবাহিনীর পক্ষ সমর্থন করে এবং সেখানে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় অস্বীকার করে আমাদের বিরুদ্ধেই অপপ্রচার চালাতে থাকে। সু চি তার ফেসবুক পেজ এবং ওয়েবসাইটে ‘মিথ্যা ও বানোয়াট ধর্ষণ’-এর চিত্র প্রকাশ করেন। রোহিঙ্গা নারীদের ওপর চালানো পৈশাচিক বর্বরতা গণধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘ পরে নিশ্চিত হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ব্যাপারে আমাদের সাধারণত একমাত্র আশা-ভরসা ছিল অং সান সু চি। কিন্তু সেই আশা ফুরিয়ে গেছে। আমাদেরকে সহায়তা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দিকে তাকিয়ে আছি; কিন্তু তারাও আমাদের হতাশ ও ব্যর্থ করে দিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বর্মী সামরিকবাহিনী মানবতাবিরোধী সম্ভাব্য যেসব অপরাধ করেছে, অন্যান্য জাতিগত গ্রুপের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধাপরাধ করেছে, গত মার্চ মাসে জাতিসঙ্ঘ তদন্ত করে এসব অপরাধের প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও মিয়ানমার সামরিকবাহিনীর ওপর কোনো চাপ প্রয়োগ করেনি। প্রকৃতপক্ষে ওই তদন্তের ব্যাপারে বিরোধিতা করা হচ্ছে।
মিয়ানমার সামরিকবাহিনীর প্রধান মিন আং হিয়াংকে সম্মানিত অতিথি হিসেবে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে ইউরোপ এবং এশিয়ায়। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ইইউর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে। কিন্তু ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো এখনো দেশটিকে সামরিক এবং অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের কারণে মিয়ানমার সেনাপ্রধানকে বর্জন করার পরিবর্তে তার কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির চেষ্টা করছে। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, তিনি এখন দৃঢ়তার সাথে জনগণের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর নির্দেশ দেবেন। মিয়ানমারের অং সান সু চি তাকে রক্ষা করছেন। সেনাপ্রধান জানেন, তাকে তার কাজের জন্য কোনো শাস্তি পেতে হবে না। এ জন্য আমার লোকদেরকেই এর মূল্য দিতে হচ্ছে।
এই নতুন সামরিক আগ্রাসন অব্যাহত থাকায় আমরা মিয়ানমার সৈন্যদের অনেক বেশি ভয়াবহ ও নৃশংস ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী হয়ে যাচ্ছি। তারা গণধর্ষণ চালাচ্ছে। তাদের নির্বিচার হামলায় নারী ও শিশুরা নিহত হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতা বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, উসকানি ও উত্তেজনা সৃষ্টি এবং ঘৃণা ও বিদ্বেষ উসকে দেয়া অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। বৈষম্যমূলক আইন ও নীতিগুলো অবশ্যই বাতিল করতে হবে। কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো অবশ্যই পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
সামরিক বাহিনীর নীতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। সামরিক কর্মকর্তাদের সফরে লালগালিচা সংবর্ধনার পরিবর্তে অবশ্যই ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র যথাযথভাবে বলবৎ করা না হলে অবশ্যই এর সমালোচনায় মুখর হতে হবে। তাদের সামরিকবাহিনীকে আর প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা দেয়া যাবে না। সামরিক সরঞ্জামের মালিক, কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অবশ্যই নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয় বিবেচনা করতে হবে।
রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকলেই শুধু মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান করা যাবে। এই কাজ সহজ না হলেও অবশ্যই তা করতে হবে। এর একমাত্র বিকল্প হলো, আমাদেরকে হত্যা করতে দেয়া। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি হলো রোহিঙ্গাদের হত্যা করতে দেয়া হোক। এই নীতি পরিবর্তনের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।