ঢাকা ০৭:২৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পদ্মা আমাগো পেছন ছাড়ছে না

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:০৫:৪৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ অগাস্ট ২০১৭
  • ২৭০ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আল্লারে, ক্যান তুমি আমাগো এমন পরীক্ষা করতাছো। এহন কোতায় যামু, যেহানেই যাই পদ্মা পিছন ছাড়ছে না, শেষ সম্বলটুহু সর্বনাইশ্যা পদ্মা ক্যাইরা নিলো। এর চাইতে আল্লাহ তুমি আমাকে মরণ দাও। এমন আহাজারি হরিরামপুর উপজেলার পদ্মা নদীর পাড় ঘেঁষা গোপীনাথপুর ইউনিয়নের উজান এলাকার বিধাব রহিমা বেগমের। রাক্ষুসে পদ্মার ভয়াল থাবায় আটবার বাড়ি-ঘর ছাড়া হয়েছে এই বৃদ্ধার পরিবারটি। সর্বশেষ তিনটি ছাপড়া ঘর ছিল, সবই পদ্মা গিলে খাওয়ায় পরিবারসহ আশ্রয় নিয়েছেন এলাকার একটি কাঠবাগানে।
উজানপাড়া গ্রামের সত্তর বছর বয়সের হতদরিদ্র মানিক মোল্লার কান্না থামছে না। শেষ ঠিকানাটুকু গিলে খেয়েছে পদ্মা। দুই ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে অন্যও জমিতে আশ্রয় নিয়েছে পরিবারটি। তালাই বাঁশের বেড়ার দুটি ঘর ছিল, তা কয়েক দিন আগেই চলে গেছে নদীর পেটে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বৃদ্ধ মানিক বললেন, এখন আর বাঁচার সাধ জাগে না। পদ্মা আমাগো জীবডা তছনছ করে দিছে।
৬৫টি বছরের ছিরামানের চোখের পানি পদ্মার সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। এখন আর চোখে পানি ঝরে না সবই কেড়ে নিয়েছে রক্ষুসে পদ্মা। ৬ বার ভিটেমাটি হারিয়েছেন কৃষক ছিরামান। আবেগতাড়িত হয়ে জানালেন, বার বার আঘাত আসছে। ঠেকানোর কেউ নেই। আগুনে পুড়লে সব ছাই হয়ে যাওয়ার পরও মাটি টিকে থাকে। কিন্তু নদীভাঙন মাটি তো দূরের কথা কোনো স্মৃতিটুকু থাকে না। পদ্মা আমাগো পেছন ছাড়ছে না। সব গিলে খাচ্ছে।
উজানপাড়া গ্রামের মাইজুদ্দিন দুই মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ছোট ছোট চারটি ঘর ছিল, সেটাও এখন নেই। পদ্মা তাদের গ্রাম ছাড়া করেছে। বাপ-দাদার শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে মুইজুদ্দিন দিশেহারা। জানালেন, বাড়ি-ঘর নেই, পেটে দুবেলা খাবার নেই। অন্যের জায়গায় আর কত দিন থাকুম।
রহিমা বেগম, মানিক মোল্লা, ছিরামান, মাইজুদ্দিন, জয়নাল পারমাণিক, সুফিয়া, জলিল, ইছাকসহ উজারপাড়ার প্রায় শত পনিবার ভিটেমাটি হারিয়ে কাঁদছেন। কেউ এলাকা ছেড়েছেন, কেউ অন্যর জায়গায় আবার কেউ খোলা আকাশের বসবাস করছে। শুধু ভাঙনই নয় বন্যায় ভেসে গেছে গোপীনাথপুর ইউনিয়নের প্রায় সবগুলো গ্রাম। মানবেতর দিন কাটচ্ছে সেখানকার শত শত পরিবার। ত্রাণ সামগ্রীও তেমন পৌঁছায় সেখানে। গোপীনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস বলেন, আমার ইউনিয়নের উজারপাড়া গ্রামটি পদ্মায় বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। সেখানে প্রায় একশ পরিবার গৃহহারা। তারা অত্যন্ত মানবেতন জীবনযাপন করছে। এছাড়া বন্যায় আমার ইউনিয়নে প্রায় দেড় হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত। পর্যাপ্ত ত্রাণ পাওয়া না গেলেও ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।
শুধু গোপীনাথপুর ইউনিয়নের মতোই ভাঙন দেখা দিয়েছে কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর, বৈদ্যকান্দ, সুদ্রকান্দি, কুমারকান্দি কোটকান্দি, কুশিয়ারচর এলাকায়। সেখানে প্রায় অর্ধশত পরিবার পদ্মার ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এছাড়া বন্যায় পুরো ইউনিয়নটি হাবুডুবু খাচ্ছে। পদ্মা পাড়ের বন্যাকবলিত মানুষেরা দুই বেলা দুই মুঠো ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে। ইউনিয়নের প্রায় ১২শ পরিবোর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানিয়েছেন কাঞ্চনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস গাজী। সেই তুলনায় ত্রাণ অপ্রতুল। তিনি বলেন, আমার বাড়িও এ পর্যন্ত ৬ বার ভেঙেছে। তাই ভাঙনের কষ্ট আমি বুঝি। নদী যাদের সঙ্গে অভিমান করে, তাদের সবকিছুই কেড়ে নিয়ে যায়।
স্থানীয় সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে বলেন, পদ্মার ভাঙন ঠেকাতে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বন্যার পানি কমে গেলে বাঁধের কাজ আবারও শুরু হবে। পুরোপুরি বাঁধ নির্মাণকাজ শেষ হলে পদ্মার ভাঙন রোধ করা সম্ভব বলে তিনি জানান।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

পদ্মা আমাগো পেছন ছাড়ছে না

আপডেট টাইম : ০৫:০৫:৪৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ অগাস্ট ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আল্লারে, ক্যান তুমি আমাগো এমন পরীক্ষা করতাছো। এহন কোতায় যামু, যেহানেই যাই পদ্মা পিছন ছাড়ছে না, শেষ সম্বলটুহু সর্বনাইশ্যা পদ্মা ক্যাইরা নিলো। এর চাইতে আল্লাহ তুমি আমাকে মরণ দাও। এমন আহাজারি হরিরামপুর উপজেলার পদ্মা নদীর পাড় ঘেঁষা গোপীনাথপুর ইউনিয়নের উজান এলাকার বিধাব রহিমা বেগমের। রাক্ষুসে পদ্মার ভয়াল থাবায় আটবার বাড়ি-ঘর ছাড়া হয়েছে এই বৃদ্ধার পরিবারটি। সর্বশেষ তিনটি ছাপড়া ঘর ছিল, সবই পদ্মা গিলে খাওয়ায় পরিবারসহ আশ্রয় নিয়েছেন এলাকার একটি কাঠবাগানে।
উজানপাড়া গ্রামের সত্তর বছর বয়সের হতদরিদ্র মানিক মোল্লার কান্না থামছে না। শেষ ঠিকানাটুকু গিলে খেয়েছে পদ্মা। দুই ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে অন্যও জমিতে আশ্রয় নিয়েছে পরিবারটি। তালাই বাঁশের বেড়ার দুটি ঘর ছিল, তা কয়েক দিন আগেই চলে গেছে নদীর পেটে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বৃদ্ধ মানিক বললেন, এখন আর বাঁচার সাধ জাগে না। পদ্মা আমাগো জীবডা তছনছ করে দিছে।
৬৫টি বছরের ছিরামানের চোখের পানি পদ্মার সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। এখন আর চোখে পানি ঝরে না সবই কেড়ে নিয়েছে রক্ষুসে পদ্মা। ৬ বার ভিটেমাটি হারিয়েছেন কৃষক ছিরামান। আবেগতাড়িত হয়ে জানালেন, বার বার আঘাত আসছে। ঠেকানোর কেউ নেই। আগুনে পুড়লে সব ছাই হয়ে যাওয়ার পরও মাটি টিকে থাকে। কিন্তু নদীভাঙন মাটি তো দূরের কথা কোনো স্মৃতিটুকু থাকে না। পদ্মা আমাগো পেছন ছাড়ছে না। সব গিলে খাচ্ছে।
উজানপাড়া গ্রামের মাইজুদ্দিন দুই মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ছোট ছোট চারটি ঘর ছিল, সেটাও এখন নেই। পদ্মা তাদের গ্রাম ছাড়া করেছে। বাপ-দাদার শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে মুইজুদ্দিন দিশেহারা। জানালেন, বাড়ি-ঘর নেই, পেটে দুবেলা খাবার নেই। অন্যের জায়গায় আর কত দিন থাকুম।
রহিমা বেগম, মানিক মোল্লা, ছিরামান, মাইজুদ্দিন, জয়নাল পারমাণিক, সুফিয়া, জলিল, ইছাকসহ উজারপাড়ার প্রায় শত পনিবার ভিটেমাটি হারিয়ে কাঁদছেন। কেউ এলাকা ছেড়েছেন, কেউ অন্যর জায়গায় আবার কেউ খোলা আকাশের বসবাস করছে। শুধু ভাঙনই নয় বন্যায় ভেসে গেছে গোপীনাথপুর ইউনিয়নের প্রায় সবগুলো গ্রাম। মানবেতর দিন কাটচ্ছে সেখানকার শত শত পরিবার। ত্রাণ সামগ্রীও তেমন পৌঁছায় সেখানে। গোপীনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস বলেন, আমার ইউনিয়নের উজারপাড়া গ্রামটি পদ্মায় বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। সেখানে প্রায় একশ পরিবার গৃহহারা। তারা অত্যন্ত মানবেতন জীবনযাপন করছে। এছাড়া বন্যায় আমার ইউনিয়নে প্রায় দেড় হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত। পর্যাপ্ত ত্রাণ পাওয়া না গেলেও ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।
শুধু গোপীনাথপুর ইউনিয়নের মতোই ভাঙন দেখা দিয়েছে কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর, বৈদ্যকান্দ, সুদ্রকান্দি, কুমারকান্দি কোটকান্দি, কুশিয়ারচর এলাকায়। সেখানে প্রায় অর্ধশত পরিবার পদ্মার ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এছাড়া বন্যায় পুরো ইউনিয়নটি হাবুডুবু খাচ্ছে। পদ্মা পাড়ের বন্যাকবলিত মানুষেরা দুই বেলা দুই মুঠো ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে। ইউনিয়নের প্রায় ১২শ পরিবোর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানিয়েছেন কাঞ্চনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস গাজী। সেই তুলনায় ত্রাণ অপ্রতুল। তিনি বলেন, আমার বাড়িও এ পর্যন্ত ৬ বার ভেঙেছে। তাই ভাঙনের কষ্ট আমি বুঝি। নদী যাদের সঙ্গে অভিমান করে, তাদের সবকিছুই কেড়ে নিয়ে যায়।
স্থানীয় সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে বলেন, পদ্মার ভাঙন ঠেকাতে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বন্যার পানি কমে গেলে বাঁধের কাজ আবারও শুরু হবে। পুরোপুরি বাঁধ নির্মাণকাজ শেষ হলে পদ্মার ভাঙন রোধ করা সম্ভব বলে তিনি জানান।