হাওর বার্তা ডেস্কঃ গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার বামনডাঙ্গা গ্রামের প্রান্তিক চাষী আতিয়ার রহমান। ৫৫ শতক জমিতে সবজি চাষের আয়ে চলে তার সংসার। ২৫ শতক জমিতে পটোল, ২০ শতক জমিতে বেগুন আর অবশিষ্ট ১০ শতক জমিতে তিনি এবার অন্যান্য সবজি চাষ করেছিলেন। দুই দফার বন্যায় তার পুরো ফসলই নষ্ট হয়ে গেছে। একই সঙ্গে ভেসে গেছে পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে দিন যাপন করার স্বপ্নও। উজানের পানির ঢল আর টানা বৃষ্টির প্রভাবে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের বিস্তীর্ণ কৃষিজমি এখন পানির নিচে। এর ফলে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি ও অন্যান্য ফসল। দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় ফসল হারিয়ে কাঁদছেন কৃষক। আতিয়ার রহমানের মতো অনেক চাষির চোখেই এখন বেদনার অশ্রু।
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সবজির চাহিদার বড় অংশ পূরণ হয় রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ থেকে। বন্যায় এসব অঞ্চলের চাষাবাদ নষ্ট হওয়ায় বাজারে এরই মধ্যে সবজির সংকট দেখা দিয়েছে। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারে সব ধরনের সবজির দাম দ্বিগুণে উন্নীত এরপর হয়েছে। দ্রুত বন্যার পানি না নামলে সবজির দামে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদি রূপ পাবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। অতিবৃষ্টির কারণে রংপুর জেলার ৭ হাজার ৫০০ হেক্টর সবজির জমি তলিয়ে গেছে। নওগাঁয় তলিয়ে গেছে সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর কৃষিজমি। কুড়িগ্রামে ১ হাজার ১৬১ হেক্টর, গাইবান্ধায় ৮৪১ হেক্টর, দিনাজপুরে ৬০০ হেক্টর ও লালমনিরহাটে ২৬৫ হেক্টর সবজির জমি তলিয়ে গেছে। এর প্রভাবে স্থানীয় বাজারে বাড়ছে সবজির দাম। রাজধানীসহ সারা দেশের বাজারেই পড়েছে এর নেতিবাচক প্রভাব।
আকস্মিক বন্যায় নওগাঁর ১০ উপজেলাজুড়ে সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর সবজি ফসলের জমি বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। জেলার সদর, বদলগাছী, ধামইরহাট ও মহাদেবপুর উপজেলায় কাঁচামরিচ, বেগুন, পটোল, ঝিংগা, বরবটি, কুমড়া, পেঁপেসহ বিভিন্ন জাতের কাঁচা সবজি বেশি উৎপাদন হয়। এখানকার সবজি এলাকার চাহিদা পূরণ করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। বন্যার কারণে সবজির আকাল দেখা দিয়েছে স্থানীয় বাজারে। রংপুরে সবজি ক্ষেত আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ডুবে গেছে। জেলায় গ্রীষ্ম মৌসুমে ১১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়েছিল। অতিবৃষ্টির কারণে ৭ হাজার ৪৭৫ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, মিঠাপুকুর উপজেলায় ৪০০ হেক্টর, পীরগঞ্জ উপজেলায় ১০৫ হেক্টর, পীরগাছা উপজেলায় ১৫০ হেক্টর, কাউনিয়া উপজেলায় ৪০ হেক্টর, গঙ্গাচড়ায় ১২০ হেক্টর, তারাগঞ্জ উপজেলায় ১০০ হেক্টর, বদরগঞ্জ উপজেলায় ১২৫ হেক্টর ও সদর উপজেলায় ৪০ হেক্টর জমির গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি পানিতে সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, মিঠাপুকুর উপজেলায় বেশি শাকসবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছড়ান এলাকার কৃষক শাহজাহান আলি জানান, এক বিঘা জমিতে পটোল চাষ করেছিলেন তিনি। এ জমির ফসল বন্যায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুই বিঘা জমিতে করলা, লালশাক, লাউশাক চাষ করেছেন বালুয়া গ্রমের শহিদার রহমান। বন্যার পানিতে এ জমিও তলিয়ে গেছে। তিন বিঘা জমিতে ঢেঁড়স, পালংশাক, মূলাশাক চাষ করেছেন বলদি পুকুর এলাকার কৃষক হামিদ। এ ফসলের জমিও এখন পানির নিচে। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক স ম আশরাফ আলী জানান, বৃষ্টির কারণে প্রতি বছর শাকসবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবছর পানি বেশি হওয়ায় ফসলের ক্ষতির পরিমাণ একটু বেশি। তাছাড়া রাস্তাঘাটেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ অবস্থায় শাকসবজি বাজারজাতকরণে কৃষকদের সমস্যা হবে।
বন্যায় দিনাজপুর জেলায় শাকসবজির ৬০০ হেক্টর জমি সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। এসব জমিতে সাত হাজার মেট্রিক টন সবজি উৎপাদনের সম্ভাবনা ছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, বন্যায় জেলার করলা, ডাঁটা, লালশাক, পুঁইশাক, পটোল, পেঁপে, ঝিংগা, বরবটি, বেগুনসহ অন্যান্য শাকসবজি ব্যাপকভাবে বিনষ্ট হয়েছে। দিনাজপুর সদর উপজেলা, বীরগঞ্জ, কাহারোল, বিরল ও খানসামা উপজেলায় সবজি নষ্ট হওয়ার পরিমাণ বেশি। দুই সপ্তাহের বন্যায় লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলায় শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে পানির নিচে তলিয়ে থাকায় বিভিন্ন সবজি পচে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। কোথাও আবার কাদামাটির সঙ্গে লেপ্টে আছে। ফলে গত কয়েকদিনে জেলার হাটবাজারগুলোয় শাকসবজির দাম লাগামহীন বেড়েছে।
দ্বিতীয় দফা বন্যায় গাইবান্ধার সাত উপজেলায় সবজির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন সবজি চাষিরা। এরই মধ্যে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষি বিভাগ আগাম সবজি চাষে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রথম দফা বন্যায় কৃষকরা শাকসবজি চাষে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য নতুন করে সবজি চাষ শুরু করেন। দ্বিতীয় দফা বন্যার পানিতে এগুলো ভেসে গেলে কৃষকদের সে আশা দুরাশায় পরিণত হয়। ৩০ শতক জমিতে বিভিন্ন সবজি চাষ করেছিলেন তরফ মহদী গ্রামের আমজাদ আলী। বন্যায় তার চাষের জমি তলিয়ে গেছে। এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম হতাশায় দিনাতিপাত করছেন এ চাষি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক রুহুল আমিন জানান, ক্ষতি পুষিয়ে নিতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সবজি চাষিদের প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
সবজি উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ পাবনার আটঘরিয়া, মুলাডুলি ও ঈশ্বরদী এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ না করলেও গেল কয়েক দিনের অতিবর্ষণে সবজি উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। কাঁচামরিচ উৎপাদনে প্রসিদ্ধ আতাইকুলা ও সাঁথিয়া উপজেলা এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে জেলায় কাঁচামরিচের ফলন বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নের আটঘরিয়া গ্রামের বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত কৃষক হাবিবুর রহমান মৎস্য হাবিবের খামারে রোপণকৃত ১০ বিঘা পেঁপে বাগানে এ বছর অতিবৃষ্টির কারণে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বৃষ্টির কারণে ফলন্ত পেঁপে গাছ মাটিতে পড়ে নষ্ট হয়েছে এবং হলুদ হয়ে মারা গেছে। এজন্য হাবিবের ১৫ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। মাটিতে পড়ে যাওয়া, নষ্ট ও হলুদ হওয়া খামারের প্রতিটি পেঁপে গাছে অসংখ্য পেঁপে ধরে আছে। ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রওশন জামাল বলেন, পেঁপে গাছ পানি সহ্য করতে পারে না। জমিতে পানি জমলে পেঁপে গাছ মারা যায়। যাদের পেঁপে গাছ মারা গেছে, তাদের স্বল্পমেয়াদি সবজি আবাদের জন্য কৃষি অফিস থেকে পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে।
সবজি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সবজির বাজারে তরি-তরকারির দাম বেড়েছে ব্যাপক হারে। কাঁচামালের আড়তদাররা জানান, এক সপ্তাহের ব্যবধানে সবজির বাজারে দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। প্রতি কেজি কাঁচামরিচ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১০৫ টাকা দরে। আর হাটবাজারে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা দরে। অপরদিকে বেগুন ও পটোল প্রতি কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। করলা, লালশাক, পুঁইশাক, ঝিংগা, ঢেঁড়স বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা দরে। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামের সবজি চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলার ৯ উপজেলায় ৫০ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। দুই দিন ধরে পানি কিছুটা কমলেও নদী তীরবর্তী অনেক এলাকা এখনও ডুবে আছে। ফলে জেলার সাড়ে ৩ লাখ কৃষক অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় আছেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এবারের বন্যায় ৯ উপজেলার ৬২টি ইউনিয়নে বাড়িঘর ও বিভিন্ন স্থাপনাসহ জমিজমা নিমজ্জিত হয়। এর মধ্যে শাকসবজির আবাদ নষ্ট হয়েছে ১ হাজার ১৬১ হেক্টর জমির।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন রংপুর সংবাদদাতা আবদুর রহমান মিন্টু, নওগাঁর হাফিজুর রহমান, পাবনার কাজী বাবলা, ঈশ্বরদীর আলমাস আলী, দিনাজপুরের কামরুল হুদা হেলাল, লালমনিরহাটের হাসান-উল-আজিজ, গাইবান্ধার আবদুল কাফি সরকার ও কুড়িগ্রামের খন্দকার একরামুল হক সম্রাট।