দেশের কারাগারগুলো বন্দী নির্যাতন, অনিয়ম-দুর্নীতি, মাদক বাণিজ্য থেকে শুরু করে নানা রকম অপরাধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ঘাটে ঘাটে টাকা দিয়ে দাগি অপরাধীরা নিয়ন্ত্রণ করছে কারাগারের সব কিছু। উন্নত খাবার, স্বজনদের একান্ত সাক্ষাৎ, অভিজাত জীবনযাপন, সুস্থ হয়েও হাজতি-কয়েদিদের মাসের পর মাস হাসপাতালে অবস্থান- এ সবই চলছে অহরহ। টাকার জোরেই কুখ্যাত সন্ত্রাসী, সোনা চোরাচালানি এমনকি মাদক ব্যবসায়ীরাও কারাগারে বিলাসী জীবনযাপন করছে। জেলে বসেই হচ্ছে বড় বড় অপরাধ পরিকল্পনা। সেখানকার নির্দেশনাতেই বাইরে খুনোখুনি ঘটছে, চলছে চাঁদাবাজি, অপহরণ, লুটপাটসহ নানা রকম অপরাধ তৎপরতা। ঢাকা জেলের (কারাগারের) ইট-বালু, চেয়ার-টেবিল, সব কিছুতেই টাকা চায়। অফিসার, পিয়ন, দারোয়ান থেকে দালাল পর্যন্ত সবার নজর পকেটের দিকে, খোঁজে শুধু টাকা। জেলবন্দীদের সাক্ষাৎ পেতে প্রতিদিন কারা গেটে হাজির হন সহস্রাধিক দর্শনার্থী। কিন্তু দালাল চক্রের হাতে টাকা না দিয়ে জেলগেট গলিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। ভিতরে টাকা, বাইরেও টাকা। আসামি দেখতে টাকা লাগে, খাবার দিতে টাকা লাগে, আসামির আরাম-আয়েশ নিশ্চিত করতেও লাগে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। টাকা হলে কারাভ্যন্তরে বসেই দেদার মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যায়, মদ-গাঁজা-ইয়াবা সেবন করতেও অসুবিধা হয় না। চাহিদামাফিক টাকা দিতে পারলে কারা দফতরেরই নিরিবিলি কক্ষে কাউকে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একান্তে সময় কাটানো যায়। কী সুবিধা পেতে কত টাকা দিতে হবে, তার অঘোষিত রেটচার্টও আছে সেখানে। মোটামুটি ভালো খাওয়া ও থাকার জন্য সপ্তাহে সাড়ে তিন হাজার টাকা ও মাঝারি মানের খাবারের জন্য আড়াই হাজার টাকা দিতে হয়। প্রতিবার মোবাইল ফোন ব্যবহারের জন্য দিতে হয় ৫০০ টাকা করে। পানি ভরা বালতি আর মগসহ আলাদাভাবে গোসলের সুবিধা পেতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, ব্যাটারিচালিত ছোট ফ্যান ব্যবহারের জন্য প্রতি সপ্তাহে ২০০ টাকা খরচ করতে হয়। ভিতরে তাসের জুয়া খেলতে ১ হাজার টাকা বকশিশ লাগে, একাকী মাদক সেবন করতে ৫০০, দু-তিন জন একত্রে মাদকের আসরে বসলে ২ হাজার, গাঁজা সেবনে ৫০, ইয়াবা সেবনে ২০০, ফেনসিডিল সেবনে ১০০ টাকা আগাম দিতে হয়। ‘ঝাড়ুদফা’ নামের একটি কক্ষে রীতিমতো মাদক কেনাবেচা ও সেবনের খোলামেলা বাজার বসে নিত্যদিন। বিলাসী জীবনযাপনের জন্য কারা হাসপাতালে থাকারও ব্যবস্থা করে দেয় সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। অসুস্থতা ছাড়াই হাসপাতালে থাকতে হলে প্রতি মাসে একেক বন্দীকে গুনতে হয় ২৫ হাজার টাকা। পদে পদে এমন টাকা গুনেই বন্দীরা তাদের সব চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। টাকা না দিলে কারাগারে থাকা বন্দীর ওপর নেমে আসে নির্যাতন, অন্যদিকে বাইরে স্বজনদের হতে হয় হয়রানির শিকার। জেল গেটে আছে থানা পুলিশ, এসবি, ডিবিসহ অন্যান্য সংস্থার দায়িত্বরত ওয়াচারদের উৎপাত। তারা জোট বেঁধে নিজেরাই বিশেষ টিম গঠন করে ওত পেতে থাকে। তারা জেল থেকে ছাড়া পাওয়া ব্যক্তিকে পুনরায় জেল ফটক থেকেই নিজেদের পিকআপ ভ্যানে তুলে নেয়। ভয় দেখায় একাধিক মামলা দিয়ে ডিটেনশনে পাঠানোর। গাড়িতে বন্দী থাকাবস্থায় স্বজনরা চাহিদামাফিক টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে থাকে। অন্যথায় নতুন কোনো মামলা দিয়ে চকবাজার, লালবাগ বা কোতোয়ালি থানা হাজতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় আসামিকে। বেপরোয়া অপরাধের কারণেই কারাভ্যন্তরে আত্মসংশোধনের নানা উদ্যোগেও সুফল মিলছে না। বরং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বন্দীদের উসকে দিচ্ছেন কারাগারের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী। এমন চিত্র দেশের ৩০টি কারাগারে সংঘটিত হয়েছে। কারাগারের অনেক কর্মকর্তা ও কারারক্ষী একই কর্মস্থলে ১৫ বছর ধরে বহাল থাকার নজির রয়েছে। সরকার পরিবর্তন হলেও অদৃশ্য ইশারায় তাদের অন্যত্র বদলি হতে হয় না। অথচ এদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি, কারাভ্যন্তরে থাকা সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের সহায়তা, গোপনীয়তা লঙ্ঘন, তথ্য পাচার, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নানা অপরাধ পরিকল্পনায় সহায়তাদান ও আসামিদের মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ দেওয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
বেপরোয়া সিন্ডিকেট : কারাগারের ভিতরের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আমদানি সেলে বন্দী বেচাকেনা জমজমাট হয়ে উঠেছে। কোরবানির পশুর হাটের মতো আমদানি সেলের প্রকাশ্যে ডাক ওঠে। আদালত থেকে পাঠানো আসামিদের কারাভ্যন্তরে নেওয়ার পর প্রথম যে হলরুমটিতে গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়- এ স্থানটি ‘আমদানি সেল’ হিসেবে পরিচিত। আদালত থেকে নেওয়ার পর আমদানি সেলে হাজতিদের দাগি সন্ত্রাসী কয়েদিদের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট সদস্যরা কিনে নেয়। এরপর বন্দীর স্বজনরা সাক্ষাৎ করতে গেলে তাদের কাছ থেকে সপ্তাহ, মাসিক চুক্তিতে থাকা, খাওয়া, গোসলসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কথা বলে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আদায় করছে। গড়ে প্রতিদিন শতাধিক আসামি আমদানি সেলে বেচাকেনা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে যারা টাকা দিতে পারে না তাদের ওপর চলে নানা ধরনের নির্যাতন। কারাগারের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিন্ডিকেটকে আসামি কেনা বাবদ ৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। প্রতিদিন এ কারাগারে দুই শতাধিক নতুন আসামি ঢোকে। তাদের বেচাকেনা বাবদ কারা সিন্ডিকেটের পকেটস্থ হয় অন্তত ১২ লাখ টাকা। কেনা আসামিদের দেখভালের নামে নানা খাতে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ইজারাস্বত্ব পায় ওই ক্রেতা। বন্দীর স্বজনরা সাক্ষাৎ করতে গেলে তাদের কাছ থেকে সপ্তাহ বা মাসিক চুক্তিতে থাকা, খাওয়া, গোসলসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার নামে টাকা আদায় করা হয়। যারা চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হন, তাদের ওপর নেমে আসে নানা রকম নিপীড়ন, নির্যাতন, হয়রানির ধকল। সম্প্রতি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া এক ব্যক্তি জানান, এ কারাগারে যে এত অনিয়ম-দুর্নীতি হাজতি হিসেবে না গেলে তা জানা যেত না। আদালত থেকে কারাগারের আমদানি শাখায় নেওয়ার পর তাকে জানানো হয় কারা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তাকে কিনে নেওয়া হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে তিন বেলা খাওয়া বাবদ তাকে দিতে হবে ৬৩৫ টাকা। মতিহার সেলে থাকার জন্য ৮ হাজার টাকা। পরে তিনি তার স্বজনকে ডেকে টাকা নিয়ে কর্তৃপক্ষের হাতে দেন। এখানে ওয়ান টু ওয়ান এক ঘণ্টা দেখা করার জন্য প্রতিবার গুনতে হয় ১ হাজার টাকা। স্বজনরা এলে কলিংম্যান ডেকে দেন, এ জন্য ওই কলিংম্যানকে প্রতিবার দিতে হয়েছে ২০০ টাকা। একই অবস্থা বাইরে থেকে কেউ খাবার পাঠালে। এ ছাড়া কেউ হাসপাতালে থাকতে চাইলে প্রতি সপ্তাহে ৫ হাজার এবং আট নম্বর সেলে থাকতে হলে ৪ হাজার টাকা গুনতে হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বাধীন উচ্চ পর্যায়ের কমিটির অনুসন্ধানে কারাগারে অনিয়ম-দুর্নীতি, নির্যাতন-নির্মমতার এসব চিত্র বেরিয়ে আসে। কমিটির প্রতিবেদনে কারা ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজাতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি ২০টি সুপারিশ করা হয়। তবে এখনো সুপারিশগুলো ফাইলবন্দী পড়ে আছে।
মাদক ব্যবসার ঘাঁটি : মাদক ব্যবসার জন্য অত্যন্ত লাভজনক ও নিরাপদ ঘাঁটি হয়ে উঠেছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। কারাগারের ভিতরে হেরোইন, ইয়াবা, গাঁজাসহ প্রায় সব ধরনের মাদকই সহজলভ্য। কয়েদি-হাজতিদের বেশির ভাগই মাদক আইনে কারাবন্দী হওয়ায় দিন দিনই মাদক ব্যবসার বিস্তার ঘটছে। কারাগারের নানা রকম কড়াকড়ি, নজরদারি, কঠোর শাস্তির নির্দেশনা সত্ত্বেও মাদকের পাগলা ঘোড়া থামানো যাচ্ছে না। ইয়াবা, হেরোইন বা অন্যান্য মাদকের বাইরে যা দাম, তার চেয়ে কারাগারের ভিতরে এগুলো দ্বিগুণ-তিন গুণ বেশি দামে বিক্রি হয়। জেলের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটকে মোটা অঙ্কের মাসহারা দেওয়ার মাধ্যমেই মাদকের প্রবেশ নির্বিঘ্ন ও বেচাকেনা সচল রাখা সম্ভব হয়। বিকাল গড়াতেই মণিহার, পদ্মা, মেঘনা, ১০ সেল, ৯০ সেল, যমুনা, ২৭ সেল, স্কুল-১ ও স্কুল-২-তে বসে মাদকের রমরমা আসর। কারা কর্মকর্তারা জানান, কারাবন্দী অনেকেই বিচারাধীন মামলার আসামি। নিয়মিতই তাদের আদালতে হাজির করতে হয়। কাজ শেষে আদালত থেকে তারা যখন কারাগারে ফেরে, তখন অনেকের কাছেই অবৈধ জিনিসপত্র থাকে।
ভরপুর জুয়া বাণিজ্য : ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মাদক বাণিজ্যের পাশাপাশি জুয়ার বাজারও রমরমা। ৯০ সেল, ২৭ সেল আর কারা হাসপাতালের রোগীর শয্যাগুলো জুয়াড়িদের কারণে ফাঁকা থাকার জো নেই। সারা দিন এমনকি গভীর রাত পর্যন্ত দল বেঁধে তাস, লুডু, ষোল ঘুঁটির মাধ্যমে জুয়ার আসর বসে। সেসব আসরে থাকে টাকার ছড়াছড়ি।অভিযোগ : ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার ফরমান আলী ও জেলার নেসার আহমেদের বিরুদ্ধে বন্দীদের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দুজনের পদাবনতি হয়েছিল। জেলারের পদ থেকে হয়েছিলেন ডেপুটি জেলার। চাকরির বয়স শেষ পর্যায়ে আসায় জেল সুপার আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাই জেল সুপার ফরমান আলী জানান, অনেকেই অনেক কিছু চান। কিন্তু সবাইকে সব রকমের সুবিধা দেওয়া যায় না। যারা অনৈতিক সুবিধা পাচ্ছেন না তারাই কারাগার সম্পর্কে নানা ধরনের মনগড়া কল্পকাহিনী ছড়াচ্ছেন। কারা কর্তৃপক্ষের কড়া নজরদারির পাশাপাশি অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারাও কারাগার পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। তিনি তার পদাবনতির বিষয়টি স্বীকার করলেও জেলার নেসারের পদাবনতির কথা স্বীকার করেননি।