মিলিয়ন ডলারের ফাঁদ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  প্রিসকা খলিফা নামের এক বিদেশী মেয়ের ফেইসবুক একাউন্ট থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে ভোলার ঔষুধ ব্যবসায়ী বাহার উদ্দিনের কাছে। না বুঝেই একসেপ্ট করলেন বাহার উদ্দিন। আর শুরু হলো তার নিঃস্ব হওয়ার গল্প। এরপর ধীরে ধীরে ম্যাসেঞ্জার চ্যাটিং, প্রিসকা খলিফা মোহনীয় মায়ার জালে আটকে গেলেন গ্রাম্য এই চিকিৎসক বাহার উদ্দিন। তাদের পরস্পরের মধ্যে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, মেসেঞ্জার ও ই-মেইল এর মাধ্যমে যোগাযোগ চলে।

চ্যাটিং এর একপর্যায়ে মেয়েটি জানায় সে আফ্রিকার এক রিফুজি ক্যাম্প এ মানবেতর জীবন যাপন করছে। করুণা হয় তার। প্রিসকা খলিফা অনুভূতি শেয়ার করতে যেয়ে ব্যক্তিগত জীবনের গল্প বলে যে তার বাবা মৃত ডাক্তান ডেভিড উইলসন খলিফা যার নামে লন্ডনের একটি ব্যাংক একাউন্টে ৩.৮ মিলিয়ন ইউ এস ডলার জমা আছে। কিন্তু প্রিসকা খলিফা বর্তমানে খুব অসহায়। এই টাকা উত্তরাধিকারী হিসাবে উত্তোলন এই মুহূর্তে তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বাহার উদ্দিনের কাছে সে সহযেগিতা প্রত্যাশা করে। যদি কিছু টাকা খরচও হয় বাহার উদ্দিনের পক্ষে সম্ভব হলে তা খরচ করতে অনুরোধ করে। বাহার উদ্দিন বিশ্বাস করেন কিন্তু লন্ডনের ব্যাংক থেকে টাকা ফেরত বা এ ধরনের যোগাযোগ করার মত ব্যক্তিগত স্ট্যাটাস তার নেই। কিন্তু আশ্বস্ত হয় প্রিসকা খলিফা এর কথায়। তিনি বাহার উদ্দিনকে তার মনোনীত ব্যারিস্টার কলিম উল্ল্যার সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। তার কথামত ব্যারিস্টার কলিম উল্ল্যার সাথে বাহার উদ্দিন ই-মেইলে যোগাযোগ করে। শুরু হয় প্রতারণার পর্ব।

প্রথমে ব্যারিস্টার সাহেব বাহার উদ্দিনকে তার জাতীয় পরিচয় পত্র এফিডেভিট করে ১২৮০ ইউ এস ডলারসহ পাঠানোর পরামর্শ দেয়। পরামর্শ অনুযায়ী বাহার উদ্দিন প্রথমে জাতীয় পরিচয় পত্র এফিডেভিট করে পাঠায়। ব্যারিস্টার কলিম উল্ল্যাহ তাকে লিমা আক্তার নামের সিটি ব্যাংক লিমিটেড এর একাউন্ট নম্বারে ১২৮০ ইউ এস ডলার এর সমপরিমাণ বাংলাদেশী টাকা জমা প্রদানের জন্য অনুরোধ করেন। তিনি তার কথা মত উত্তরা পশ্চিম থানাধীন বারেক মঞ্জিল, ৮ রবীন্দ্র স্মরণী, সেক্টর-৭ এ অবস্থিত সিটি ব্যাংকে উক্ত লিমা আক্তার এর একাউন্টে নগদ ১,০২,১৪৪ টাকা জমা করেন। পরবর্তীতে ব্যারিস্টার কলিম উল্লাহ তার নিকট প্রিসকা খলিফা এর বাবার রয়েল ব্যাংকে থাকা অর্থ গ্রহণ করার জন্য ভিকটিমের নিকট পাওয়ার অফ অটর্নী সহ কিছু কাগজপত্র প্রেরণ করে।

এরপর ব্যারিস্টার জানায় বাহার উদ্দিনের নামে অর্থ ট্রান্সফার করার জন্য তাকে ব্রিটিশ হাইকোর্ট হতে ফাইনাল ক্লিয়ারেন্স আনতে হবে এবং লন্ডন যাওয়া-আসা ও অন্যান্য খরচ বাবদ তাকে ৭৭৫০ ইউ এস ডলার দিতে হবে। তার কথা মত ভিকটিম পুনরায় লিমা আক্তার এর সিটি ব্যাংকের একাউন্টে নগদ ৫,০৯০০০/- টাকা প্রদান করেন। এভাবে আরো বিভিন্ন ব্যাংক একাউন্টে বিভিন্ন অজুহাতে বিভিন্ন অংকে টাকা পাঠাতে বললে বাহার উদ্দিন সর্বমোট ১৭ লক্ষ টাকা পাঠান। এক পর্যায়ে ব্যারিস্টার সাহেবের টাকা আত্মসাতের কলাকৌশল বাহার উদ্দিন বুঝতে পারেন ততদিনে দেরি হয়ে গেছে অনেক। তার জমির বন্ধকির টাকা, সারা জীবনের সঞ্চয়সহ সুদের উপরে গ্রহণ করা ঋণের টাকা সবই আজ মিথ্যা মায়াজালের কাছে খোয়া গেছে।
বাকরুদ্ধ বাহার উদ্দিন দিশেহারা হয়ে ডিবি কার্যালয়ে ছুটে আসলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন ডিবি (উত্তর) বিভাগ।

তার অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা উত্তর বিভাগের একটি টিম। এরই ফলশ্রুতিতে গত ২৬ জুলাই ২০১৭ তারিখ ১৪.৪৫ টায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে এ ঘটনায় জড়িত ৪ জন নাইজেরিয়ান নাগরিকসহ প্রতারক চক্রের ৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তারকৃতরা হল- লিজা আক্তার, তার কথিত স্বামী নাইজেরিয়ান জন আগডি ইউজিও, আফেজ, মাইকেল ইউজিনি ব্রাউন, নামডি কেলভিন মেসার্স মহসীন প্লাম্বিং সার্ষি সেন্টার এর মালিক মো. মহসিন শেখ ও তার স্ত্রী মোছা. তাসমিয়া পারভীন ওরফে শিমু।

বৃহস্পতিবার ডিএমপি’র মিডিয়া সেন্টারে এ বিষয়ে যুগ্ম পুলিশ কমিশনার আব্দুল বাতেন এক প্রেস ব্রিফিং এ বলেন-বিদেশী প্রতারকগণ তাদের এদেশের এজেন্ট (প্রতারক) এর মাধ্যমে বিভিন্ন ফন্দি এঁটে বিভিন্ন কৌশলে মানুষকে প্রতারিত করে আসছে।
প্রতারণার কৌশল উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতারকরা ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযেগের মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদে ফেলে, ই-মেলের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকের ভুয়া কাগজপত্র প্রেরণ করে বিশ্বাস জন্মানোর পর অধিক টাকার লোভ দেখিয়ে প্রতারণা করে টাকা পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, গ্রেপ্তারকৃত লিজার ব্যাংক এ্যাকাউন্ট থেকে বিগত এক মাসে প্রায় এক কোটি টাকার উপরে লেনদেন হয়েছে।

আব্দুল বাতেন বলেন, এইসব বিদেশী নাগরিকদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করলে আদালত থেকে তারা জামিন নিয়ে পুনরায় একই অপরাধমূলক কাজ করে থাকে। এসব অপরাধীদের এদেশের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তারা পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে দেয় অথবা লুকিয়ে রাখে। ফলে তারা কোনো দেশের নাগরিক তা শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। দেশবাসীকে এসব প্রতারণা থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, কেউ যেন এই ধরনের লোভে পড়ে প্রতারিত না হন। এই বিষয়টি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য মিডিয়াকে অনুরোধ জানান।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর