ঢাকা ০৭:৩৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ব্যাংক জালিয়াতির সব দরজা এখন বন্ধ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:১২:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ অগাস্ট ২০১৫
  • ৩৭০ বার

প্রান্তিক মানুষের অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান দেশের ব্যাংকিংসেবাকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক পদক্ষেপ এখন ব্যাংকিং ক্ষেত্রে বিশ্বের কাছে মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। মালয়েশিয়া ও চীনসহ অনেক দেশ শিখতে চাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংসেবার বিষয়ে। তিনি দেশের ব্যাংকিং খাতকে মানবিক ব্যাংকিংয়ে রূপ দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য দেশের ব্যাংকগুলোকে শহর ছেড়ে গ্রামমুখী করতে সর্বাত্দক চেষ্টা করছেন। কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষকে ব্যাংকিংসেবার আওতায় আনতে ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা, বর্গা চাষিদের জন্য পৃথক ঋণ তহবিল গঠন, মৌ চাষিদের জন্য পৃথক তহবিলসহ বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন এই গভর্নর। সফলও হয়েছেন। আবার ব্যাংক খাতের জালিয়াতি বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি বৃদ্ধিসহ ব্যাংকগুলোর নিজস্ব তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। এমনকি অনিয়মের দায়ে বেসরকারি ব্যাংকে পর্যবেক্ষকও বসিয়েছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারির দায়ে পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নজির সৃষ্টি করেছেন ব্যাংকিং ইতিহাসে। ড. আতিউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে দেশের অর্থনীতি, ব্যাংকব্যবস্থা, ব্যাংক খাতের জালিয়াতি, অনিয়ম, আবাসন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতাসহ সার্বিক বিষয়ে কথা বলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনে তার কার্যালয়ে এ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মানিক মুনতাসির ও আলী রিয়াজ

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনি সব সময় মানবিক ব্যাংকি নিয়ে কথা বলে থাকেন। এ বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করে বলুন।

আতিউর রহমান : ব্যাংকিংসেবাকে আমরা মানবিক ব্যাংকিং হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আমাদের মানবিক ব্যাংকিং কনসেপ্ট এখন সারা বিশ্বের রোল মডেল। আমি চাই ব্যাংক হবে গরিব সাধারণ মানুষের ব্যাংক। ধনীদের জন্য বিশেষ ব্যাংক নয়। শুধু বাণিজ্য নয়, মানুষের সেবায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যাংকিং খাত প্রতিষ্ঠা করা আমার লক্ষ্য। করপোরেট সোস্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) কার্যক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আলাদা ‘সিএসআর ফান্ড’ গঠন করেছে। মানবিক ব্যাংকিংসেবা সবার কাছে পৌঁছে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম আমরা চালু করেছি। ব্যাংকিংসেবাকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজ করতে মানুষের দোরগোড়ায় ব্যাংকিংসেবা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্যাংকিংসেবাকে আরও সহজ ও দ্রুত করার জন্য ফেসবুক, টুইটার ব্যবহার করা হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক যুক্ত হয়েছে। গ্রাহকরা ব্যাংক সম্পর্কে অভিযোগ ফেসবুকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে দিতে পারবেন। এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হতে পারবেন যে কেউ।

বা : প্র : চলতি অর্থবছরের প্রাক্কলিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ অর্জন সম্ভব কি না?

আতিউর রহমান: গত কয়েক বছর ধরেই আমাদের প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল। গত অর্থবছরেও এটা সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি হয়েছে। এ বছর যেভাবেই হোক প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ওপরে নিয়ে যাবই। প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। আমাদের বাজারব্যবস্থা, অবকাঠামো আরেকটু উন্নত হলে মুদ্রানীতি আরও নমনীয় করা যেত। বছরের শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিরতায় আমাদের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর পরও প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশ হয়েছে। আগামী ছয় মাসে কোনো ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। ফলে এ বছর প্রবৃদ্ধি আরও বৃদ্ধি পেয়ে ৭ শতাংশে অবশ্যই পৌঁছাবে। এ ছাড়া অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য নানাবিধ কর্মকাণ্ড চলছে। সড়ক অবকাঠামো উন্নত হলে সাধারণ মানুষ অনেক বেশি উপকৃত হয়। বিশেষ করে গ্রামীণ করে কৃষকরা এর সুফল পায়। অবকাঠামো ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়ায় আগামীতে আমাদের প্রবৃদ্ধি অনেক ওপরে পৌঁছাবে বলে আমার বিশ্বাস।

বা: প্র: হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা কী ছিল। আর বেরিয়ে যাওয়া টাকা উদ্ধারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী ভূমিকা পালন করছে বলে আপনি মনে করেন।

আতিউর রহমান : সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা কোনো ঋণের ঘটনা ছিল না। সেটা ছিল সে ফ একটা চুরির ঘটনা। সেটা কোনো ঋণ ছিল না। সেটা ছিল জালিয়াতি। সোনালী ব্যাংকের কাছে কোনো ডকুমেন্টও নেই। ফলে সেই টাকা ঋণ হিসেবে তোলাও যাবে না। আবার আইনের নানা বিষয় তো আছেই। হলমার্কের ঘটনার জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে তো সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুরুতেই তাদের ব্যাপারে শাস্তির সুপারিশ করেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো সে অবস্থানে রয়েছে। এটি তো ছিল চুরির ঘটনা। ফলে যারা চুরি করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। আর টাকা উত্তোলনের ব্যাপারে সোনালী ব্যাংক চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে সোনালী ব্যাংক কিছু টাকা তুলতেও পেরেছে। বাকিটাও তোলা সম্ভব। তবে এর জন্য সময়ের প্রয়োজন। কেননা সোনালী ব্যাংকের হাতে তো কোনো ডকুমেন্ট নেই। ফলে মামলা চালিয়ে টাকা উদ্ধার কতটা সম্ভব সেটাও দেখতে হবে। এ ছাড়া চোর ধরার জন্য যা করা দরকার সোনালী ব্যাংক তা-ই করছে। এখন এর চেয়ে বেশি আর কী করবেন? চুরি করা টাকা তো আর এত সহজে ওঠানো যায় না। যারা এর সঙ্গে জড়িত তার সবাই শাস্তি পাচ্ছে, পাবে। আর হলমার্কের টাকা উদ্ধার হয়নি বলে যে ব্যাংক খাত বসে থাকবে তা তো হয় না।

বা: প্র: হলমার্কের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হওয়ার জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

আতিউর রহমান : সব মিলিয়ে এ কাজের জন্য সময়ের প্রয়োজন। তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের জালিয়াতির সব দরজা বন্ধ করা হয়েছে। ব্যাংক খাতের জালিয়াতি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে দায়ীদের চাকরিচ্যুত করা হবে। এতে প্রধান নির্বাহী বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকদেরও পর্যন্ত চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হবে। এ ধরনের ঘটনা আর যাতে না ঘটে সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে হলমার্কের মতো ঘটনা যাতে না ঘটে তার সব দরজা বন্ধ করা হয়েছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর নজরদারি ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী। প্রতিদিন কোনো না কোনো ব্যাংককে অনিয়মের দায়ে জরিমানা করা হচ্ছে। প্রতিটি ব্যাংকে নজরদারি জন্য একজন করে দক্ষ অফিসার (যুগ্ম পরিচালক পদের) নিয়োগ করা আছে। তারা নিয়মিত ভিজিল্যান্স করছেন। ইনকোয়ারি করছেন। কোনো ব্যাংকে যে কোনো ধরনের অনিয়মের খবর পাওয়া গেলে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক যে কোনো সময় যে কোনো ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করতে পারে এবং তা করছে। এতে ব্যাংক খাতের ভিত আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় শক্তিশালী ও মজবুত হয়ে উঠেছে। ফলে এখন চাইলেও কেউ আইবিপির মাধ্যমে ঋল জালিয়াতি করতে পারবে না। এখন দেশের ব্যাংকগুলোর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী।

বা: প্র: অর্থমন্ত্রী বলেছেন রাজনৈতিক কারণে হলমার্কের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব আছে কি না?

আতিউর রহমান : বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক চাপমুক্ত রয়েছে। এটি একটি স্বাধীন সংস্থা। শতভাগ স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করছে। এখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অকার্যকর। ফলে হলমার্কের ঘটনায় অর্থমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, সেটা কী হিসেবে বলেছেন, তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো জালিয়াতি বা যে কোনো ধরনের অনিয়মের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে তদন্ত করে এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। আগে তো যাকেতাকে ব্যাংকের বোর্ড মেম্বার করা হতো। এখন কিন্তু তা নেই। আমাদের কাছে লিস্ট পাঠালে আমরা এখন ভেটো দিই যে, উনি কেন? উনি তো যোগ্য নন। ফলে এখন পরিস্থিতি কিন্তু অন্য রকম। আমরা অনেক প্রস্তাব ফেরত দিয়েছি। এটা দেওয়া যাবে না, ওটা দেওয়া যাবে না।

বা: প্র: বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কী পদক্ষেপ নিয়েছে?

আতিউর রহমান : বেসিক ব্যাংকের ঘটনাও কিন্তু উদ্বেগজনক। সেখানে পর্যবেক্ষক বসানো হয়েছিল। পুরো বোর্ড ভেঙে ফেলা হয়েছে। বোর্ডে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ফলে বেসিক ব্যাংকের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে। ব্যাংকটি আবারও উঠে দাঁড়াবে। আগের মতো গুছিয়ে কাজ করবে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। দু-এক জায়গায় ছাড় দেওয়া হচ্ছে, যাতে ব্যাংকটি দাঁড়াতে পারে। সর্বোপরি আমরা যে পরিদর্শন রিপোর্ট দিয়েছি সে অনুযায়ী দুর্নীতি দমন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ব্যবস্থা নিলে এর একটি সুষ্ঠু সমাধান বেরিয়ে আসবে। দোষীরাও শাস্তি পাবে। আর ব্যাংকের গ্রাহকরাও স্বস্তি পাবেন।

বা: প্র: বিশ্ববাজারে কমলেও দেশীয় বাজারে সরকার জ্বালানি তেলের দাম কমাচ্ছে না- এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

আতিউর রহমান : বিশ্বব্যাপী বর্তমানে জ্বালানি তেলে দাম কমছে। আমাদের দেশীয় বাজারেই এটা সহনীয়। কিন্তু সরকার চাইলে হয়তো এটাকে আরেকবার সমন্বয় করতে পারে। এটা সরকারি সিদ্ধান্ত। গ্রাহকের কাছে এখনো কমের সুবিধা পৌঁছাতে পারিনি। সরকার চাচ্ছিল ভর্তুকি কমিয়ে আনতে। এখন তা শূন্যে নেমে এসেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি কনভেনশনাল, নন কনভেনশনাল দুই এনার্জির দামই কমানো দরকার। তাহলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি একটা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই অর্থনীতিতে পরিণত হবে। তবে সরকার এসব ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। একটা সিগন্যাল তো রয়েছে যে, তারা বিদ্যুতের দাম এ মুহূর্তে বাড়াবে না। এমনকি গ্যাসের দাম বাড়ছে না। এটাও এক ধরনের ছাড়। দাম বাড়িয়ে দিলে তো সেটা উল্টো দিকে যেত।

বা: প্র: পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ভূমিকা রাখছে। সে সম্পর্কে কিছু বলবেন?

আতিউর রহমান : আমরা গ্রিন ও পরিবেশবান্ধব যে উদ্যোগগুলো নিয়েছি সেগুলো এখন সারা বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে। সে জন্য অনেক বিনিয়োগকারী আমাদের মাধ্যমে এগুলো নিতে চাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ শাখা আমাদের অ্যাক্রিডেশন দিয়েছে ইমলিমেন্টিং এজেন্সি হিসেবে। সুতরাং পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের জন্য আমরা সেখান থেকেও টাকা পাব। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ডেভেলপমেন্টাল সেন্ট্রাল ব্যাংক। এখন সবাই আমাদের ইমলিমেন্টিং এজেন্সি হিসেবে কাজে লাগাতে চায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ মডেলটা অনেকে কাজে লাগাতে চায়। বর্তমানে চীন সেটা কাজে লাগাচ্ছে। তারা এখনো আমাদের মতো এতটা ইনভল্ভ নয়। তারা সবাই শিখতে চাচ্ছে। আমাদের এ কনসেপ্টটা একেবারে নতুন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক হচ্ছে পাইওনিয়ার।

বা: প্র: বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী ভূমিকা রাখছে?

আতিউর রহমান : বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ এখন অত্যন্ত ভালো। বিদেশিরা আসছেন। বিনিয়োগ করছেন। কেননা বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অত্যন্ত স্থিতিশীল রয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে প্রায় তিন মাস যে পরিস্থিতি ছিল, সে সময় অনেক বিনিয়োগকারী ফিরে গেছেন। তারা তখন অত্যন্ত আতঙ্কে ছিলেন। বর্তমানে সে পরিবেশ নেই। আর আগামী এক-দেড় বছরের মধ্যে রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হতে পারে- এ ধরনের কোনো আশঙ্কা নেই। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্বচ্ছন্দে বিনিয়োগ করছেন।

বা: প্র: দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ অন্য ব্যাংকগুলোর কী ধরনের কাজ করছে বলে মনে করেন?

আতিউর রহমান : অবকাঠামোর উন্নয়নের জন্য রিজার্ভ থেকে ২০০ মিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যে পৃথক করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল দিচ্ছে। এ ছাড়া অবকাঠামোসংক্রান্ত বড় বড় যেসব প্রকল্প চলমান রয়েছে সেগুলো সমাপ্ত হলে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে। আইএফসির মাধ্যমে অপসোর টাকা বন্ড নামে ১০০ কোটি টাকার একটি বন্ড ইস্যু করা হবে। এখানে বিদেশিরা বন্ড কিনতে পারবেন। সে অর্থ দেশের রাস্তাঘাট, সেতুসহ অন্যান্য অবকাঠামোর উন্নয়নে ব্যয় করা হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার চাইলে সরকারকেও অর্থ দেওয়া হবে। কিংবা বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদেরও দেওয়া হবে। এসব কাজ করলে অবকাঠামো খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। এসব বিষয় বিবেচনা করলে বলতে পারি, আমরা এখন স্বস্তিদায়ক সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছি।

বা: প্র: বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি কোন পর্যায়ে রয়েছে? একটু ব্যাখ্যা করুন।

আতিউর রহমান : বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি অত্যন্ত স্থিতিশীল রয়েছে। প্রায় সব সূচক একই সঙ্গে স্থিতিশীল রাখাটা কঠিন। বর্তমানে তা রয়েছে। এর বড় কারণ রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল রয়েছে। এ জন্য সব সূচক ইতিবাচকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে। আমার সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। কেননা মূল্যস্ফীতি বাড়লে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গরিবরা। গরিবের প্রধান শত্রু হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। এতে তাদের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে উৎপাদন ও সরবরাহ চেন সঠিক পথে থাকায়। বর্তমানে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় প্রকার মূল্যস্ফীতিই সহনীয় রয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে সঠিক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে পারায়। এ ছাড়া রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, আমদানি-রপ্তানি সব সূচকই ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। তবে দেশের অবকাঠামো যদি একটু উন্নত হতো। মার্কেট চেনটা যদি স্মুথ হতো। বিশেষ করে গ্রাম থেকে শহরের যোগাযোগব্যবস্থা যদি সহজ হতো, তাহলে গ্রামের মানুষের উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য কম দামে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যেত। এতে একদিকে উৎপাদকরা ন্যায্য মূল্য পেত। অন্যদিকে ভোক্তাসাধারণও কম দামে শাকসবজি পেত। ফলে মূল্যস্ফীতি আরও কমে আসত, যা সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলত।

বা: প্র: ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ব্যাংককে কোথায় দেখতে চান?

আতিউর রহমান : বাংলাদেশ ব্যাংক এখন একটি ডেভেলপমেন্ট হিউম্যান ব্যাংক। আমি গতানুগতিক লুকিয়ে থাকা গভর্নর নই। আমি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক হচ্ছে রাষ্ট্রের। আর রাষ্ট্র হচ্ছে জনগণের। ফলে আমি জনগণের গভর্নর। জনকল্যাণের গভর্নর। আমি তো প্রথম দিন থেকেই মানবিক ব্যাংকিংয়ের কথা বলে আসছি। কেননা ধনীদের সম্পদের ভিতরে গরিবের একটা হক আছে। সেটাতে সামাজিক দায়বদ্ধতা নামে (সিএসআর) ব্যাংকগুলোকে দায়িত্ব পালনের জন্য উদ্বুদ্ধ করে আসছি। এতে ব্যাপক সাড়াও পাওয়া গেছে। এতে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারছে। এটাই তো মানবিক ব্যাংকিং। ব্যাংক শুধু ধনীদের জন্য হবে না। ব্যাংক হবে সবার। এটা বাস্তবতায় মানাতে হবে। বিশ্বের কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই এতটা গণমুখী নয় বা এতটা উন্নয়নমুখী নয়। এখন অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনুসরণের চেষ্টা করছে। বিশেষ করে চীন ও মালয়েশিয়ার মতো দেশও আমাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিচ্ছে।

বা: প্র: বাংলাদেশ ব্যাংকের রিফাইন্যান্স তহবিলগুলোর বিষয়ে কিছু বলুন।

আতিউর রহমান : কৃষি খাতের জন্য রিফাইন্যান্স স্কিম রয়েছে, বিশেষ করে বর্গা চাষিদের জন্য ৫০০ কোটি টাকার রিফাইন্যান্স তহবিল গঠন করা হয়েছে। এটির ব্যাপক সাড়াও পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি গাভী চাষের জন্য একটি রিফাইন্যান্স তহবিল করা হয়েছে। নতুন করে যারা চা বাগান করতে চান তাদের জন্য ১০০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে মাত্র কয়েক দিন আগে। এ ছাড়া আরও অনেক রিফাইন্যান্স তহবিল রয়েছে, যেগুলো দেশের শুধু অর্থনীতিরই নয় সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বা: প্র: আবাসন খাতের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী ভাবছে?

আতিউর রহমান : মানুষের একটি মৌলিক চাহিদা আবাসন। আমাদের দেশটা অনেক ছোট কিন্তু জনসংখ্যা অনেক বেশি। সীমিত সম্পদ আর জমি-জায়গাতেই সবার সুন্দর আবাসন গড়ে তুলতে হচ্ছে। এ জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে এগোতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে আবাসন খাতের জন্যও একটি রিফাইন্যান্স তহবিল চালু রয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সেটি সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল। এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তাই নতুন করে ভাবা শুরু করেছি। বিশেষ করে যারা নিচের দিকের গরিব-নিম্নবিত্ত তাদের জন্য ভাবছি। যারা ৬০০ বা ৬৫০ বর্গফুটের মতো ফ্ল্যাটে বাস করার উপযোগী তাদের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভাবছে- কী করে সহজেই তাদের আবাসন গড়ে দেওয়া যায়। তাদের জন্য বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায় কি না বা তাদের আবাসন গড়ে দিতে নতুন কোনো স্কিম চালু করা যায় কি না- কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে চিন্তাভাবনা করছে। এ ক্ষেত্রে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। তাদের সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করে খুব শিগগিরই এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বা: প্র: গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো বর্তমানে সময়োপযোগী হবে কি না?

আতিউর রহমান : দেখুন, মূল্যস্ফীতি এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির চাপটা বেড়ে যায়, যা গরিব ও নিম্ন শ্রেণির মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে। এ জন্য দ্রব্যমূল্যটা সব সময়ই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। আর গ্যাস-বিদ্যুতের ক্ষেত্রে- এখানে সরকার তো ইতিমধ্যে একটি সিগন্যাল দিয়েছে যে, এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে না। এমনকি গ্যাসের দামও বাড়ছে না। ফলে এটা সরকারের একটা সিগন্যাল যে, আমরা স্থিতিশীল রয়েছি। আর জ্বালানি তেলের দাম কমানো হবে কি না, সেটা সরকারের সিদ্ধান্ত। তবে যেহেতু মূল্যস্ফীতি সহনীয় রয়েছে তাই সরকার এখন এটা নিয়ে ভাবতে পারে। এ মুহূর্তে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হলে মূল্যস্ফীতি আরও কমে আসবে, যা সার্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাবই ফেলবে বলে আমার মনে হয়। এ ছাড়া সদ্য ঘোষিত মুদ্রানীতিও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিসহায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সব ব্যবস্থাই মুদ্রানীতিতে নেওয়া হয়েছে।

বা: প্র: দেশের নতুন ব্যাংকগুলোর বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

আতিউর রহমান : প্রায় সব কটি নতুন ব্যাংকই ভালো চলছে। কেননা এখন পর্যন্ত তাদের এনপিএল জিরো। এটা একটা ভালো দিক। দু-একটি ব্যাংক ছাড়া বাকিগুলো ভালোভাবে কাজ করছে। আর নতুন অবস্থায় তো একটু-আধটু সমস্যা থাকবেই। ফলে আরও ভালো করতে আরও সময়ের প্রয়োজন। তাদের কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা রয়েছে। সেগুলোতে আমরা সহায়তা দিচ্ছি। নতুন বলে ভুল হতেই পারে। তবে এখন পর্যন্ত এমন কোনো কাজ করছে না যে অন্য ব্যাংকগুলোর চেয়ে খারাপ করছে। এখন কোনো ব্যাংকে যে কোনো ধরনের জালিয়াতি ঘটলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে। প্রয়োজনে ব্যাংকে অবজারভার নিয়োগ করা হবে। এমনকি এ ঘটনার সঙ্গে প্রধান নির্বাহী জড়িত থাকলে তাকেও চাকরিচ্যুত করা হবে এবং সোনালী ও বেসিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে যা করা হয়েছে অন্য সব ব্যাংকের বেলায়ও সেটাই করা হবে। নিয়ম-শৃঙ্খলার ব্যাপারে কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

বা: প্র: মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছাতে হলে আর কী কী করণীয় রয়েছে?

আতিউর রহমান : মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে আমাদের দেশ ইতিমধ্যে নিম্নমধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এটা একটা স্বীকৃতি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন- এসব সূচকেও দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। অবকাঠামো খাতেও বেশ অগ্রগতি রয়েছে। আর সরকারের একটা লক্ষ্য রয়েছে। সে লক্ষ্য অর্জনে যেসব পরিকল্পনা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা কাজ করছে। এগুলো করতে পারলেই আমাদের দেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে সহায়তা দেওয়ার কথা সবই দেওয়া হচ্ছে।

বা: প্র: ব্যবসায়ীরা (আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে জমি চাষের জন্য) বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগ করছেন- এ প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী?

আতিউর রহমান : দেখুন, আমাদের দেশে জমি চাষের জন্য যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ফলে এখানেই বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু যেসব শিল্প ভালো করছে- যেমন ওষুধশিল্প নিয়ে যদি কেউ সব নিয়ম-কানুন মেনে বিদেশে বিনিয়োগ করতে চায় সেটা তো সরকার অনুমতি দিচ্ছে। যেমন আমাদের ওষুধশিল্পের দু-একটি কোম্পানি দেশের বাইরে গিয়ে বিনিয়োগ করছে। আমরা সেটা অনুমতি দিয়েছি। এ ছাড়া মিয়ানমারে পেট্রলিয়াম জাতীয় পদার্থ উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে। আমরা সেটার অনুমতি দিয়েছি। কিন্তু আমরা চাচ্ছি যে দেশের ভিতরের বিনিয়োগটা যেন বাড়ে। কেননা বিনিয়োগ ছাড়া কর্মসংস্থান বাড়বে না। আর কর্মসংস্থান ছাড়া অর্থনীতির উন্নয়ন বা দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।

বা: প্র: আমাদের জনসংখ্যা আর ব্যাংকের অনুপাত সম্পর্কে কিছু বলুন।

আতিউর রহমান : আমাদের অর্থনীতির পরিধি দিন দিন বড় হচ্ছে। জনসংখ্যাও বাড়ছে। মানুষের চাহিদা বাড়ছে। কাজের ক্ষেত্রও বাড়ছে। হয়তো চাহিদা অনুপাতে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে একটু কম। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রও তো প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এ জন্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমও এখন অনেক বেশি বিস্তৃত। আমদানি-রপ্তানি-বাণিজ্যের আকারও অনেক বৃহৎ। শুধু তৈরি পোশাক খাতের কথাই ধরুন। বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এসব কার্যক্রমে ব্যাংকের ভূমিকা অনেক। ব্যাংক ছাড়া ঋণ কে দেবে যে, বিনিয়োগ হবে। এ ছাড়া দৈনন্দিন কাজেও তো মানুষকে ব্যাংকের দ্বারস্থই হতে হবে, তাই না? অর্থনীতির আকার বিবেচনায় নতুন-পুরান সব ব্যাংকই ভালো করছে। বিশেষ করে নতুন নয়টির মধ্যে দু-একটি ছাড়া সব কটি ব্যাংক ভালো করছে। হয়তো তারা আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে এখনো শক্তিশালী হয়নি তবে যেভাবে চলছে তাতে দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে দু-একটি দুর্ঘটনাও ঘটছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংক খুব শক্ত হাতে হ্যান্ডেল করছে। এতে ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। আমরা তো নতুন ব্যাংক অনুমোদন দিয়ে বসে থাকিনি। গত পাঁচ-ছয় বছরে ব্যাংকিং খাতের মূলধন ভিত্তির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ব্যাংকগুলোর মুনাফার একটি বড় অংশ মূলধনে স্থানান্তর, পুনর্মূলধনীকরণ ও প্রভিশন ঘাটতি কমার ফলে ব্যাংকিংব্যবস্থার ভিত্তি আরও শক্তিশালী হয়েছে। ব্যাংকে সুশাসন এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংক নজরদারি বাড়িয়েছে।

বা: প্র: এ মুহূর্তে আমাদের ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা কী বলে আপনি মনে করেন?

আতিউর রহমান : আমাদের দেশে ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। খেলাপি ঋণের হার সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনার জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো কোনো সিস্টেমিক ঝুঁকির সম্মুখীন হয়নি। এমনকি বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার চরম পর্যায়েও তা ঘটেনি। কিন্তু খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতে এখনো উদ্বেগজনক। তবে খেলাপি কমিয়ে আনতে আমরা ব্যাংকগুলোকে চাপ দিয়ে যাচ্ছি। প্রতিনিয়ত ব্যাংকের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। আশার কথা হচ্ছে, খেলাপির হার অচিরেই কমে আসবে। কেননা ব্যাংকগুলো নিজ নিজ জায়গা থেকে সর্বাত্দক চেষ্টা করছে খেলাপি ঋণ আদায় করতে এবং নতুন করে আর কোনো ঋণ যাতে খেলাপি না হয় সেদিকে কড়া দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।

বা: প্র: মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রসার এবং এর সমস্যা সম্পর্কে কিছু বলুন।

আতিউর রহমান : মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষ উপকৃত হচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চল বিশেষ করে দুর্গম এলাকার মানুষ ব্যাংকিংসেবার আওতায় এসেছে। খুব সহজেই গ্রাহক তাদের টাকা আদান-প্রদান করতে পারছে। এ ব্যবস্থার দ্রুত প্রসার ঘটছে। ব্যাংকগুলোও এতে বেশ উৎসাহ দেখাচ্ছে। তবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং বা সন্ত্রাসে অর্থায়নের ব্যাপারে যেসব অভিযোগ রয়েছে সেগুলোতে তথ্য-প্রমাণের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। কেননা মোবাইল ব্যাংকিংয়েও কড়া নজরদারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ব্যাংক জালিয়াতির সব দরজা এখন বন্ধ

আপডেট টাইম : ০৪:১২:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ অগাস্ট ২০১৫

প্রান্তিক মানুষের অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান দেশের ব্যাংকিংসেবাকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক পদক্ষেপ এখন ব্যাংকিং ক্ষেত্রে বিশ্বের কাছে মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। মালয়েশিয়া ও চীনসহ অনেক দেশ শিখতে চাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংসেবার বিষয়ে। তিনি দেশের ব্যাংকিং খাতকে মানবিক ব্যাংকিংয়ে রূপ দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য দেশের ব্যাংকগুলোকে শহর ছেড়ে গ্রামমুখী করতে সর্বাত্দক চেষ্টা করছেন। কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষকে ব্যাংকিংসেবার আওতায় আনতে ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা, বর্গা চাষিদের জন্য পৃথক ঋণ তহবিল গঠন, মৌ চাষিদের জন্য পৃথক তহবিলসহ বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন এই গভর্নর। সফলও হয়েছেন। আবার ব্যাংক খাতের জালিয়াতি বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি বৃদ্ধিসহ ব্যাংকগুলোর নিজস্ব তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। এমনকি অনিয়মের দায়ে বেসরকারি ব্যাংকে পর্যবেক্ষকও বসিয়েছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারির দায়ে পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নজির সৃষ্টি করেছেন ব্যাংকিং ইতিহাসে। ড. আতিউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে দেশের অর্থনীতি, ব্যাংকব্যবস্থা, ব্যাংক খাতের জালিয়াতি, অনিয়ম, আবাসন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতাসহ সার্বিক বিষয়ে কথা বলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনে তার কার্যালয়ে এ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মানিক মুনতাসির ও আলী রিয়াজ

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনি সব সময় মানবিক ব্যাংকি নিয়ে কথা বলে থাকেন। এ বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করে বলুন।

আতিউর রহমান : ব্যাংকিংসেবাকে আমরা মানবিক ব্যাংকিং হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আমাদের মানবিক ব্যাংকিং কনসেপ্ট এখন সারা বিশ্বের রোল মডেল। আমি চাই ব্যাংক হবে গরিব সাধারণ মানুষের ব্যাংক। ধনীদের জন্য বিশেষ ব্যাংক নয়। শুধু বাণিজ্য নয়, মানুষের সেবায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যাংকিং খাত প্রতিষ্ঠা করা আমার লক্ষ্য। করপোরেট সোস্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) কার্যক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আলাদা ‘সিএসআর ফান্ড’ গঠন করেছে। মানবিক ব্যাংকিংসেবা সবার কাছে পৌঁছে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম আমরা চালু করেছি। ব্যাংকিংসেবাকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজ করতে মানুষের দোরগোড়ায় ব্যাংকিংসেবা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্যাংকিংসেবাকে আরও সহজ ও দ্রুত করার জন্য ফেসবুক, টুইটার ব্যবহার করা হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক যুক্ত হয়েছে। গ্রাহকরা ব্যাংক সম্পর্কে অভিযোগ ফেসবুকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে দিতে পারবেন। এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হতে পারবেন যে কেউ।

বা : প্র : চলতি অর্থবছরের প্রাক্কলিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ অর্জন সম্ভব কি না?

আতিউর রহমান: গত কয়েক বছর ধরেই আমাদের প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল। গত অর্থবছরেও এটা সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি হয়েছে। এ বছর যেভাবেই হোক প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ওপরে নিয়ে যাবই। প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। আমাদের বাজারব্যবস্থা, অবকাঠামো আরেকটু উন্নত হলে মুদ্রানীতি আরও নমনীয় করা যেত। বছরের শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিরতায় আমাদের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর পরও প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশ হয়েছে। আগামী ছয় মাসে কোনো ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। ফলে এ বছর প্রবৃদ্ধি আরও বৃদ্ধি পেয়ে ৭ শতাংশে অবশ্যই পৌঁছাবে। এ ছাড়া অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য নানাবিধ কর্মকাণ্ড চলছে। সড়ক অবকাঠামো উন্নত হলে সাধারণ মানুষ অনেক বেশি উপকৃত হয়। বিশেষ করে গ্রামীণ করে কৃষকরা এর সুফল পায়। অবকাঠামো ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়ায় আগামীতে আমাদের প্রবৃদ্ধি অনেক ওপরে পৌঁছাবে বলে আমার বিশ্বাস।

বা: প্র: হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা কী ছিল। আর বেরিয়ে যাওয়া টাকা উদ্ধারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী ভূমিকা পালন করছে বলে আপনি মনে করেন।

আতিউর রহমান : সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা কোনো ঋণের ঘটনা ছিল না। সেটা ছিল সে ফ একটা চুরির ঘটনা। সেটা কোনো ঋণ ছিল না। সেটা ছিল জালিয়াতি। সোনালী ব্যাংকের কাছে কোনো ডকুমেন্টও নেই। ফলে সেই টাকা ঋণ হিসেবে তোলাও যাবে না। আবার আইনের নানা বিষয় তো আছেই। হলমার্কের ঘটনার জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে তো সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুরুতেই তাদের ব্যাপারে শাস্তির সুপারিশ করেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো সে অবস্থানে রয়েছে। এটি তো ছিল চুরির ঘটনা। ফলে যারা চুরি করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। আর টাকা উত্তোলনের ব্যাপারে সোনালী ব্যাংক চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে সোনালী ব্যাংক কিছু টাকা তুলতেও পেরেছে। বাকিটাও তোলা সম্ভব। তবে এর জন্য সময়ের প্রয়োজন। কেননা সোনালী ব্যাংকের হাতে তো কোনো ডকুমেন্ট নেই। ফলে মামলা চালিয়ে টাকা উদ্ধার কতটা সম্ভব সেটাও দেখতে হবে। এ ছাড়া চোর ধরার জন্য যা করা দরকার সোনালী ব্যাংক তা-ই করছে। এখন এর চেয়ে বেশি আর কী করবেন? চুরি করা টাকা তো আর এত সহজে ওঠানো যায় না। যারা এর সঙ্গে জড়িত তার সবাই শাস্তি পাচ্ছে, পাবে। আর হলমার্কের টাকা উদ্ধার হয়নি বলে যে ব্যাংক খাত বসে থাকবে তা তো হয় না।

বা: প্র: হলমার্কের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হওয়ার জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

আতিউর রহমান : সব মিলিয়ে এ কাজের জন্য সময়ের প্রয়োজন। তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের জালিয়াতির সব দরজা বন্ধ করা হয়েছে। ব্যাংক খাতের জালিয়াতি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে দায়ীদের চাকরিচ্যুত করা হবে। এতে প্রধান নির্বাহী বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকদেরও পর্যন্ত চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হবে। এ ধরনের ঘটনা আর যাতে না ঘটে সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে হলমার্কের মতো ঘটনা যাতে না ঘটে তার সব দরজা বন্ধ করা হয়েছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর নজরদারি ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী। প্রতিদিন কোনো না কোনো ব্যাংককে অনিয়মের দায়ে জরিমানা করা হচ্ছে। প্রতিটি ব্যাংকে নজরদারি জন্য একজন করে দক্ষ অফিসার (যুগ্ম পরিচালক পদের) নিয়োগ করা আছে। তারা নিয়মিত ভিজিল্যান্স করছেন। ইনকোয়ারি করছেন। কোনো ব্যাংকে যে কোনো ধরনের অনিয়মের খবর পাওয়া গেলে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক যে কোনো সময় যে কোনো ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করতে পারে এবং তা করছে। এতে ব্যাংক খাতের ভিত আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় শক্তিশালী ও মজবুত হয়ে উঠেছে। ফলে এখন চাইলেও কেউ আইবিপির মাধ্যমে ঋল জালিয়াতি করতে পারবে না। এখন দেশের ব্যাংকগুলোর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী।

বা: প্র: অর্থমন্ত্রী বলেছেন রাজনৈতিক কারণে হলমার্কের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব আছে কি না?

আতিউর রহমান : বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক চাপমুক্ত রয়েছে। এটি একটি স্বাধীন সংস্থা। শতভাগ স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করছে। এখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অকার্যকর। ফলে হলমার্কের ঘটনায় অর্থমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, সেটা কী হিসেবে বলেছেন, তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো জালিয়াতি বা যে কোনো ধরনের অনিয়মের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে তদন্ত করে এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। আগে তো যাকেতাকে ব্যাংকের বোর্ড মেম্বার করা হতো। এখন কিন্তু তা নেই। আমাদের কাছে লিস্ট পাঠালে আমরা এখন ভেটো দিই যে, উনি কেন? উনি তো যোগ্য নন। ফলে এখন পরিস্থিতি কিন্তু অন্য রকম। আমরা অনেক প্রস্তাব ফেরত দিয়েছি। এটা দেওয়া যাবে না, ওটা দেওয়া যাবে না।

বা: প্র: বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কী পদক্ষেপ নিয়েছে?

আতিউর রহমান : বেসিক ব্যাংকের ঘটনাও কিন্তু উদ্বেগজনক। সেখানে পর্যবেক্ষক বসানো হয়েছিল। পুরো বোর্ড ভেঙে ফেলা হয়েছে। বোর্ডে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ফলে বেসিক ব্যাংকের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে। ব্যাংকটি আবারও উঠে দাঁড়াবে। আগের মতো গুছিয়ে কাজ করবে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। দু-এক জায়গায় ছাড় দেওয়া হচ্ছে, যাতে ব্যাংকটি দাঁড়াতে পারে। সর্বোপরি আমরা যে পরিদর্শন রিপোর্ট দিয়েছি সে অনুযায়ী দুর্নীতি দমন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ব্যবস্থা নিলে এর একটি সুষ্ঠু সমাধান বেরিয়ে আসবে। দোষীরাও শাস্তি পাবে। আর ব্যাংকের গ্রাহকরাও স্বস্তি পাবেন।

বা: প্র: বিশ্ববাজারে কমলেও দেশীয় বাজারে সরকার জ্বালানি তেলের দাম কমাচ্ছে না- এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

আতিউর রহমান : বিশ্বব্যাপী বর্তমানে জ্বালানি তেলে দাম কমছে। আমাদের দেশীয় বাজারেই এটা সহনীয়। কিন্তু সরকার চাইলে হয়তো এটাকে আরেকবার সমন্বয় করতে পারে। এটা সরকারি সিদ্ধান্ত। গ্রাহকের কাছে এখনো কমের সুবিধা পৌঁছাতে পারিনি। সরকার চাচ্ছিল ভর্তুকি কমিয়ে আনতে। এখন তা শূন্যে নেমে এসেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি কনভেনশনাল, নন কনভেনশনাল দুই এনার্জির দামই কমানো দরকার। তাহলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি একটা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই অর্থনীতিতে পরিণত হবে। তবে সরকার এসব ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। একটা সিগন্যাল তো রয়েছে যে, তারা বিদ্যুতের দাম এ মুহূর্তে বাড়াবে না। এমনকি গ্যাসের দাম বাড়ছে না। এটাও এক ধরনের ছাড়। দাম বাড়িয়ে দিলে তো সেটা উল্টো দিকে যেত।

বা: প্র: পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ভূমিকা রাখছে। সে সম্পর্কে কিছু বলবেন?

আতিউর রহমান : আমরা গ্রিন ও পরিবেশবান্ধব যে উদ্যোগগুলো নিয়েছি সেগুলো এখন সারা বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে। সে জন্য অনেক বিনিয়োগকারী আমাদের মাধ্যমে এগুলো নিতে চাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ শাখা আমাদের অ্যাক্রিডেশন দিয়েছে ইমলিমেন্টিং এজেন্সি হিসেবে। সুতরাং পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের জন্য আমরা সেখান থেকেও টাকা পাব। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ডেভেলপমেন্টাল সেন্ট্রাল ব্যাংক। এখন সবাই আমাদের ইমলিমেন্টিং এজেন্সি হিসেবে কাজে লাগাতে চায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ মডেলটা অনেকে কাজে লাগাতে চায়। বর্তমানে চীন সেটা কাজে লাগাচ্ছে। তারা এখনো আমাদের মতো এতটা ইনভল্ভ নয়। তারা সবাই শিখতে চাচ্ছে। আমাদের এ কনসেপ্টটা একেবারে নতুন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক হচ্ছে পাইওনিয়ার।

বা: প্র: বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী ভূমিকা রাখছে?

আতিউর রহমান : বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ এখন অত্যন্ত ভালো। বিদেশিরা আসছেন। বিনিয়োগ করছেন। কেননা বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অত্যন্ত স্থিতিশীল রয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে প্রায় তিন মাস যে পরিস্থিতি ছিল, সে সময় অনেক বিনিয়োগকারী ফিরে গেছেন। তারা তখন অত্যন্ত আতঙ্কে ছিলেন। বর্তমানে সে পরিবেশ নেই। আর আগামী এক-দেড় বছরের মধ্যে রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হতে পারে- এ ধরনের কোনো আশঙ্কা নেই। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্বচ্ছন্দে বিনিয়োগ করছেন।

বা: প্র: দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ অন্য ব্যাংকগুলোর কী ধরনের কাজ করছে বলে মনে করেন?

আতিউর রহমান : অবকাঠামোর উন্নয়নের জন্য রিজার্ভ থেকে ২০০ মিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যে পৃথক করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল দিচ্ছে। এ ছাড়া অবকাঠামোসংক্রান্ত বড় বড় যেসব প্রকল্প চলমান রয়েছে সেগুলো সমাপ্ত হলে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে। আইএফসির মাধ্যমে অপসোর টাকা বন্ড নামে ১০০ কোটি টাকার একটি বন্ড ইস্যু করা হবে। এখানে বিদেশিরা বন্ড কিনতে পারবেন। সে অর্থ দেশের রাস্তাঘাট, সেতুসহ অন্যান্য অবকাঠামোর উন্নয়নে ব্যয় করা হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার চাইলে সরকারকেও অর্থ দেওয়া হবে। কিংবা বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদেরও দেওয়া হবে। এসব কাজ করলে অবকাঠামো খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। এসব বিষয় বিবেচনা করলে বলতে পারি, আমরা এখন স্বস্তিদায়ক সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছি।

বা: প্র: বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি কোন পর্যায়ে রয়েছে? একটু ব্যাখ্যা করুন।

আতিউর রহমান : বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি অত্যন্ত স্থিতিশীল রয়েছে। প্রায় সব সূচক একই সঙ্গে স্থিতিশীল রাখাটা কঠিন। বর্তমানে তা রয়েছে। এর বড় কারণ রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল রয়েছে। এ জন্য সব সূচক ইতিবাচকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে। আমার সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। কেননা মূল্যস্ফীতি বাড়লে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গরিবরা। গরিবের প্রধান শত্রু হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। এতে তাদের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে উৎপাদন ও সরবরাহ চেন সঠিক পথে থাকায়। বর্তমানে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় প্রকার মূল্যস্ফীতিই সহনীয় রয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে সঠিক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে পারায়। এ ছাড়া রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, আমদানি-রপ্তানি সব সূচকই ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। তবে দেশের অবকাঠামো যদি একটু উন্নত হতো। মার্কেট চেনটা যদি স্মুথ হতো। বিশেষ করে গ্রাম থেকে শহরের যোগাযোগব্যবস্থা যদি সহজ হতো, তাহলে গ্রামের মানুষের উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য কম দামে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যেত। এতে একদিকে উৎপাদকরা ন্যায্য মূল্য পেত। অন্যদিকে ভোক্তাসাধারণও কম দামে শাকসবজি পেত। ফলে মূল্যস্ফীতি আরও কমে আসত, যা সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলত।

বা: প্র: ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ব্যাংককে কোথায় দেখতে চান?

আতিউর রহমান : বাংলাদেশ ব্যাংক এখন একটি ডেভেলপমেন্ট হিউম্যান ব্যাংক। আমি গতানুগতিক লুকিয়ে থাকা গভর্নর নই। আমি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক হচ্ছে রাষ্ট্রের। আর রাষ্ট্র হচ্ছে জনগণের। ফলে আমি জনগণের গভর্নর। জনকল্যাণের গভর্নর। আমি তো প্রথম দিন থেকেই মানবিক ব্যাংকিংয়ের কথা বলে আসছি। কেননা ধনীদের সম্পদের ভিতরে গরিবের একটা হক আছে। সেটাতে সামাজিক দায়বদ্ধতা নামে (সিএসআর) ব্যাংকগুলোকে দায়িত্ব পালনের জন্য উদ্বুদ্ধ করে আসছি। এতে ব্যাপক সাড়াও পাওয়া গেছে। এতে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারছে। এটাই তো মানবিক ব্যাংকিং। ব্যাংক শুধু ধনীদের জন্য হবে না। ব্যাংক হবে সবার। এটা বাস্তবতায় মানাতে হবে। বিশ্বের কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই এতটা গণমুখী নয় বা এতটা উন্নয়নমুখী নয়। এখন অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনুসরণের চেষ্টা করছে। বিশেষ করে চীন ও মালয়েশিয়ার মতো দেশও আমাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিচ্ছে।

বা: প্র: বাংলাদেশ ব্যাংকের রিফাইন্যান্স তহবিলগুলোর বিষয়ে কিছু বলুন।

আতিউর রহমান : কৃষি খাতের জন্য রিফাইন্যান্স স্কিম রয়েছে, বিশেষ করে বর্গা চাষিদের জন্য ৫০০ কোটি টাকার রিফাইন্যান্স তহবিল গঠন করা হয়েছে। এটির ব্যাপক সাড়াও পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি গাভী চাষের জন্য একটি রিফাইন্যান্স তহবিল করা হয়েছে। নতুন করে যারা চা বাগান করতে চান তাদের জন্য ১০০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে মাত্র কয়েক দিন আগে। এ ছাড়া আরও অনেক রিফাইন্যান্স তহবিল রয়েছে, যেগুলো দেশের শুধু অর্থনীতিরই নয় সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বা: প্র: আবাসন খাতের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী ভাবছে?

আতিউর রহমান : মানুষের একটি মৌলিক চাহিদা আবাসন। আমাদের দেশটা অনেক ছোট কিন্তু জনসংখ্যা অনেক বেশি। সীমিত সম্পদ আর জমি-জায়গাতেই সবার সুন্দর আবাসন গড়ে তুলতে হচ্ছে। এ জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে এগোতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে আবাসন খাতের জন্যও একটি রিফাইন্যান্স তহবিল চালু রয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সেটি সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল। এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তাই নতুন করে ভাবা শুরু করেছি। বিশেষ করে যারা নিচের দিকের গরিব-নিম্নবিত্ত তাদের জন্য ভাবছি। যারা ৬০০ বা ৬৫০ বর্গফুটের মতো ফ্ল্যাটে বাস করার উপযোগী তাদের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভাবছে- কী করে সহজেই তাদের আবাসন গড়ে দেওয়া যায়। তাদের জন্য বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায় কি না বা তাদের আবাসন গড়ে দিতে নতুন কোনো স্কিম চালু করা যায় কি না- কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে চিন্তাভাবনা করছে। এ ক্ষেত্রে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। তাদের সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করে খুব শিগগিরই এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বা: প্র: গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো বর্তমানে সময়োপযোগী হবে কি না?

আতিউর রহমান : দেখুন, মূল্যস্ফীতি এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির চাপটা বেড়ে যায়, যা গরিব ও নিম্ন শ্রেণির মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে। এ জন্য দ্রব্যমূল্যটা সব সময়ই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। আর গ্যাস-বিদ্যুতের ক্ষেত্রে- এখানে সরকার তো ইতিমধ্যে একটি সিগন্যাল দিয়েছে যে, এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে না। এমনকি গ্যাসের দামও বাড়ছে না। ফলে এটা সরকারের একটা সিগন্যাল যে, আমরা স্থিতিশীল রয়েছি। আর জ্বালানি তেলের দাম কমানো হবে কি না, সেটা সরকারের সিদ্ধান্ত। তবে যেহেতু মূল্যস্ফীতি সহনীয় রয়েছে তাই সরকার এখন এটা নিয়ে ভাবতে পারে। এ মুহূর্তে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হলে মূল্যস্ফীতি আরও কমে আসবে, যা সার্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাবই ফেলবে বলে আমার মনে হয়। এ ছাড়া সদ্য ঘোষিত মুদ্রানীতিও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিসহায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সব ব্যবস্থাই মুদ্রানীতিতে নেওয়া হয়েছে।

বা: প্র: দেশের নতুন ব্যাংকগুলোর বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

আতিউর রহমান : প্রায় সব কটি নতুন ব্যাংকই ভালো চলছে। কেননা এখন পর্যন্ত তাদের এনপিএল জিরো। এটা একটা ভালো দিক। দু-একটি ব্যাংক ছাড়া বাকিগুলো ভালোভাবে কাজ করছে। আর নতুন অবস্থায় তো একটু-আধটু সমস্যা থাকবেই। ফলে আরও ভালো করতে আরও সময়ের প্রয়োজন। তাদের কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা রয়েছে। সেগুলোতে আমরা সহায়তা দিচ্ছি। নতুন বলে ভুল হতেই পারে। তবে এখন পর্যন্ত এমন কোনো কাজ করছে না যে অন্য ব্যাংকগুলোর চেয়ে খারাপ করছে। এখন কোনো ব্যাংকে যে কোনো ধরনের জালিয়াতি ঘটলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে। প্রয়োজনে ব্যাংকে অবজারভার নিয়োগ করা হবে। এমনকি এ ঘটনার সঙ্গে প্রধান নির্বাহী জড়িত থাকলে তাকেও চাকরিচ্যুত করা হবে এবং সোনালী ও বেসিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে যা করা হয়েছে অন্য সব ব্যাংকের বেলায়ও সেটাই করা হবে। নিয়ম-শৃঙ্খলার ব্যাপারে কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

বা: প্র: মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছাতে হলে আর কী কী করণীয় রয়েছে?

আতিউর রহমান : মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে আমাদের দেশ ইতিমধ্যে নিম্নমধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এটা একটা স্বীকৃতি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন- এসব সূচকেও দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। অবকাঠামো খাতেও বেশ অগ্রগতি রয়েছে। আর সরকারের একটা লক্ষ্য রয়েছে। সে লক্ষ্য অর্জনে যেসব পরিকল্পনা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা কাজ করছে। এগুলো করতে পারলেই আমাদের দেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে সহায়তা দেওয়ার কথা সবই দেওয়া হচ্ছে।

বা: প্র: ব্যবসায়ীরা (আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে জমি চাষের জন্য) বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগ করছেন- এ প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী?

আতিউর রহমান : দেখুন, আমাদের দেশে জমি চাষের জন্য যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ফলে এখানেই বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু যেসব শিল্প ভালো করছে- যেমন ওষুধশিল্প নিয়ে যদি কেউ সব নিয়ম-কানুন মেনে বিদেশে বিনিয়োগ করতে চায় সেটা তো সরকার অনুমতি দিচ্ছে। যেমন আমাদের ওষুধশিল্পের দু-একটি কোম্পানি দেশের বাইরে গিয়ে বিনিয়োগ করছে। আমরা সেটা অনুমতি দিয়েছি। এ ছাড়া মিয়ানমারে পেট্রলিয়াম জাতীয় পদার্থ উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে। আমরা সেটার অনুমতি দিয়েছি। কিন্তু আমরা চাচ্ছি যে দেশের ভিতরের বিনিয়োগটা যেন বাড়ে। কেননা বিনিয়োগ ছাড়া কর্মসংস্থান বাড়বে না। আর কর্মসংস্থান ছাড়া অর্থনীতির উন্নয়ন বা দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।

বা: প্র: আমাদের জনসংখ্যা আর ব্যাংকের অনুপাত সম্পর্কে কিছু বলুন।

আতিউর রহমান : আমাদের অর্থনীতির পরিধি দিন দিন বড় হচ্ছে। জনসংখ্যাও বাড়ছে। মানুষের চাহিদা বাড়ছে। কাজের ক্ষেত্রও বাড়ছে। হয়তো চাহিদা অনুপাতে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে একটু কম। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রও তো প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এ জন্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমও এখন অনেক বেশি বিস্তৃত। আমদানি-রপ্তানি-বাণিজ্যের আকারও অনেক বৃহৎ। শুধু তৈরি পোশাক খাতের কথাই ধরুন। বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এসব কার্যক্রমে ব্যাংকের ভূমিকা অনেক। ব্যাংক ছাড়া ঋণ কে দেবে যে, বিনিয়োগ হবে। এ ছাড়া দৈনন্দিন কাজেও তো মানুষকে ব্যাংকের দ্বারস্থই হতে হবে, তাই না? অর্থনীতির আকার বিবেচনায় নতুন-পুরান সব ব্যাংকই ভালো করছে। বিশেষ করে নতুন নয়টির মধ্যে দু-একটি ছাড়া সব কটি ব্যাংক ভালো করছে। হয়তো তারা আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে এখনো শক্তিশালী হয়নি তবে যেভাবে চলছে তাতে দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে দু-একটি দুর্ঘটনাও ঘটছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংক খুব শক্ত হাতে হ্যান্ডেল করছে। এতে ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। আমরা তো নতুন ব্যাংক অনুমোদন দিয়ে বসে থাকিনি। গত পাঁচ-ছয় বছরে ব্যাংকিং খাতের মূলধন ভিত্তির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ব্যাংকগুলোর মুনাফার একটি বড় অংশ মূলধনে স্থানান্তর, পুনর্মূলধনীকরণ ও প্রভিশন ঘাটতি কমার ফলে ব্যাংকিংব্যবস্থার ভিত্তি আরও শক্তিশালী হয়েছে। ব্যাংকে সুশাসন এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংক নজরদারি বাড়িয়েছে।

বা: প্র: এ মুহূর্তে আমাদের ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা কী বলে আপনি মনে করেন?

আতিউর রহমান : আমাদের দেশে ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। খেলাপি ঋণের হার সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনার জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো কোনো সিস্টেমিক ঝুঁকির সম্মুখীন হয়নি। এমনকি বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার চরম পর্যায়েও তা ঘটেনি। কিন্তু খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতে এখনো উদ্বেগজনক। তবে খেলাপি কমিয়ে আনতে আমরা ব্যাংকগুলোকে চাপ দিয়ে যাচ্ছি। প্রতিনিয়ত ব্যাংকের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। আশার কথা হচ্ছে, খেলাপির হার অচিরেই কমে আসবে। কেননা ব্যাংকগুলো নিজ নিজ জায়গা থেকে সর্বাত্দক চেষ্টা করছে খেলাপি ঋণ আদায় করতে এবং নতুন করে আর কোনো ঋণ যাতে খেলাপি না হয় সেদিকে কড়া দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।

বা: প্র: মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রসার এবং এর সমস্যা সম্পর্কে কিছু বলুন।

আতিউর রহমান : মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষ উপকৃত হচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চল বিশেষ করে দুর্গম এলাকার মানুষ ব্যাংকিংসেবার আওতায় এসেছে। খুব সহজেই গ্রাহক তাদের টাকা আদান-প্রদান করতে পারছে। এ ব্যবস্থার দ্রুত প্রসার ঘটছে। ব্যাংকগুলোও এতে বেশ উৎসাহ দেখাচ্ছে। তবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং বা সন্ত্রাসে অর্থায়নের ব্যাপারে যেসব অভিযোগ রয়েছে সেগুলোতে তথ্য-প্রমাণের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। কেননা মোবাইল ব্যাংকিংয়েও কড়া নজরদারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।