ঢাকা ০৩:৪৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাগ-পাতা খাইয়্যা রোজা রাখতাছি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:০৩:২৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ জুলাই ২০১৭
  • ২৮২ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ করিমগঞ্জ উপজেলার ইন্দাচুল্লী গ্রামের ফরিদ মিয়ার নিজের কোন জমি নেই। গত বোরো মৌসুমে তিলে তিলে জমানো সঞ্চয় ভেঙে পাঁচ একর জমি বন্দক রেখেছিলেন তিনি। পাশের কাশিপুর গ্রামে অস্থায়ী বসতি গড়ে সেই জমিতে করেছিলেন বোরো চাষ। তার বড় মেয়ে অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া মবিনূর মেরুদণ্ডের হাড় বাঁকা রোগে ভুগছে। মেয়ের চিকিৎসার জন্য মহাজনের কাছ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণও করতে হয়েছে তাকে। স্বপ্ন ছিল, জমির ধান কেটে ঋণ পরিশোধ করার পর সংসারের খরচ চালানোর পাশাপাশি অসুস্থ অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে মবিনুরের আরো উন্নত চিকিৎসা করাবেন। কিন্তু বিধিবাম! চৈত্রের আগাম বন্যায় তার সবটুকু জমি তলিয়ে গেছে। ঋণের চাপে ঘরে থাকা একমাত্র দুধেল গাভিটিও বিক্রি করতে হয়েছে তাকে। কাশিপুরের বসতবাড়িটি ইন্দাচুল্লী গ্রামে আনার জন্যও তার অনেক টাকা খরচ হয়েছে। কাশিপুর থেকে খালি হাতে ইন্দাচুল্লী গ্রামে ফিরলেও মহাজনের বিশাল ঋণের চাপ আর স্ত্রী, তিন মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে সাতজনের সংসার খরচ নিয়ে পড়েন মহাসংকটে। কোন উপায় না পেয়ে মেয়ে মবিনূরকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়ে ফরিদ মিয়া নিজেও কাজের খোঁজে ঘর ছেড়েছেন। স্ত্রী মরিয়ম জানালেন, এক সপ্তাহ আগে তার স্বামী বাড়ি ছাড়লেও এখনো কোন টাকা-পয়সা পাঠাতে পারেননি। এ পরিস্থিতিতে খেয়ে-না খেয়ে দিন কাটছে তাদের। মেয়ের অসুস্থতা বাড়লেও চিকিৎসা থেমে আছে। মরিয়ম বললেন, ‘রোজার দিন মানুষ সেহেরী-ইসতারিত (ইফতারিতে) ভালা-মন্দ খায়। আর আমরা হাগ-পাতা (শাকপাতা) খাইয়্যা কোন রহমে রোজা রাখতাছি। ইসতারির সময় লবণ-পানির যে শরবত খাইয়াম, হেই ব্যবস্থাও নাই। পোলাপানরে লইয়া আরো বেশি বিপদঅ পড়ছি। হেরারে ভাত কম দিলে কান্দে। হেরার কান্দন দেইখ্যা বুকটা ফাইট্যা যায়।’
ইন্নাচুল্লী গ্রামেরই এরশাদ মিয়া দেড় একর জমি করেছিলেন। সর্বস্ব হারিয়ে দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার চার জনের সংসারে এখন কেবলই অভাব। দিশাহারা এরশাদ বাড়িতে পরিবার রেখে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে হাঁসের রাখালের কাজ নিয়েছেন। স্ত্রী জাইরন বেগম জানালেন, সুখের আশায় ধারদেনা করে জমি চাষ করে এখন তারা পড়েছেন অকূলপাথারে। ঘরে চাল নেই। কোন সাহায্য-সহযোগিতাও তারা পাননি। এমন দুরবস্থায় বাড়ির পুরুষ মানুষ ঘরে বসে থাকে কি করে! বাধ্য হয়ে ঘর ছেলে হাঁসের রাখালের কাজ নিয়ে তার স্বামী এরশাদ। এরশাদের মতোই কাজের খোঁজে ঘর ছেড়েছেন একই গ্রামের কাজল মিয়া। স্ত্রী বিলকিস আক্তার জানান, ৬০ হাজার টাকা ঋণ করে তার স্বামী কাজল ২ একর জমিতে বোরো ধান করেছিলেন। কিন্তু পানিতে সব তলিয়ে গেছে। এক মেয়ে ও তিন ছেলে নিয়ে ৬ জনের সংসারের এখন নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। ঘরে কোন খাবার নেই। সকালে কিছু মিললে তো দুপুরে মিলে না। দুপুরে মিলে তো রাতে মিলেনা। বিলকিস বললেন, ‘আমরার অহন উপাস থাহন অহন নিয়ম অইয়্যা গেছে গা। পোলাপাইনের মুহও দানা-পানি কিছতা দিতাম পারি না। হের লাগি হেরাও অহন রোজা রাহে। মাইজে মাইজে একবার খাইয়্যাও রোজা রাকতাছি। হেই কষ্ট কেউরে কইয়্যাও কুনু লাভ নাই। কষ্টত পড়ছি অহন কষ্ট ত করনই লাগব।’
নিকলী উপজেলার ডুবি গ্রামের সচ্ছল কৃষক কামাল উদ্দিন (৫০)। ১৩ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন তিনি। জমিতে পানি সেচের জন্য চল্লিশ হাজার দু’টি শ্যালোমেশিনও কিনেছিলেন তিনি। হাতে টাকা না থাকায় চাষাবাদের খরচ মেটাতে চার লাখ টাকা ঋণ করেন তিনি। ফসল কাটতে পারলে কৃষক কামাল উদ্দিনের গোলায় ওঠতো হাজার মণ ধান। কিন্তু পানিতে ফসল তলিয়ে যাওয়ায় গোলায় তুলতে পারেননি এক ছটাকও ধান। কামাল উদ্দিনের ছয় সন্তানের মধ্যে সবার বড় ছেলে আলী নূর মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছেন। দ্বিতীয় ছেলে দেলোয়ার অনার্সে ভর্তি হয়েছেন। মেয়ে সাদিয়া আলীম পরীক্ষা দিয়েছেন। চতুর্থ সন্তান সাহিদা দাখিল পরীক্ষার্থী। পঞ্চম সুফিয়া চতুর্থ এবং সবার ছোট ছেলে হাফিজিয়া পড়ছে। মহাজনের ঋণ, সন্তানদের লেখাপড়া আর ১০ সদস্যের বিশাল পরিবারের সংসার খরচ নিয়ে কামাল উদ্দিন চোখে অন্ধকার দেখছেন। এরকম দুরবস্থায় সপরিবারে বাড়ি ছেড়েছেন দিশেহারা এই কৃষক।
নিকলী উপজেলারই নানশ্রী বাঘখালী গ্রামের প্রান্তিক চাষী এরশাদ আলী (৩৫)। গত বোরো মৌসুমে সাড়ে তিন একর জমি আবাদ করেছিলেন। এর বাইরে ২০০ হাঁসের একটি খামারও ছিল তার। কিন্তু আগাম বন্যার পানিতে ধানের সাথে হাঁসও গেছে তার। ২০০ হাঁসের মধ্যে ১৫০ হাঁসই মারা যায়। ধান এবং হাঁস হারিয়ে এরশাদ আলী একেবারেই সর্বস্বান্ত। এখন টেনেটুনে চলছে তার পাঁচ জনের সংসার।
ইটনা উপজেলা সদরের বড়হাটি গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন কৃষক হাজী মোক্তার হোসেন। ৪০ একর জমি করেছিলেন হালালের হাওরে। ধান কাটতে পারলে কয়েক হাজার মণ ধান ওঠতো তাঁর গোলায়। কিন্তু নজিরবিহীন আগাম বন্যায় তছনছ তার সুখের দিন। চৈত্রের আগাম বন্যার শুরুতেই তলিয়ে যায় হালালের হাওর। গোয়ালে থাকা দুইটি গরু বিক্রি করে মৌসুমের চুক্তিভিত্তিক দুই শ্রমিককে পাওনা মেটাতে হয়েছে তাকে। ইটনা পুরানহাটি গ্রামের দীন ইসলামের দেড় একর জমি ছাড়াও ১৫ হাজার পোনা মাছের পুকুর তলিয়ে গেছে সর্বনাশা আগাম বানের পানিতে। সর্বহারা এই কৃষকের কষ্ট দেখারও
কেউ নেই। ইটনা পশ্চিমগ্রাম দাসপাড়ার বিধবা কৃষাণী নমিতা রাণী দাস (৩৫) এর অবস্থা আরো শোচনীয়। ধারকর্জ করে করা এক একর জমির পুরোটাই হারিয়ে পথে বসেছেন এই নারী। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া একমাত্র ছেলে গৌতম চন্দ্র দাসকে নিয়ে মাছ ধরার যন্ত্র ‘চাঁই’ তৈরির কাজ করে এখন কোনরকমে পেট চালাচ্ছেন তিনি। এরপরও সর্বংসহা এই নারী পাননি কোন ত্রাণ সহায়তা।
ফসল হারিয়ে এমন নিঃস্ব অবস্থা, এ রকম কষ্ট কিশোরগঞ্জের হাওরের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই। হাওরের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে এখন এমন বেদনার্ত ছবিই এখন দেখা যায়। গভীর হাওরের তিন উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম ছাড়াও নিকলী ও করিমগঞ্জের হাওর জনপদে এখন জেঁকে বসেছে দারিদ্রতা। সেখানে এখন কেবলই অভাবী মানুষের মুখচ্ছবি। হাওরপাড়ের গ্রামগুলোতে কোন ট্রলার ভিড়লে ত্রাণের আশায় ছুটে আসেন আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, হাওর অধ্যুষিত ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলা মূলত একফসলী এলাকা। এখানকার একমাত্র ফসল বোরো ধান। এখানকার উৎপাদিত ধানের উপর নির্ভরশীল হয়ে হাওরপাড়ের কৃষককে পরবর্তী বোরো ধান না ওঠা পর্যন্ত জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকেরা মূলত ধার দেনা ও মহাজনের কাছ থেকে সুদের ওপর ঋণ নিয়ে জমি চাষ করে থাকেন। ধান তোলার সাথে সাথেই তাদেরকে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হয়। এ বছর ফসলহানির কারণে কেবল ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকই নন, এ এলাকার বড় ও সামর্থ্যবান কৃষকও বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অনেকে মৌসুমের জন্য চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের বেতনই পরিশোধ করতে পারেন নি। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে অনেক কৃষক এখন মহাজনের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রকট দারিদ্রের মধ্য দিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করলেও জীবনধারণের জন্য তাদের কোন কাজ মিলছে না। আগাম বন্যায় বিপর্যয়ে পড়েছে তাদের জীবন-জীবিকা। দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত জীবন থেকে পরিবারকে রেহাই দিতে বাধ্য হয়ে হাওরের মানুষ দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছেন। কাজের খোঁজে ঢাকা শহরের নূরের চালা, কচুক্ষেত, ধামালকোট, ইব্রাহীমপুর, কাফরুল, মীরপুর, গাজীপুরের সালনা, বোর্ডবাজার, কোনাবাড়ী, নারায়নগঞ্জের ফতুল্লা, পাগলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, আশুগঞ্জ, সিলেটের ভোলাগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের নানা প্রান্তে তারা পাড়ি জমাচ্ছেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

হাগ-পাতা খাইয়্যা রোজা রাখতাছি

আপডেট টাইম : ১২:০৩:২৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ জুলাই ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ করিমগঞ্জ উপজেলার ইন্দাচুল্লী গ্রামের ফরিদ মিয়ার নিজের কোন জমি নেই। গত বোরো মৌসুমে তিলে তিলে জমানো সঞ্চয় ভেঙে পাঁচ একর জমি বন্দক রেখেছিলেন তিনি। পাশের কাশিপুর গ্রামে অস্থায়ী বসতি গড়ে সেই জমিতে করেছিলেন বোরো চাষ। তার বড় মেয়ে অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া মবিনূর মেরুদণ্ডের হাড় বাঁকা রোগে ভুগছে। মেয়ের চিকিৎসার জন্য মহাজনের কাছ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণও করতে হয়েছে তাকে। স্বপ্ন ছিল, জমির ধান কেটে ঋণ পরিশোধ করার পর সংসারের খরচ চালানোর পাশাপাশি অসুস্থ অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে মবিনুরের আরো উন্নত চিকিৎসা করাবেন। কিন্তু বিধিবাম! চৈত্রের আগাম বন্যায় তার সবটুকু জমি তলিয়ে গেছে। ঋণের চাপে ঘরে থাকা একমাত্র দুধেল গাভিটিও বিক্রি করতে হয়েছে তাকে। কাশিপুরের বসতবাড়িটি ইন্দাচুল্লী গ্রামে আনার জন্যও তার অনেক টাকা খরচ হয়েছে। কাশিপুর থেকে খালি হাতে ইন্দাচুল্লী গ্রামে ফিরলেও মহাজনের বিশাল ঋণের চাপ আর স্ত্রী, তিন মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে সাতজনের সংসার খরচ নিয়ে পড়েন মহাসংকটে। কোন উপায় না পেয়ে মেয়ে মবিনূরকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়ে ফরিদ মিয়া নিজেও কাজের খোঁজে ঘর ছেড়েছেন। স্ত্রী মরিয়ম জানালেন, এক সপ্তাহ আগে তার স্বামী বাড়ি ছাড়লেও এখনো কোন টাকা-পয়সা পাঠাতে পারেননি। এ পরিস্থিতিতে খেয়ে-না খেয়ে দিন কাটছে তাদের। মেয়ের অসুস্থতা বাড়লেও চিকিৎসা থেমে আছে। মরিয়ম বললেন, ‘রোজার দিন মানুষ সেহেরী-ইসতারিত (ইফতারিতে) ভালা-মন্দ খায়। আর আমরা হাগ-পাতা (শাকপাতা) খাইয়্যা কোন রহমে রোজা রাখতাছি। ইসতারির সময় লবণ-পানির যে শরবত খাইয়াম, হেই ব্যবস্থাও নাই। পোলাপানরে লইয়া আরো বেশি বিপদঅ পড়ছি। হেরারে ভাত কম দিলে কান্দে। হেরার কান্দন দেইখ্যা বুকটা ফাইট্যা যায়।’
ইন্নাচুল্লী গ্রামেরই এরশাদ মিয়া দেড় একর জমি করেছিলেন। সর্বস্ব হারিয়ে দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার চার জনের সংসারে এখন কেবলই অভাব। দিশাহারা এরশাদ বাড়িতে পরিবার রেখে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে হাঁসের রাখালের কাজ নিয়েছেন। স্ত্রী জাইরন বেগম জানালেন, সুখের আশায় ধারদেনা করে জমি চাষ করে এখন তারা পড়েছেন অকূলপাথারে। ঘরে চাল নেই। কোন সাহায্য-সহযোগিতাও তারা পাননি। এমন দুরবস্থায় বাড়ির পুরুষ মানুষ ঘরে বসে থাকে কি করে! বাধ্য হয়ে ঘর ছেলে হাঁসের রাখালের কাজ নিয়ে তার স্বামী এরশাদ। এরশাদের মতোই কাজের খোঁজে ঘর ছেড়েছেন একই গ্রামের কাজল মিয়া। স্ত্রী বিলকিস আক্তার জানান, ৬০ হাজার টাকা ঋণ করে তার স্বামী কাজল ২ একর জমিতে বোরো ধান করেছিলেন। কিন্তু পানিতে সব তলিয়ে গেছে। এক মেয়ে ও তিন ছেলে নিয়ে ৬ জনের সংসারের এখন নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। ঘরে কোন খাবার নেই। সকালে কিছু মিললে তো দুপুরে মিলে না। দুপুরে মিলে তো রাতে মিলেনা। বিলকিস বললেন, ‘আমরার অহন উপাস থাহন অহন নিয়ম অইয়্যা গেছে গা। পোলাপাইনের মুহও দানা-পানি কিছতা দিতাম পারি না। হের লাগি হেরাও অহন রোজা রাহে। মাইজে মাইজে একবার খাইয়্যাও রোজা রাকতাছি। হেই কষ্ট কেউরে কইয়্যাও কুনু লাভ নাই। কষ্টত পড়ছি অহন কষ্ট ত করনই লাগব।’
নিকলী উপজেলার ডুবি গ্রামের সচ্ছল কৃষক কামাল উদ্দিন (৫০)। ১৩ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন তিনি। জমিতে পানি সেচের জন্য চল্লিশ হাজার দু’টি শ্যালোমেশিনও কিনেছিলেন তিনি। হাতে টাকা না থাকায় চাষাবাদের খরচ মেটাতে চার লাখ টাকা ঋণ করেন তিনি। ফসল কাটতে পারলে কৃষক কামাল উদ্দিনের গোলায় ওঠতো হাজার মণ ধান। কিন্তু পানিতে ফসল তলিয়ে যাওয়ায় গোলায় তুলতে পারেননি এক ছটাকও ধান। কামাল উদ্দিনের ছয় সন্তানের মধ্যে সবার বড় ছেলে আলী নূর মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছেন। দ্বিতীয় ছেলে দেলোয়ার অনার্সে ভর্তি হয়েছেন। মেয়ে সাদিয়া আলীম পরীক্ষা দিয়েছেন। চতুর্থ সন্তান সাহিদা দাখিল পরীক্ষার্থী। পঞ্চম সুফিয়া চতুর্থ এবং সবার ছোট ছেলে হাফিজিয়া পড়ছে। মহাজনের ঋণ, সন্তানদের লেখাপড়া আর ১০ সদস্যের বিশাল পরিবারের সংসার খরচ নিয়ে কামাল উদ্দিন চোখে অন্ধকার দেখছেন। এরকম দুরবস্থায় সপরিবারে বাড়ি ছেড়েছেন দিশেহারা এই কৃষক।
নিকলী উপজেলারই নানশ্রী বাঘখালী গ্রামের প্রান্তিক চাষী এরশাদ আলী (৩৫)। গত বোরো মৌসুমে সাড়ে তিন একর জমি আবাদ করেছিলেন। এর বাইরে ২০০ হাঁসের একটি খামারও ছিল তার। কিন্তু আগাম বন্যার পানিতে ধানের সাথে হাঁসও গেছে তার। ২০০ হাঁসের মধ্যে ১৫০ হাঁসই মারা যায়। ধান এবং হাঁস হারিয়ে এরশাদ আলী একেবারেই সর্বস্বান্ত। এখন টেনেটুনে চলছে তার পাঁচ জনের সংসার।
ইটনা উপজেলা সদরের বড়হাটি গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন কৃষক হাজী মোক্তার হোসেন। ৪০ একর জমি করেছিলেন হালালের হাওরে। ধান কাটতে পারলে কয়েক হাজার মণ ধান ওঠতো তাঁর গোলায়। কিন্তু নজিরবিহীন আগাম বন্যায় তছনছ তার সুখের দিন। চৈত্রের আগাম বন্যার শুরুতেই তলিয়ে যায় হালালের হাওর। গোয়ালে থাকা দুইটি গরু বিক্রি করে মৌসুমের চুক্তিভিত্তিক দুই শ্রমিককে পাওনা মেটাতে হয়েছে তাকে। ইটনা পুরানহাটি গ্রামের দীন ইসলামের দেড় একর জমি ছাড়াও ১৫ হাজার পোনা মাছের পুকুর তলিয়ে গেছে সর্বনাশা আগাম বানের পানিতে। সর্বহারা এই কৃষকের কষ্ট দেখারও
কেউ নেই। ইটনা পশ্চিমগ্রাম দাসপাড়ার বিধবা কৃষাণী নমিতা রাণী দাস (৩৫) এর অবস্থা আরো শোচনীয়। ধারকর্জ করে করা এক একর জমির পুরোটাই হারিয়ে পথে বসেছেন এই নারী। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া একমাত্র ছেলে গৌতম চন্দ্র দাসকে নিয়ে মাছ ধরার যন্ত্র ‘চাঁই’ তৈরির কাজ করে এখন কোনরকমে পেট চালাচ্ছেন তিনি। এরপরও সর্বংসহা এই নারী পাননি কোন ত্রাণ সহায়তা।
ফসল হারিয়ে এমন নিঃস্ব অবস্থা, এ রকম কষ্ট কিশোরগঞ্জের হাওরের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই। হাওরের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে এখন এমন বেদনার্ত ছবিই এখন দেখা যায়। গভীর হাওরের তিন উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম ছাড়াও নিকলী ও করিমগঞ্জের হাওর জনপদে এখন জেঁকে বসেছে দারিদ্রতা। সেখানে এখন কেবলই অভাবী মানুষের মুখচ্ছবি। হাওরপাড়ের গ্রামগুলোতে কোন ট্রলার ভিড়লে ত্রাণের আশায় ছুটে আসেন আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, হাওর অধ্যুষিত ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলা মূলত একফসলী এলাকা। এখানকার একমাত্র ফসল বোরো ধান। এখানকার উৎপাদিত ধানের উপর নির্ভরশীল হয়ে হাওরপাড়ের কৃষককে পরবর্তী বোরো ধান না ওঠা পর্যন্ত জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকেরা মূলত ধার দেনা ও মহাজনের কাছ থেকে সুদের ওপর ঋণ নিয়ে জমি চাষ করে থাকেন। ধান তোলার সাথে সাথেই তাদেরকে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হয়। এ বছর ফসলহানির কারণে কেবল ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকই নন, এ এলাকার বড় ও সামর্থ্যবান কৃষকও বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অনেকে মৌসুমের জন্য চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের বেতনই পরিশোধ করতে পারেন নি। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে অনেক কৃষক এখন মহাজনের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রকট দারিদ্রের মধ্য দিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করলেও জীবনধারণের জন্য তাদের কোন কাজ মিলছে না। আগাম বন্যায় বিপর্যয়ে পড়েছে তাদের জীবন-জীবিকা। দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত জীবন থেকে পরিবারকে রেহাই দিতে বাধ্য হয়ে হাওরের মানুষ দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছেন। কাজের খোঁজে ঢাকা শহরের নূরের চালা, কচুক্ষেত, ধামালকোট, ইব্রাহীমপুর, কাফরুল, মীরপুর, গাজীপুরের সালনা, বোর্ডবাজার, কোনাবাড়ী, নারায়নগঞ্জের ফতুল্লা, পাগলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, আশুগঞ্জ, সিলেটের ভোলাগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের নানা প্রান্তে তারা পাড়ি জমাচ্ছেন।