ঢাকা ০৫:০৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫, ২৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

৩০ বছর পর লেবানন ছেড়েছিল সিরীয় সেনারা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:০৯:৩০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই ২০১৭
  • ৪০৩ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  ২০০৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিরীয় সেনাবাহিনীর শেষ সৈন্য লেবানন ত্যাগ করেছিল। জাতিসংঘের চূড়ান্ত সময়সীমা শেষ হবার চারদিন আগে লেবাননে প্রায় ৩০ বছর ধরে সিরীয় বাহিনীর উপস্থিতির আনুষ্ঠানিক ইতি ঘটে। লেবাননের মানুষের মধ্যে ছিল মিশ্র অনুভুতি।

‘সিরীয় দখলদার বাহিনী- বাশার আল আসাদের সেনারা লেবানন ছেড়ে যাচ্ছে – এই মুহূর্তটার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। লেবাননের মানুষ তাদের এখানে চায় না। আমার মনের ইচ্ছে -তাদের যদি শাস্তি দিতে পারতাম!’

লেবাননের একজন নাগরিকের এমন মন্তব্য করলেও আরেকজনের মন্তব্য ছিল কিছুটা আলাদা।

‘সিরীয় সেনারা এভাবে লেবানন ছেড়ে যাক- তা আমরা চাইনি- বিশেষ করে যেভাবে তারা যাচ্ছে! এটা খুবই খারাপ। তাদের উচিত ছিল গৃহযুদ্ধের পর লেবাননকে আবার স্থিতিশীল হতে সাহায্য করা, লেবাননে একটা সেনাবাহিনী আবার গড়ে তুলতে সহায়তা করা।’

সিরীয় সেনা লেবাননে প্রথম পা রাখে ১৯৭৬ সালে। লেবাননে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার এক বছর পরে। সিরীয়দের দাবি ছিল লেবাননের তিক্ত সংঘাত থেকে খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্য তারা সেখানে ঢুকেছে। ওই সংঘাত দেশকে জাতি ও ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করে ফেলেছিল।

বৈরুৎ-এর ৩০ মাইল দূরে লেবাননের উত্তরাঞ্চলে চার হাজার সৈন্য এবং ২০০ ট্যাংক তখন মোতায়েন করা হয়েছে। উর্বর বেকা উপত্যকার অধিকাংশই তখন সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণে। এরপরে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল অন্যান্য আরব দেশ থেকে যাওয়া সেনারা। গঠন করা হয়েছিল আরব প্রতিরোধ বাহিনী নামে একটি সেনাদল।

সেসময় পশ্চিমা গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছিল – সিরীয় ট্যাংক সেখানে ঢুকেছে বিজয় নিশান উড়িয়ে। কিন্তু এখন যেটা দেখার সেটা হল আলজেরিয়া, লিবিয়া, সুদান, সৌদি আরব এবং ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থার সৈন্যদের সহায়তা নিয়েও সিরীয় সেনারা বৈরুতের গেরিলা পথযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয় কীনা।

সিরীয় সৈন্যদের উপস্থিতি সত্ত্বেও লেবাননে এরপর আরও ১৪ বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলে এবং সিরীয় সেনারা সেখানে থেকে যায় আরও এক বছর।

বিবিসির ইতিহাসের সাক্ষী অনুষ্ঠানে লেবাননের দুই নাগরিক সেদেশে সিরীয় সৈন্যের উপস্থিতি ও ভূমিকা নিয়ে খুব ভিন্ন ধরনের মতামত দেন।

টনি আবি নাজেম সিরিয়া বিরোধী একজন আন্দোলনকারী। সিরীয় সৈন্যদের লেবাননের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের স্মৃতি তার ছেলেবেলার। তিনি বলেন ১৯৭৮ সালে আল আশরাফিয়া এলাকায় ১০০ দিনের যুদ্ধ যখন চলছিল, তখন তিনি খুবই ছোট।

‘১০০ দিন ধরে আমাদের বর্বরোচিত বোমা হামলার যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। এমন দৃশ্য আমি দেখেছি যা কখনও ভুলব না। আমরা যখন শেল্টারে থাকতাম, তখন অল্পবয়সী কেউ মারা গেলেই আমরা কাঁদতাম। সন্তান হারানো মায়েরা শোকে বিলাপ করতেন। সেই বোমা হামলার দিনগুলো আমি কখনও ভুলতে পারব না।’

টনি আবি নাজেম বড় হয়ে উঠেছিলেন একজন সিরিয়া বিরোধী হিসেবে। সিরীয় সৈন্যরা বেশ কয়েকবার তাকে আটক করেছিল এবং বৈরুতের বো-রিভাজ হোটেলে নিয়ে গিয়ে তাকে জেরা করেছিল- তার ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল। লেবাননে সিরীয় গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোর মূল কেন্দ্র ছিল ওই হোটেল।

‘একবার ওরা আমাকে দুই দিন ধরে পিটিয়েছিল। পালা করে আমার ওপর অত্যাচার করেছিল। ওদের একজন আমাকে চরমভাবে অপমান করেছিলেন- আমার ধারণা ওই সিরীয় কর্মকর্তা ছিলেন ওদের প্রধান।’

নাজেম বলেন, লেবাননের রাজনৈতিক পার্টি লেবানিজ ফোর্সের সেসময়কার নেতা সামির জাজাকেও সৈন্যরা নির্যাতন করেছিল, যিনি কারাগারে ছিলেন।ম্যারোনাইট খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নেতা নাসরাল্লা বুত্রোস সেফিয়ারের ওপরও অত্যাচার চালানো হয়েছিল বলে তিনি জানান।

‘ওই সেনা কর্মকর্তা আমাকে কষে এক চড় দেন এবং বলেন এবার প্রাণে বেঁচে গেছ- তোমাকে প্রাণে মারিনি। কিন্তু মনে রেখ যে কোনো সময় চাইলেই আমরা তোমাকে মেরে ফেলতে পারি। ওই নির্যাতনের সবচেয়ে বড় যে প্রভাব আমার ওপর পড়েছিল সেটা হলো- আমাকে, জাজা এবং যাজক সাফায়েরকে ওরা অপমান করেছে- লাঞ্ছিত করেছে।’

সামির জাজা এবং যাজক সেফিয়ার ছিলেন লেবাননে সিরীয় উপস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। নির্যাতন ও অপমানের পর টনি আবি নাজেমকে প্রায় তিন ঘন্টা ধরে পেটানো হয়। এরপর তার বাসার কাছে একটা রাস্তায় তাকে গাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয় বলে তিনি বিবিসিকে বলেন।

‘সেই সময় আমার মনের মধ্যে দুটো পরস্পরবিরোধী অনুভূতি কাজ করত। আমি মাথা নোয়াচ্ছি না ভেবে আমার গর্ব হত। অন্যদিকে দখলদারদের কাছে অপমানিত বোধ করতাম। ইউনিফর্ম পরা সিরীয় সেনা দেখলে ঘৃণা হত।’

কিন্তু লেবাননের অন্য জনগোষ্ঠিকে সিরীয়রা স্থিতিশীলতা আর বন্ধুত্বের আশ্বাস দিত। ব্রিগেডিয়ার এলিয়াস ফারহাত ছিলেন লেবানন সেনা বাহিনীর পরিচিতি ও জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক। তিনি বলছেন সিরীয় বাহিনীকে তিনি দখলদার বাহিনী হিসাবে ব্যাখ্যা করতে রাজি নন।

‘তারা যখন ফিলিস্তিনি এবং লেবানিজ ন্যাশানাল মুভমেন্টের হাত থেকে খ্রিস্টানদের রক্ষা করছিল, খ্রিস্টানদের বাঁচাতে দুটি বড় গ্রামে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালাচ্ছিল- তখন তাদের দখলদার বলি কী করে? তারা যখন ত্রিপলিতে ঢুকে মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর আক্রমণ চালাল এবং লেবানন থেকে আরাফাতকে উৎখাত করল, তখন তো তারা দখলদার ছিল না।’

সিরীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে বহু বছর ধরে একসঙ্গে কাজ করেছিলেন ব্রিগেডিয়ার ফারাহাত। সিরীয় বাহিনীতে সমান পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। দামেস্কে তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল।

১৯৯০-এ গৃহযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরেও সিরীয় সৈন্যরা লেবাননে থেকে গিয়েছিল।

১৯৯১ সালে সিরিয়া আর লেবাননের মধ্যে একটা মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যার আওতায় প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ক যৌথ সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এরপর ২০০৪ সালে লেবানন থেকে অ-লেবানি সব সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু এরপরেও সিরীয় সৈন্যরা থেকে যায়।

২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে লেবাননের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী ও দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি আততায়ীর বিশাল এক বোমা হামলায় নিহত হন।

ওই হামলার জন্য সিরিয়াকে দোষারোপ করা হয় এবং তার হত্যার পর লেবাননে সিরিয়ার উপস্থিতির প্রতিবাদে পরপর বড়ধরনের বিক্ষোভ হয়।

এরপর ৫ মার্চ বাশার আল আসাদ সিরিয়ার সংসদে লেবানন থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে বলেন,

‘আমরা লেবাননের আল বেকা এলাকা থেকে আমাদের সেনা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নেব। সেনা থাকবে শুধু সিরিয়া লেবানন সীমান্তে।’

১৪ মার্চ প্রায় ৮ লাখ সিরিয়া বিরোধী বিক্ষোভকারী বৈরুতের মার্টার স্কোয়ারে জমায়েত হয়। লেবাননের ইতিহাসে সেটা ছিল স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমাবেশ।দেশটির সব দলের সব অঙ্গ সংগঠন সেখানে একত্রিত হয়ে সিরীয় বাহিনীর লেবানন ত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে।

তারা বিক্ষোভ করে লেবাননের স্বাধীনতার দাবিতে। সিরীয় সেনা বাহিনী প্রত্যাহার, হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনসহ সব মিলিশিয়া বাহিনী ভেঙে দেয়া এবং রফিক হারিরির হত্যার ন্যায় বিচারের দাবিতে বিশাল বিক্ষোভ হয় মার্টার স্কোয়ারে। এর ছয় সপ্তাহ পর ২০০৫ সালের ২৬ এপ্রিল শেষ সিরীয় সৈন্য লেবানন ছেড়ে যায়।

সৈন্যরা সিরিয়া সীমান্ত অভিমুখে এগোনর আগে বেকা উপত্যকার রায়াক বিমানঘাঁটিতে তাদের বিদায় জানাতে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, তার উদ্দেশ্য ছিল দুই বাহিনীর মধ্যে একটা সুসম্পর্ক আছে তা দেখানো। দেখানো যে সিরীয় বাহিনীর একটা প্রধান লক্ষ্য লেবানন সেনা বাহিনীর পুর্নগঠনে সহায়তা করা।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিরীয় সৈন্যরা যখন লেবানন পুরোপুরি ছেড়ে যায় তখন তারা কিন্তু লেবাননের মানুষের উদ্দেশ্যে সহযোগিতার কোন আশ্বাস রেখে যায়নি বরং বিদায় অনুষ্ঠানে তারা শুধু তাদের যেসব সহযোদ্ধা লেবাননে প্রাণ হারিয়েছিল তাদের উদ্দেশ্যে শেষ বাণী উচ্চারণ করেছিল- আমরা তোমাদের ভুলব না।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

৩০ বছর পর লেবানন ছেড়েছিল সিরীয় সেনারা

আপডেট টাইম : ০৯:০৯:৩০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  ২০০৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিরীয় সেনাবাহিনীর শেষ সৈন্য লেবানন ত্যাগ করেছিল। জাতিসংঘের চূড়ান্ত সময়সীমা শেষ হবার চারদিন আগে লেবাননে প্রায় ৩০ বছর ধরে সিরীয় বাহিনীর উপস্থিতির আনুষ্ঠানিক ইতি ঘটে। লেবাননের মানুষের মধ্যে ছিল মিশ্র অনুভুতি।

‘সিরীয় দখলদার বাহিনী- বাশার আল আসাদের সেনারা লেবানন ছেড়ে যাচ্ছে – এই মুহূর্তটার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। লেবাননের মানুষ তাদের এখানে চায় না। আমার মনের ইচ্ছে -তাদের যদি শাস্তি দিতে পারতাম!’

লেবাননের একজন নাগরিকের এমন মন্তব্য করলেও আরেকজনের মন্তব্য ছিল কিছুটা আলাদা।

‘সিরীয় সেনারা এভাবে লেবানন ছেড়ে যাক- তা আমরা চাইনি- বিশেষ করে যেভাবে তারা যাচ্ছে! এটা খুবই খারাপ। তাদের উচিত ছিল গৃহযুদ্ধের পর লেবাননকে আবার স্থিতিশীল হতে সাহায্য করা, লেবাননে একটা সেনাবাহিনী আবার গড়ে তুলতে সহায়তা করা।’

সিরীয় সেনা লেবাননে প্রথম পা রাখে ১৯৭৬ সালে। লেবাননে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার এক বছর পরে। সিরীয়দের দাবি ছিল লেবাননের তিক্ত সংঘাত থেকে খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্য তারা সেখানে ঢুকেছে। ওই সংঘাত দেশকে জাতি ও ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করে ফেলেছিল।

বৈরুৎ-এর ৩০ মাইল দূরে লেবাননের উত্তরাঞ্চলে চার হাজার সৈন্য এবং ২০০ ট্যাংক তখন মোতায়েন করা হয়েছে। উর্বর বেকা উপত্যকার অধিকাংশই তখন সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণে। এরপরে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল অন্যান্য আরব দেশ থেকে যাওয়া সেনারা। গঠন করা হয়েছিল আরব প্রতিরোধ বাহিনী নামে একটি সেনাদল।

সেসময় পশ্চিমা গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছিল – সিরীয় ট্যাংক সেখানে ঢুকেছে বিজয় নিশান উড়িয়ে। কিন্তু এখন যেটা দেখার সেটা হল আলজেরিয়া, লিবিয়া, সুদান, সৌদি আরব এবং ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থার সৈন্যদের সহায়তা নিয়েও সিরীয় সেনারা বৈরুতের গেরিলা পথযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয় কীনা।

সিরীয় সৈন্যদের উপস্থিতি সত্ত্বেও লেবাননে এরপর আরও ১৪ বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলে এবং সিরীয় সেনারা সেখানে থেকে যায় আরও এক বছর।

বিবিসির ইতিহাসের সাক্ষী অনুষ্ঠানে লেবাননের দুই নাগরিক সেদেশে সিরীয় সৈন্যের উপস্থিতি ও ভূমিকা নিয়ে খুব ভিন্ন ধরনের মতামত দেন।

টনি আবি নাজেম সিরিয়া বিরোধী একজন আন্দোলনকারী। সিরীয় সৈন্যদের লেবাননের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের স্মৃতি তার ছেলেবেলার। তিনি বলেন ১৯৭৮ সালে আল আশরাফিয়া এলাকায় ১০০ দিনের যুদ্ধ যখন চলছিল, তখন তিনি খুবই ছোট।

‘১০০ দিন ধরে আমাদের বর্বরোচিত বোমা হামলার যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। এমন দৃশ্য আমি দেখেছি যা কখনও ভুলব না। আমরা যখন শেল্টারে থাকতাম, তখন অল্পবয়সী কেউ মারা গেলেই আমরা কাঁদতাম। সন্তান হারানো মায়েরা শোকে বিলাপ করতেন। সেই বোমা হামলার দিনগুলো আমি কখনও ভুলতে পারব না।’

টনি আবি নাজেম বড় হয়ে উঠেছিলেন একজন সিরিয়া বিরোধী হিসেবে। সিরীয় সৈন্যরা বেশ কয়েকবার তাকে আটক করেছিল এবং বৈরুতের বো-রিভাজ হোটেলে নিয়ে গিয়ে তাকে জেরা করেছিল- তার ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল। লেবাননে সিরীয় গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোর মূল কেন্দ্র ছিল ওই হোটেল।

‘একবার ওরা আমাকে দুই দিন ধরে পিটিয়েছিল। পালা করে আমার ওপর অত্যাচার করেছিল। ওদের একজন আমাকে চরমভাবে অপমান করেছিলেন- আমার ধারণা ওই সিরীয় কর্মকর্তা ছিলেন ওদের প্রধান।’

নাজেম বলেন, লেবাননের রাজনৈতিক পার্টি লেবানিজ ফোর্সের সেসময়কার নেতা সামির জাজাকেও সৈন্যরা নির্যাতন করেছিল, যিনি কারাগারে ছিলেন।ম্যারোনাইট খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নেতা নাসরাল্লা বুত্রোস সেফিয়ারের ওপরও অত্যাচার চালানো হয়েছিল বলে তিনি জানান।

‘ওই সেনা কর্মকর্তা আমাকে কষে এক চড় দেন এবং বলেন এবার প্রাণে বেঁচে গেছ- তোমাকে প্রাণে মারিনি। কিন্তু মনে রেখ যে কোনো সময় চাইলেই আমরা তোমাকে মেরে ফেলতে পারি। ওই নির্যাতনের সবচেয়ে বড় যে প্রভাব আমার ওপর পড়েছিল সেটা হলো- আমাকে, জাজা এবং যাজক সাফায়েরকে ওরা অপমান করেছে- লাঞ্ছিত করেছে।’

সামির জাজা এবং যাজক সেফিয়ার ছিলেন লেবাননে সিরীয় উপস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। নির্যাতন ও অপমানের পর টনি আবি নাজেমকে প্রায় তিন ঘন্টা ধরে পেটানো হয়। এরপর তার বাসার কাছে একটা রাস্তায় তাকে গাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয় বলে তিনি বিবিসিকে বলেন।

‘সেই সময় আমার মনের মধ্যে দুটো পরস্পরবিরোধী অনুভূতি কাজ করত। আমি মাথা নোয়াচ্ছি না ভেবে আমার গর্ব হত। অন্যদিকে দখলদারদের কাছে অপমানিত বোধ করতাম। ইউনিফর্ম পরা সিরীয় সেনা দেখলে ঘৃণা হত।’

কিন্তু লেবাননের অন্য জনগোষ্ঠিকে সিরীয়রা স্থিতিশীলতা আর বন্ধুত্বের আশ্বাস দিত। ব্রিগেডিয়ার এলিয়াস ফারহাত ছিলেন লেবানন সেনা বাহিনীর পরিচিতি ও জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক। তিনি বলছেন সিরীয় বাহিনীকে তিনি দখলদার বাহিনী হিসাবে ব্যাখ্যা করতে রাজি নন।

‘তারা যখন ফিলিস্তিনি এবং লেবানিজ ন্যাশানাল মুভমেন্টের হাত থেকে খ্রিস্টানদের রক্ষা করছিল, খ্রিস্টানদের বাঁচাতে দুটি বড় গ্রামে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালাচ্ছিল- তখন তাদের দখলদার বলি কী করে? তারা যখন ত্রিপলিতে ঢুকে মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর আক্রমণ চালাল এবং লেবানন থেকে আরাফাতকে উৎখাত করল, তখন তো তারা দখলদার ছিল না।’

সিরীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে বহু বছর ধরে একসঙ্গে কাজ করেছিলেন ব্রিগেডিয়ার ফারাহাত। সিরীয় বাহিনীতে সমান পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। দামেস্কে তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল।

১৯৯০-এ গৃহযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরেও সিরীয় সৈন্যরা লেবাননে থেকে গিয়েছিল।

১৯৯১ সালে সিরিয়া আর লেবাননের মধ্যে একটা মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যার আওতায় প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ক যৌথ সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এরপর ২০০৪ সালে লেবানন থেকে অ-লেবানি সব সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু এরপরেও সিরীয় সৈন্যরা থেকে যায়।

২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে লেবাননের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী ও দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি আততায়ীর বিশাল এক বোমা হামলায় নিহত হন।

ওই হামলার জন্য সিরিয়াকে দোষারোপ করা হয় এবং তার হত্যার পর লেবাননে সিরিয়ার উপস্থিতির প্রতিবাদে পরপর বড়ধরনের বিক্ষোভ হয়।

এরপর ৫ মার্চ বাশার আল আসাদ সিরিয়ার সংসদে লেবানন থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে বলেন,

‘আমরা লেবাননের আল বেকা এলাকা থেকে আমাদের সেনা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নেব। সেনা থাকবে শুধু সিরিয়া লেবানন সীমান্তে।’

১৪ মার্চ প্রায় ৮ লাখ সিরিয়া বিরোধী বিক্ষোভকারী বৈরুতের মার্টার স্কোয়ারে জমায়েত হয়। লেবাননের ইতিহাসে সেটা ছিল স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমাবেশ।দেশটির সব দলের সব অঙ্গ সংগঠন সেখানে একত্রিত হয়ে সিরীয় বাহিনীর লেবানন ত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে।

তারা বিক্ষোভ করে লেবাননের স্বাধীনতার দাবিতে। সিরীয় সেনা বাহিনী প্রত্যাহার, হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনসহ সব মিলিশিয়া বাহিনী ভেঙে দেয়া এবং রফিক হারিরির হত্যার ন্যায় বিচারের দাবিতে বিশাল বিক্ষোভ হয় মার্টার স্কোয়ারে। এর ছয় সপ্তাহ পর ২০০৫ সালের ২৬ এপ্রিল শেষ সিরীয় সৈন্য লেবানন ছেড়ে যায়।

সৈন্যরা সিরিয়া সীমান্ত অভিমুখে এগোনর আগে বেকা উপত্যকার রায়াক বিমানঘাঁটিতে তাদের বিদায় জানাতে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, তার উদ্দেশ্য ছিল দুই বাহিনীর মধ্যে একটা সুসম্পর্ক আছে তা দেখানো। দেখানো যে সিরীয় বাহিনীর একটা প্রধান লক্ষ্য লেবানন সেনা বাহিনীর পুর্নগঠনে সহায়তা করা।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিরীয় সৈন্যরা যখন লেবানন পুরোপুরি ছেড়ে যায় তখন তারা কিন্তু লেবাননের মানুষের উদ্দেশ্যে সহযোগিতার কোন আশ্বাস রেখে যায়নি বরং বিদায় অনুষ্ঠানে তারা শুধু তাদের যেসব সহযোদ্ধা লেবাননে প্রাণ হারিয়েছিল তাদের উদ্দেশ্যে শেষ বাণী উচ্চারণ করেছিল- আমরা তোমাদের ভুলব না।