মুক্তির আনন্দে বিভোর ছিটমহলবাসী গতকাল শনিবার ভোরে ওড়াল লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা, গাইল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি…’। এরপর ভেজা চোখে তাদের বাঁধভাঙা উল্লাস। অনেকটা একই চিত্র দেখা গেছে ভারতেও। সেখানে বিলুপ্ত হওয়া বাংলাদেশি ছিটমহলগুলো গতকাল থেকে হয়ে গেছে ভারতের অংশ। নতুন ভোরে সেখানেও উঠেছে ভারতের জাতীয় পতাকা। এর আগে প্রথম প্রহরেই বাংলাদেশ ও ভারতের ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এরই মধ্য দিয়ে মূল ভূখণ্ডের অংশ হয়ে বিলুপ্ত হয় ছিটমহল। স্বাধীনতার ৪৪ বছর ধরে সীমানার ভেতরে ওই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের ওপর বাংলাদেশের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমঝোতা অনুযায়ী, ১ আগস্ট প্রথম প্রহর থেকে বাংলাদেশের ভেতর ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল (১৭ হাজার ১৬০ একর) বাংলাদেশের এবং ভারতের ভেতর ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল (সাত হাজার ১১০ একর) ভারতীয় ভূখণ্ডের অংশ হয়। ভারতীয় ছিটমহলগুলোর মধ্যে ১২টি ছিল কুড়িগ্রামে, ৫৯টি লালমনিরহাটে, চারটি নীলফামারীতে ও ৩৬টি পঞ্চগড়ে। অন্যদিকে ভারতের অংশ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশি ছিটমহলগুলো ছিল কোচবিহার জেলায়।
আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আবদুল খালেক ফারুক বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়া থেকে জানান, মুক্তির আনন্দে বিভোর ছিটমহলবাসীর উল্লাস থামছে না। মিছিল-সমাবেশ, হা-ডু-ডু, লাঠিখেলা, মিষ্টিমুখ করানো, আত্মীয়স্বজন মিলে পোলাও-মাংস খাওয়া- সব মিলে গতকাল এক উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছিল সদ্য বাংলাদেশের অংশ হওয়া দাশিয়ারছড়ায়।
শুক্রবার রাত ১২টা ১ মিনিটে ছিটের এক হাজার ৮০০ পরিবারের সবাই মোমবাতি জ্বালিয়ে তাড়িয়েছে জীবনের আঁধার। আর মশালের উজ্জ্বল আলোর সঙ্গে গগনবিদারী স্লোগান ও উল্লাস এক অভূতপূর্ব পরিবেশ সৃষ্টি করে। সারা রাত কেউ ঘুমায়নি। চলে পটকা ফোটানো আর হৈ-হুল্লোড়।
ভোর হতেই তারা জাতীয় সংগীতের সঙ্গে নতুন দেশের পতাকা উড়িয়ে মুক্তির প্রথম দিনটির সূচনা করে। ফুলবাড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন মাহমুদ জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
মুক্ত ছিটমহল দেখতে প্রতিটি বাড়িতে এসেছে স্বজনরা। মুক্তির প্রথম দিনেই সেখানে শুরু হয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা। ছিটমহল বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আসার পর গতকাল থেকে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনকারী বিভিন্ন সংস্থাও কাজ শুরু করেছে।
এ বাঁধনহারা আনন্দের সময় অনেকেরই মনে পড়েছে পুরনো দুঃসহ স্মৃতিগুলো। তাদেরই একজন দাশিয়ারছড়ার মনিরুজ্জামান। ছিটজীবনে তাঁর বাবা খুন হয়েছেন দুর্বৃত্তদের হাতে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন স্ত্রী। এমন করুণ অধ্যায় আর যাতে কারো জীবনে না আসে, সে জন্য ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে তিনি দুই বছর আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।
আমাদের পঞ্চগড় প্রতিনিধি সাইফুল আলম বাবু জানান, গতকাল সূর্যোদয়ের পর সকাল ৬টায় পঞ্চগড়ের বিভিন্ন ছিটমহলে সরকারি কর্মকর্তারা পতাকা উত্তোলনের আনুষ্ঠানিকতায় যোগ দেন। সদর উপজেলার হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের গারাতি ছিটমহলের ফোরকানিয়া মাদ্রাসা মাঠে এ পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. শামছুল আজম ও জেলা পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিন আহমদ জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় জেলা পুলিশের বাদক দলের বাদ্য-বাজনার সঙ্গে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হয়। পরে পুলিশের একটি দল জাতীয় পতাকাকে সালাম দিয়ে সম্মান জানায়। পতাকা উত্তোলনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকজন বিপুল করতালির সঙ্গে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে হর্ষধ্বনি দেয়।
ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. শামছুল আজম এলাকার লোকজনকে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এসব এলাকাতেও এখন ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব মৌলিক অধিকার প্রাপ্তির বিষয়টিও নিশ্চিত করা হবে।
শামছুল আজম আরো বলেন, জমির মালিকানা নির্ধারণ বিষয়ে এখনো সরকারি কোনো নির্দেশনা আসেনি। এ জন্য যে যেভাবে আছেন সেভাবেই স্থিতাবস্থা বজায় রাখবেন।
জেলা পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিন আহমদ জানান, অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প নিরাপত্তার সার্বিক বিষয়টি দেখবে। এর পরও কেউ জমি দখলসহ পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বোদা উপজেলার পুটিমারী ছিটমহলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু আউয়াল জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
আমাদের লালমনিরহাট প্রতিনিধি হায়দার আলী বাবু জানান, শুক্রবার রাত ১২টা ১ মিনিটে ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবনের মুক্তির প্রতীক হিসেবে ছিটমহলগুলোতে জ্বালানো হয় ৬৮টি করে মোমবাতি। কোথাও কোথাও এর সঙ্গে ছিল মশাল। উত্তর গোতামারীতে মোমবাতি জ্বালানোর পাশাপাশি সেখানকার ছকবর আলী নামের এক বয়োবৃদ্ধের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে বাংলাদেশি হিসেবে বরণ করে নেন হাতীবান্ধা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লিয়াকত হোসেন বাচ্চু ও কালীগঞ্জ কেইউপি ডিগ্রি কলেজের প্রধান শিক্ষক খুরশীদুজ্জামান আহমেদ।
সকাল ৬টায় সরকারিভাবে সেখানে প্রথমবারের মতো জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন হাতীবান্ধার ইউএনও মাহবুবুর রহমান ও ওসি আবদুল মতিন প্রধান। দুপুরে পাটগ্রামে উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে বের হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। এতে ছিল ৬৮ ফুট দীর্ঘ একটি জাতীয় পতাকা।
আমাদের নীলফামারী প্রতিনিধি ভুবন রায় নিখিল জানান, ডিমলা উপজেলার চার ছিটমহলে গতকাল সূর্যোদয়ের পরপরই জাতীয় পতাকা উত্তোলন শেষে সবার মুখে ধ্বনিত হয় প্রিয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা….।’
১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তি ও ২০১১ সালের প্রটোকলের আওতায় ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তি উপলক্ষে জেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি সংসদ সদস্য মো. আফতাব উদ্দীন সরকার বলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে বিনা যুদ্ধে বাংলাদেশের আরেকটি বিজয় অর্জিত হলো। এমন বিজয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।’
ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আর কোনো বৈষম্য, ভেদাভেদ থাকল না। ছিটমহল বলতে আর কিছু নেই। এসব গ্রামে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আজ থেকেই শুরু হলো।’
জনগণনায় বাদপড়াদের ‘রাষ্ট্রহীন’ হওয়ার শঙ্কা : বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়া বিলুপ্ত ভারতীয় ছিটমহলগুলোর বাসিন্দারা বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে গেছে। আর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়া বিলুপ্ত বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোর বাসিন্দারা হয়েছে ভারতীয়। এর বাইরে যারা নিজেদের আদি নাগরিকত্ব বহাল রাখতে চেয়েছে, তারাও সুযোগ পাচ্ছে। ভারতে বিলুপ্ত বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোর প্রায় ১৪ হাজার বাসিন্দা ভারতীয় নাগরিকত্ব বেছে নিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে বিলুপ্ত ভারতীয় ছিটমহলগুলোর ৪১ হাজার ৪৪৯ বাসিন্দার মধ্যে ৯৭৯ জন তাদের আদি নাগরিকত্ব ‘ভারতীয়’ই বহাল রাখতে চেয়েছে।
এর বাইরে ছিটমহলগুলোর কয়েকজন বাসিন্দা দাবি করেছে, তারা জনগণনায় বাদ পড়েছে। গত মাসে সর্বশেষ জনগণনার ভিত্তি ছিল ২০১১ সালের পরিসংখ্যান। ২০১১ সালে যেসব পরিবার জনগণনায় বাদ পড়েছে, তাদের এবারের জনগণনাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
গত ২৩ ও ২৪ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সীমান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপের ষষ্ঠ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারীর জেলা প্রশাসক এবং ভারতের কোচবিহারের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিজ নিজ আওতাধীন কারাগার অথবা সংশোধন কেন্দ্রগুলো অনতিবিলম্বে পরিদর্শন করে খোঁজ নেবেন, ছিটমহল থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া ব্যক্তিদের কেউ সেখানে আছে কি না। ২০১১ সালে নিবন্ধিত হয়েছিল এমন কেউ যদি সেখানে থাকে তাহলে আগামী ২০ আগস্টের মধ্যে তাদের নাগরিকত্ব বেছে নেওয়ার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এর বাইরে কেবল ব্যতিক্রমী মানবিক প্রকৃতির আবেদনগুলো যৌথ সীমান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ বিবেচনা করবে।
ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের চলে যেতে হবে ১ থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে : বাংলাদেশের ভেতরের ছিটমহল ছেড়ে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের ১ আগস্ট থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বুড়িমারী-চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত চেক পোস্ট (যেখানে অভিবাসন ও কাস্টমস সুবিধা আছে) দিয়ে চলে যেতে হবে। বাংলাদেশে ভারতীয় মিশন তাদের ‘ট্রাভেল পারমিট’ ইস্যু করবে এবং আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মেয়াদে ‘মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা’ ইস্যু করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠাবে।
ওই ব্যক্তিদের ভারতের কোচবিহারে ‘রিসেটলমেন্ট ক্যাম্প’ এ যাওয়ার জন্য ভারতীয় হাইকমিশন যানবাহনের ব্যবস্থা করবে এবং সেগুলো ক্যাম্প পর্যন্ত যেতে দেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে কোচবিহারের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাংলাদেশি ট্রাক ড্রাইভারদের প্রয়োজনীয় অনুমতি দেবেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার তাদের নিরাপত্তা ও চলাচলের সুবিধা দেবে।
আগামী এক বছরের মধ্যে অচিহ্নিত সীমান্ত চিহ্নিতকরণ ও অপদখলীয় ভূমির সমাধান : বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘ইনস্ট্রুমেন্ট’ অনুযায়ী, ২০১১ সালের প্রটোকলের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও ভারত অপদখলীয় ভূমি এবং অচিহ্নিত সীমান্তের অন্তর্বর্তীকালীন ‘নকশা চিত্র’ (স্ট্রিপ ম্যাপ) তৈরি করে প্রতিভূদের (প্ল্যানিপোটেনশিয়ারি) স্বাক্ষর নিয়ে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে বিনিময়ের কথা ছিল। দুই দেশের সরকারের জরিপ অধিদপ্তর আগামী বছরের ৩০ জুনের মধ্যে নকশা চিত্র অনুযায়ী মাঠপর্যায়ে সীমানা চিহ্নিত করবে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে মোট এক হাজার ১৪৫টি নকশা চিত্রের মধ্যে একটি ছাড়া বাকি সব স্বাক্ষরিত হয়েছে। অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ের ফলে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে দুই হাজার ৭৭৭.০৩৮ একর জমি পাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে পাবে দুই হাজার ২৬৭.৬৮২ একর।