সমতার জন্য দীর্ঘ লড়াই। আইনের পরিবর্তন। রাষ্ট্রের শীর্ষ প্রায় সব পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব। কিন্তু আসলে কী রাজনীতিতে নারীর অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয়েছে। নাকি তারা যে তিমিরে ছিলেন সে তিমিরেই আছেন। সংসদের সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যরা কতটা গুরুত্ব পাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে সংরক্ষিত ৩৫নং নারী আসনের এমপি সাবিনা আক্তার তুহিন মানবজমিনকে বলেন, আমাদের কেউ অধিকার দিতে চায় না। তবে অধিকার আদায় করে নিতে হয়। ঢাকার মিরপুরে আমার এলাকায় প্রচুর কাজ করেছি। অনেক বাধা এসেছে তবে নিজের যোগ্যতা দিয়ে সেসব বাধা অতিক্রম করেছি। আমার মতো হয়তো অনেকেই এটা পারেন না। তাদের জন্য কাজ করা সত্যিই কঠিন। দলীয়ভাবে এই এমপিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নাটোর জেলায়। স্থানীয় এমপির কারণে সেখানে তিনি সরাসরি কাজ করতে পারেন না। বিষয়টি সরাসরি স্বীকার না করে তুহিন বলেন, এ পর্যন্ত নাটোরে মাত্র দুবার গিয়েছি। কোন কাজ করতে পারিনি। যা করার মিরপুরের জন্যই করেছি। রাজনীতিতে কাজ করতে গিয়ে বৈষম্যের বিষয়টি সরাসরি তুলে ধরেছেন বেগম সেলিনা আক্তার বানু। দলীয়ভাবে সমস্যা হতে পারে জানিয়ে এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি সংরক্ষিত ৭ আসনের এমপি। অপর এমপি বেগম খোরশেদ আরা হক মানবজমিনকে বলেন, প্রশাসনের অনেকে আমার কথা শোনেন না। কোন অনুরোধ করলে রাখেন না। স্থানীয় এমপি বললে তারা ঠিকই শোনেন। দলীয় সিদ্ধান্তেও আমাদের ভূমিকা খুবই নগণ্য বলে মনে করি। তিনি বলেন, আমরা নিজেদের জন্য কাজ করি না। জনগণের জন্য কাজ করি। তারপরও এ ধরনের বৈষম্য দুঃখজনক। সংশ্লিষ্টরা জানান, মোটা দাগে সংসদ সদস্যদের কাজ ৪টি। প্রথমত, আইন প্রণয়ন; দ্বিতীয়ত, জাতীয় এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠান; তৃতীয়ত, সরকারের আয়-ব্যয় ও বাজেট অনুমোদন; চতুর্থত, সংসদীয় কমিটিগুলোর মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ। এর বাইরে রয়েছে রাজনীতিতে ভূমিকা রাখা। কিন্তু কোনটিতেই তাদের শক্ত ভূমিকা রাখা সহজ হয় না। এ নিয়ে নারী নেত্রীরাও হতাশা প্রকাশ করেন। সাবেক এমপি ও জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা বলেন, দৃশ্যত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসে অর্ধেকের বেশি সময় সরকার পরিচালনা করছেন নারীরা। ১৯৯১ সালের পর থেকে নির্বাচনকালীন সময় ও ওয়ান ইলেভেনের দুই বছরের দখলদার সরকার ছাড়া বাকি সময় দুজন নারী নেত্রীই দেশ পরিচালনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী-বিরোধীদলীয় নেত্রী ছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন নারীরা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অবস্থান দিন দিন সুদৃঢ় হচ্ছে। তবে এটা সত্য যে, যেভাবে উন্নতির ঢাকঢোল পেটানো হয় তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি বাস্তবতা। বিশেষত দেশে অনির্বাচিত সরকার ও আইনের শাসনহীনতায় এ বৈষম্য কমছে না। অন্যদিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীরা এখনও পিছিয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী বলে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার সুযোগ নেই। প্রকৃত অর্থে এখনও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীদের নারী হিসেবে দেখা হয়। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের ভূমিকা এখনও কার্যকর বা প্রতিষ্ঠিত নয়। বিএনপির মহিলা বিষয়ক সহ-সম্পাদক শিরিন সুলতানা বলেন, সার্বিকভাবে নারীরা এগিয়ে যাওয়ায় রাজনীতিতে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষত স্থানীয় সরকার থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত নারীদের প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ বাড়ার কারণে নারীদের উৎসাহ, আত্মবিশ্বাস ও অংশগ্রহণ বাড়ছে। তবে সমাজের অন্যান্য স্তরের মতো রাজনীতিতেও নারীরা কম-বেশি বৈষম্যের শিকার। আন্দোলন-সংগ্রাম ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরিশ্রমী এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পরও দলের পদায়ন, গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা ক্ষমতায়নে উদারভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। প্রশাসনের মতো রাজনীতিতে নেতাদের একটি কমন প্রশ্ন শুনতে হয়, একজন নারী কি এতবড় দায়িত্ব পালন করতে পারবেন? শিরিন সুলতানা বলেন, সংরক্ষিত এমপিদের কাজের ক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট নয়, সেখানেও বৈষম্যের শিকার। তারা বাপের বাড়ি না স্বামীর বাড়ি না অন্য কোথাও ভূমিকা রাখবে সেই জটিলতা কাটেনি। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে সভাপতি তো নয়ই, বড়জোর সদস্য করা হয়। সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনগুলোর সুনির্দিষ্ট এলাকা নির্ধারণ করে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত করলে হীনমন্যতা থাকবে না। বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি ও জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক রেহেনা আক্তার রানু বলেন, বাংলাদেশে রাজনীতিতে নারীরা এখনও বৈষম্যের শিকার। উচ্চপর্যায়ে কিছু নারীর অবস্থান বৈষম্য দূরীকরণে বড় ভূমিকা রাখলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর মতামতের তেমন একটা মূল্যায়ন করা হয় না। তারপরও আগের তুলনায় রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। সারাদেশে সব পর্যায়ের নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। কিন্তু রাজনীতি ও জনপ্রতিনিধিত্বে নারীর অবস্থান সংখ্যাগত দিক থেকে বাড়লেও প্রাপ্য মূল্যায়ন পাচ্ছে না। বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ফেনী জেলা বিএনপির প্রথম যুগ্ম সম্পাদক রেহেনা আক্তার রানু বলেন, দলীয় ফোরামের রাজনীতিতে আমরা সহকর্মীদের কাছে ভাল ব্যবহারই পাই। কিন্তু সমান যোগ্যতা থাকার পরও কেবল নারী এ কারণে নারীরা পিছিয়ে পড়ে। রেহেনা আক্তার রানু বলেন, আমি সংরক্ষিত আসনের এমপি হিসেবে সরকারি দল এবং বিরোধীদল দুই ভূমিকাতেই সংসদে ছিলাম। কিন্তু সত্য কথা বলতে, তেমন কোন কাজ করার সুযোগ পাইনি। সাধারণ এমপিদের মতো বরাদ্দ বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তো দূরের কথা। তাছাড়া সংরক্ষিত এমপিদের কাজ করার সুনির্দিষ্ট কোন এলাকা না থাকায় এ বৈষম্য কমছে না। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তুলে রেখেছে পুরুষ জনপ্রতিনিধিরা। এক সময় কথা উঠেছিল প্রতি জেলা থেকে একজন করে সংরক্ষিত নারী এমপি হবে। সেটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। আমি মনে করি, এলাকা নির্দিষ্ট করে তাদের কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এখানে সুযোগ দেয়া-না দেয়ার প্রশ্নই হলো মুখ্য। কিন্তু সংরক্ষিত নারী এমপিদের অলংকার বা শোপিস বলার মতো পরিস্থিতি এখন নেই। এরশাদ আমলে কিছু হাউজ ওয়াইফকে চেয়ারগুলোতে বসানো হতো। এখন রাজপথে রাজনীতির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নারীরাই সে চেয়ারে বসছে। আগে সংরক্ষিত নারী এমপিরা তেমন কথা বলতেন না। এখন সংরক্ষিত নারী এমপিরা দেশের সমস্যা-সম্ভাবনাসহ রাষ্ট্রীয় ইস্যুতে সংসদে নির্বাচিত এমপিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুখর। অলংকার সেট বা শোপিস বলার দিন এখন নেই। বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি ও মহিলা দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রাশেদা আক্তার হীরা বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীরা দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতির মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে এখনও। নারীরা তখনই রাজনীতিতে উৎসাহিত হয় যখন দেশে গণতন্ত্র থাকে। নারীদের তো পেশিশক্তি নেই। রাজনীতিতে মেয়েদের বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতা। সার্বিকভাবে বলতে গেলে রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ অনেকটা তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠার মতো। গণতান্ত্রিক সময়ে যেটুকু এগিয়েছিল সাম্প্রতিককালে সেটা পিছিয়েছে। সরকার ও বিরোধী দলের এমপি হিসেবে অভিজ্ঞ হীরা বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএস-এ ‘পার্মালেন্টে নারীর সমঅংশগ্রহণের অধিকার, সুযোগ এবং সীমাবদ্ধতা’ শীর্ষক পিএইচডি গবেষণা করছেন। হীরা বলেন, সংসদে সংরক্ষিত নারী এমপিরা অনেকটাই বিরোধীদলের সদস্যের মতো। সেক্ষেত্রে বিরোধী দলের নারী এমপিরা তো বিরোধী দলেরও বিরোধী দল। সাধারণ এমপিরা যে বরাদ্দ পায় তার এক দশমাংশ বরাদ্দ পায় নারীরা। সুনির্দিষ্ট এলাকা না থাকায় সেগুলোও অন্যরা ভাগ চাইতে আসে। সুনির্দিষ্ট এলাকা না থাকায় সংরক্ষিত নারী এমপিদের কোন এলাকার মানুষের জন্য কাজ করা ও ভিত্তি মজবুত করার সুযোগ নেই। এটা অনেকটা না ঘরকা, না ঘাটকা অবস্থা। তার ওপর আওয়ামী লীগ আবার এক এলাকার নারীকে দায়িত্ব দিয়েছেন অন্য এলাকায়। তিনি বলেন, সংসদে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে নারী এমপিরা কতটুকু কথা বলতে পারবেন তার নির্দিষ্ট সুযোগ নেই। এটা নির্ভর করে স্পিকারের ইচ্ছার ওপর। সংসদীয় কমিটিগুলোতে টোকেন উপস্থিতি রাখা হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখার তেমন সুযোগ নেই। ফলে সংসদে নারীর উপস্থিতি আছে এটা যতটা দেখানোর বিষয় হয়েছে, তাদের সক্রিয় ভূমিকা রাখার ততটা সুযোগ নেই। বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হীরা বলেন, আমি মনে করি না সংরক্ষিত নারী এমপিরা সংসদের অলঙ্কার, এক সময় এমন মনোভাব ছিল। কিন্তু এরশাদের পতন ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার পাশাপাশি সে পরিস্থিতি অনেক ভালভাবেই অতিক্রান্ত। এখন কেউ গয়না মনে করে না। ধীরগতি হলেও নারীদের ভূমিকা বাড়ছে।
সংবাদ শিরোনাম
রাজনীতিতে কোথায় দাঁড়িয়ে নারী
- Reporter Name
- আপডেট টাইম : ১২:৫৭:৫৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২ অগাস্ট ২০১৫
- ৪৮৭ বার
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ