ঢাকা ০৫:৩৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নতুন দেশ, নতুন পরিচয়

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:২০:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২ অগাস্ট ২০১৫
  • ৩৩৬ বার

মঞ্চে ৬৮টি প্রদীপের আলোতে যেন ঘুচে গেল ৬৮ বছরের বঞ্চনা। সময় রাত ১২টা। ঐতিহাসিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণকে ঘিরে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ল কুড়িগ্রামের এক মুহূর্ত আগে বিলুপ্ত হওয়া ভারতীয় ছিটমহল দাশিয়ারছড়ায়। প্রদীপ প্রজ্বালনের সময় পেছনে একজন উঁচু করে ধরলেন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। সেই সঙ্গে সমস্বরে স্লোগান-‘জয় বাংলা’, ‘দিল্লি নয় ঢাকা; ঢাকা, ঢাকা, ঢাকা’; ‘আর নয় ছিটমহল, আমরা সবাই বাংলাদেশি’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। মিষ্টিমুখ হলো, গাওয়া হলো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। আবেগ আর সামলে রাখা যাচ্ছিল না। গত রাত ১টায় এই প্রতিবেদন লেখার সময়ও সেখানে চলছিল আনন্দ মিছিল। দাশিয়ারছড়ার কামালপুর গ্রামের এক চায়ের দোকানে বসে গতকাল শুক্রবার দুপুরে ৮০ বছর বয়সী তছির উদ্দিন বলেছিলেন, ‘হামরা খাঁচার ভেতর বন্দি ছিলাম। এলা হামরা মুক্ত। জীবনে এত আনন্দ আর কোনো দিন পাই নাই।’ তিনি গতকাল ৩১ জুলাই পর্যন্ত ছিলেন ভারতীয় নাগরিক। গত মধ্যরাতে হয়ে গেছেন বাংলাদেশি। তাঁর বসতবাড়ি ছিল এতদিন বাংলাদেশের ভেতর ভারতীয় ভূখণ্ডে। সেটিও হয়ে গেছে বাংলাদেশের।

তছির উদ্দিন ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারত থেকে সপরিবারে এসেছিলেন ছিটমহলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, বিজয়ের আনন্দ দেখেছেন। কিন্তু ছিটমহলের বন্দিদশা থেকে মুক্তির বিষয়টি তাঁর মতো ৫২ হাজার বাসিন্দার কাছে অন্য রকম। দিনভর ক্ষণ গণনা শেষে সন্ধ্যা থেকে মশাল আর প্রদীপ জ্বালিয়ে নতুন এক জীবন উদ্‌যাপন করছিলেন তাঁরা। আজ ১ আগস্ট প্রথম প্রহর থেকে তাঁরা নতুন দেশের নাগরিক। সেই সঙ্গে বদলে গেছে তাঁদের ঠিকানা।

বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে থাকা ১৬২টি ছিটমহল গত মধ্যরাতেই বিলুপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশের ভেতর ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের অংশ হয়ে গেছে। আর ভারতের ভেতর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল হয়ে গেছে ভারতের। গত মধ্যরাতে দুই দেশে যুক্ত হওয়া নতুন ওই ১৬২টি ভূখণ্ডে আজ শনিবার ভোর থেকে উঠছে নতুন জাতীয় পতাকা। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়া বিলুপ্ত ভারতীয় ছিটমহলগুলোর বাসিন্দারা বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে গেছেন, ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়া বিলুপ্ত বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোর বাসিন্দারা হয়ে গেছেন ভারতীয়। এর বাইরে যাঁরা নিজেদের আদি নাগরিকত্ব বহাল রাখতে চেয়েছেন তাঁরাও সে সুযোগ পাচ্ছেন। ভারতে বিলুপ্ত বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোর প্রায় ১৪ হাজার বাসিন্দা ভারতীয় নাগরিকত্ব বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশে বিলুপ্ত ভারতীয় ছিটমহলগুলোর ৪১ হাজার ৪৪৯ জন বাসিন্দার মধ্যে ৯৭৯ জন তাঁদের আদি নাগরিকত্ব ‘ভারতীয়’ই বহাল রাখতে চেয়েছেন। আগামী নভেম্বরের ১ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বিলুপ্ত ভারতীয় ছিটমহলগুলোর বাসিন্দারা পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ ছাড়বেন। বাংলাদেশে ভারতীয় মিশন তাঁদের ‘ট্রাভেল পারমিট’ ইস্যু করবে এবং ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মেয়াদে ‘মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা’ ইস্যু করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠাবে। ওই ব্যক্তিদের ভারতের কোচবিহারে ‘রিসেটেলমেন্ট ক্যাম্প’-এ যাওয়ার জন্য বাংলাদেশে ভারতীয় মিশন যানবাহনের ব্যবস্থা করবে এবং সেগুলো ক্যাম্প পর্যন্ত যেতে দেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে কোচবিহারের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাংলাদেশি ট্রাক ড্রাইভারদের প্রয়োজনীয় অনুমতি দেবেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার তাঁদের নিরাপত্তা ও চলাচলের সুবিধা দেবে। তবে ভারতীয় নাগরিকত্ব বহাল রাখার আবেদনকারীদের মধ্যে কেউ কেউ শেষ মুুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলের আবেদন জানিয়েছেন। গতকাল এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিলুপ্ত হওয়া ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দা মোহাম্মদ মঈনুল (২৮) তাঁর ভারতীয় নাগরিকত্ব বহাল রাখার আবেদন বাতিলের জন্য অন্য একটি আবেদনপত্রে গত বৃহস্পতিবার স্বাক্ষর করেছেন। আবার কোথাও স্বামী-স্ত্রী দুজন আলাদা দুই দেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন এমন খবরও পাওয়া গেছে।

নতুন দেশ, নতুন পরিচয়

দাশিয়ারছড়া ছিটমহলে বিজয় মিছিল, মসজিদে-মন্দিরে প্রার্থনা : আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আবদুল খালেক ফারুক জানান, গতকাল সকাল থেকেই মুক্তির আনন্দে মেতে ওঠে ছিটমহলবাসী। ফুলবাড়ী উপজেলার ভেতর সবচেয়ে বড় ছিটমহল দাশিয়ারছড়ায় সকাল থেকে তিনটি মঞ্চে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। তবে মূল আয়োজন ছিল দাশিয়ারছড়া ছিটের কালীরহাট বাজারে। এখানে প্রধান অতিথি হিসেবে সব কর্মসূচির উদ্বোধন করেন সাবেক এমপি মো. জাফর আলী।

গতকাল সকাল থেকেই ছিটমহলবাসী মিলিত হয় আনন্দ আয়োজনে। আয়োজন করা হয় লাঠিখেলা ও নৌকাবাইচ, বিজয় মিছিল ও আনন্দ মিছিল। বাড়ি বাড়ি চলে ভালো খাবারের আয়োজন। পরিবার-পরিজন মিলে খুশিতে মেতে ওঠে সবাই। জুমার নামাজ শেষে মিলাদ মাহফিল ও আখেরি মোনাজাত এবং মন্দিরে মন্দিরে পূজা-অর্চনা করে ছিটমহলবাসী।

দাশিয়ারছড়া ছিটমহলের ৯টি মসজিদে ছিল উপচেপড়া ভিড়। ছিটের বাইরের দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন বিশেষ মোনাজাতে অংশগ্রহণ করে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সুস্বাস্থ্য কামনা করা হয়। যারা ভারতে চলে যাচ্ছে তাদের জন্য শুভ কামনা এবং যারা বাংলাদেশে রয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য মঙ্গল কামনা করা হয়। একইভাবে দাশিয়ারছড়া ছিটের ছয়টি মন্দিরে আয়োজন করা হয় বিশেষ প্রার্থনার। উঢ়াটারী গ্রামের বাদশা মিয়া বলেন, ‘আজ ঈদের মতো খুশি লাগছে। বাড়িতে পোলাও-মাংস রান্না হচ্ছে। ছিটের বাইরে থেকে মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়িসহ অন্য আত্মীয়স্বজন এসেছেন।’ একই কথা জানালেন এই গ্রামের জাহিদুল হক। ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশ ইউনিটের নেতাদের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয় দাশিয়ারছড়া ছিটমহলে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিরোধী দলের চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। ছিটমহলজুড়ে নেওয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা। পুলিশ দিনরাতে সার্বক্ষণিকভাবে ছিটমহলে টহল দিচ্ছে। স্থানীয় ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক তাদের সহযোগিতা করছে। পাশাপাশি বিজিবি ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কাজ তদারকি করছে। কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার তবারক উল্লাহ বলেন, ‘সরকারের অনুমতি পেলে আমরা এ ছিটমহলে ভবিষ্যতে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করব।’

গারাতি ছিটমহল উৎসবমুখর : আমাদের পঞ্চগড় প্রতিনিধি সাইফুল আলম বাবু জানান, পঞ্চগড়ে গত মধ্যরাতে ছিটমহল বিনিময়ের সবচেয়ে বড় আয়োজন ছিল গারাতি ছিটমহলে। গতকাল সকাল থেকেই বিভিন্ন ছিটমহলে বিরাজ করে উৎসবের পরিবেশ। সদর উপজেলার গারাতি ছিটমহলের ফোরকানিয়া মাদ্রাসা মাঠে গতকাল দুপুরে গিয়ে দেখা গেছে, অন্ধকার ছিটমহলের পরিচয় মুছে যাওয়ার প্রতীক্ষা যেন তর সইছে না কারো। ছোট-বড় জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সী লোকজন নেচে গেয়ে মুক্তির আনন্দ প্রকাশ করছে। কেউ বাঁশি বাজিয়ে জানান দিচ্ছে সে আনন্দের অনুভূতি। শিশুরা মেতে উঠেছে খেলাধুলায়। বিকেলে মাদ্রাসা মাঠে হচ্ছিল ‘চুক্তির মুক্তি’ নামে নাটকের মঞ্চায়ন। সেখানেও নিজেদের মুক্তির প্রতিচ্ছবি নাটকের দৃশ্যে দেখতে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার ভিড়। নাটকের এক-একটি দৃশ্য দেখে তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন-‘হ্যাঁ, এমনই ছিলাম তো।’ নাটক দেখতে মশগুল বৃদ্ধ শাহ আলম বললেন, ‘৬৮ বছর থাইকা কেমন ছিলাম তাই দেখতাছি। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা আর মোদি যে কাম করল হেইডা কেউ পারত কি না সন্দেহ আছে।’ কানাপাড়া গ্রামে যেতেই নাকে এলো পোলাও ও মাংস রান্না করার সুঘ্রাণ। সেখানে নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান, পাশের বাড়ির আব্দুর রহমান ও বাবুল হোসেনের বাড়িতেই সেসব রান্নার আয়োজন। গারাতি ছিটমহলের নাগরিক কমিটির চেয়ারম্যান মফিজার রহমান বলেন, ‘সকাল থেকেই লোকজন ঘর থেকে বেরিয়ে আমাদের নানা আয়োজনে যোগ দিয়েছে। জুমার নামাজের পর ছিটমহলের মসজিদে বিশেষ মোনাজাত হয়েছে।’ মোমবাতির আলোয় ম্লান সীমান্তের সোডিয়াম বাতি : আমাদের লালমনিরহাট প্রতিনিধি হায়দার আলী বাবু জানান, গত রাত ১২টায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার উত্তর গোতামারী ছিটমহল চলে আসে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার অধীনে। সে সময় জ্বালানো হয় মোমবাতি। অসংখ্য মোমের আলোয় যেন ম্লান হয়ে যায় ভারতীয় সীমান্তের সোডিয়াম বাতির আলো। মাইকে বাজছিল দেশাত্মবোধক গান।

লালমনিরহাটের ৫৯টি ছিটমহলের মধ্যে ১৭টিতে ছিল না কোনো জনবসতি। গতকাল সকাল থেকে সদর উপজেলার ভেতরকুটি, হাতীবান্ধার ১৩৫ ও ১৩৬ নম্বর উত্তর গোতামারী, পাটগ্রামের ১১৯ নম্বর বাঁশকাটা, লতামারীসহ একাধিক ছিটমহল ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি ছিটমহলেই যেন প্রাণ ফিরে এসেছে। বাসিন্দারা যেন ঈদের চেয়েও বেশি আনন্দে মেতেছে। কারো কারো বাড়িতে এসেছে মেয়ে-জামাই। পাটগ্রাম উপজেলার ভেতর থাকা ভারতীয় ১১৯ বাঁশকাটা ছিটমহলে গিয়ে দেখা যায়, শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। জুমার নামাজের পর মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ দোয়া। এরপর শুরু হয় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলাসহ বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা। সন্ধ্যায় স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় শুরু হয় গ্রামবাংলার লোকজ সংগীত, রাতে হয় যাত্রাপালা। ওই ছিটমহলের হাফিজার রহমান (৬৫) বলেন, ‘প্রায় ৭০ বছরের বন্দি জীবন থেকে আমরা মুক্তি পাচ্ছি। আর বেছে নিয়েছি বাংলাদেশি নাগরিকত্ব।’

বিকেলে উত্তর গোতামারী ছিটমহলে আয়োজন করা হয় হা-ডু-ডু, লাঠিখেলা ও ‘ছিট খেলার’। সন্ধ্যার পর অনুষ্ঠিত হয় জারিগান। এ রকম নানা ধরনের আয়োজন, আলোকসজ্জাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ছিটমহলগুলোতে। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির লালমনিরহাট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আজ আমাদের বিজয়ের দিন, স্বাধীনতার দিন। এই দিনটি পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর আমরা আন্দোলন করেছি।’ আনন্দের জোয়ার নীলফামারীর চার ছিটমহলে : আমাদের নীলফামারী প্রতিনিধি ভুবন রায় নিখিল জানান, গত রাত ১২টায় জেলার ডিমলা উপজেলায় ২৯ নম্বর বড়খানকি খারিজা গিদলাদহে মিজানুর রহমানের বাড়িতে ৬৮টি মোমবাতি জ্বালায় বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা। ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশের অংশ হওয়ার আনন্দে যোগ দিয়েছে নীলফামারীর চার ছিটমহলের নারী, শিশুসহ সবাই। ৩১ নম্বর জিগাবাড়ী ছিটমহলের আখতারুল ইসলাম (৫৫) বলেন, ‘অনেক ত্যাগের পর আমরা নাগরিক অধিকার ফিরে পাচ্ছি। দিনটি আমাদের জীবনে স্মরণীয়। আমরা দিনটিকে বিশেষ দিন হিসেবে উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি নিয়েছি।’

ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখতে আজ সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে। এরপর স্থানীয় নাগরিকদের আয়োজনে সেখানে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে।

ঘটনাপ্রবাহ : বাংলাদেশের অংশ হয়ে যাওয়া ভারতের ১১১টি ছিটমহলের (১৭১৬০.৬৩ একর) ১২টির অবস্থান কুড়িগ্রামে, ৫৯টি লালমনিরহাটে, চারটি নীলফামারীতে ও ৩৬টি পঞ্চগড়ে। অন্যদিকে ভারতের অংশ হয়ে যাওয়া ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহলের অবস্থান কোচবিহার জেলায়। এক দেশের মূল ভূখণ্ডের ভেতর অন্য দেশের ছোট ছোট ভূখণ্ড অত্যন্ত জটিল সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। ওই ছোট ছোট ভূখণ্ডের বাসিন্দারা ছিল কার্যত অবরুদ্ধ এবং নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ছিটমহল নামের ওই ছোট ছোট ভূখণ্ডের ওপর অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণও ছিল না।

গত ৬ ও ৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত মধ্যরাতে ছিটমহলগুলোর বিনিময় চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্বাক্ষরিত স্থল সীমান্ত চুক্তি এবং ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের উপস্থিতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা স্থল সীমান্ত চুক্তির প্রটোকল স্বাক্ষর করেন। সেগুলো বাস্তবায়নে ৬ জুন মোদির ঢাকা সফরে ইন্সট্রুমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়।

মোদির সফরের পর ছিটমহলগুলোর বাসিন্দাদের নাগরিকত্ব বাছাইকরণ প্রক্রিয়ায় অনেক কাজ হয়েছে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারীর জেলা প্রশাসক এবং ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেলের দপ্তর এবং কোচবিহারের জেলা প্রশাসক সমন্বিতভাবে নাগরিকত্ব বিষয়ে ছিটমহলবাসীর মতামত নিয়েছেন। গত ৬ থেকে ১৬ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের ৩০ জন পর্যবেক্ষকের উপস্থিতিতে ৭৫টি দল উভয় দেশের ছিটমহলে মতামত সংগ্রহের কাজ করেছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে অত্যন্ত জটিল এ সীমান্ত সমস্যার সফল সমাধানের ক্ষেত্রে গতকাল ৩১ জুলাই ছিল এক ঐতিহাসিক দিন। গত মধ্যরাত থেকে ছিটমহলগুলো বিলুপ্ত হয়ে নতুন দেশের অংশ হওয়ায় সেখানকার বাসিন্দারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা পাবে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য অচিরেই প্রকল্প : দীর্ঘ ৬৮ বছর পর ছিটমহল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে সমস্যা সমাধান হওয়ায় এর বাসিন্দাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাঁর অভিনন্দন বার্তায় ছিটমহল বিনিময়ের মুহূর্তকে ঐতিহাসিক হিসেবে অভিহিত করেন। সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানান। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ছিটমহলবাসী তাঁদের জাতিসত্তার স্বীকৃতি পাওয়ায় তাদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ৬৮ বছর পর তারা তাদের পরিচয়, নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসের সুযোগ এবং প্রিয় মাতৃভূমির জাতীয় পতাকা ও মানচিত্র পেয়েছে। বাংলাদেশের অন্য নাগরিকদের সঙ্গে তাদের কোনো পার্থক্য নেই। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে যে ধরনের প্রকল্প নেওয়া দরকার সরকার তার সব রকমের ব্যবস্থাই করবে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলবাসী গত মধ্যরাত থেকেই স্বাধীন দেশের নাগরিকের পূর্ণ মর্যাদা পাওয়ায় তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অভিনন্দন বার্তায় তিনি বলেন, ‘ছিটমহলবাসীদের বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা এখন থেকে এ দেশের নাগরিক। দেশের অন্য নাগরিকদের সঙ্গে তাদের কোনো পার্থক্য নেই। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে যে ধরনের প্রকল্প নেওয়া দরকার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় যেন সে ধরনের প্রকল্প হাতে নেয়।’

পরিকল্পনামন্ত্রী আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় প্রকল্প তৈরির কাজ অচিরেই হাতে নিতে যাচ্ছে। একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি এ কাজের প্রয়োজনীয় তদারকি করবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

নতুন দেশ, নতুন পরিচয়

আপডেট টাইম : ১২:২০:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২ অগাস্ট ২০১৫

মঞ্চে ৬৮টি প্রদীপের আলোতে যেন ঘুচে গেল ৬৮ বছরের বঞ্চনা। সময় রাত ১২টা। ঐতিহাসিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণকে ঘিরে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ল কুড়িগ্রামের এক মুহূর্ত আগে বিলুপ্ত হওয়া ভারতীয় ছিটমহল দাশিয়ারছড়ায়। প্রদীপ প্রজ্বালনের সময় পেছনে একজন উঁচু করে ধরলেন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। সেই সঙ্গে সমস্বরে স্লোগান-‘জয় বাংলা’, ‘দিল্লি নয় ঢাকা; ঢাকা, ঢাকা, ঢাকা’; ‘আর নয় ছিটমহল, আমরা সবাই বাংলাদেশি’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। মিষ্টিমুখ হলো, গাওয়া হলো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। আবেগ আর সামলে রাখা যাচ্ছিল না। গত রাত ১টায় এই প্রতিবেদন লেখার সময়ও সেখানে চলছিল আনন্দ মিছিল। দাশিয়ারছড়ার কামালপুর গ্রামের এক চায়ের দোকানে বসে গতকাল শুক্রবার দুপুরে ৮০ বছর বয়সী তছির উদ্দিন বলেছিলেন, ‘হামরা খাঁচার ভেতর বন্দি ছিলাম। এলা হামরা মুক্ত। জীবনে এত আনন্দ আর কোনো দিন পাই নাই।’ তিনি গতকাল ৩১ জুলাই পর্যন্ত ছিলেন ভারতীয় নাগরিক। গত মধ্যরাতে হয়ে গেছেন বাংলাদেশি। তাঁর বসতবাড়ি ছিল এতদিন বাংলাদেশের ভেতর ভারতীয় ভূখণ্ডে। সেটিও হয়ে গেছে বাংলাদেশের।

তছির উদ্দিন ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারত থেকে সপরিবারে এসেছিলেন ছিটমহলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, বিজয়ের আনন্দ দেখেছেন। কিন্তু ছিটমহলের বন্দিদশা থেকে মুক্তির বিষয়টি তাঁর মতো ৫২ হাজার বাসিন্দার কাছে অন্য রকম। দিনভর ক্ষণ গণনা শেষে সন্ধ্যা থেকে মশাল আর প্রদীপ জ্বালিয়ে নতুন এক জীবন উদ্‌যাপন করছিলেন তাঁরা। আজ ১ আগস্ট প্রথম প্রহর থেকে তাঁরা নতুন দেশের নাগরিক। সেই সঙ্গে বদলে গেছে তাঁদের ঠিকানা।

বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে থাকা ১৬২টি ছিটমহল গত মধ্যরাতেই বিলুপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশের ভেতর ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের অংশ হয়ে গেছে। আর ভারতের ভেতর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল হয়ে গেছে ভারতের। গত মধ্যরাতে দুই দেশে যুক্ত হওয়া নতুন ওই ১৬২টি ভূখণ্ডে আজ শনিবার ভোর থেকে উঠছে নতুন জাতীয় পতাকা। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়া বিলুপ্ত ভারতীয় ছিটমহলগুলোর বাসিন্দারা বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে গেছেন, ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়া বিলুপ্ত বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোর বাসিন্দারা হয়ে গেছেন ভারতীয়। এর বাইরে যাঁরা নিজেদের আদি নাগরিকত্ব বহাল রাখতে চেয়েছেন তাঁরাও সে সুযোগ পাচ্ছেন। ভারতে বিলুপ্ত বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোর প্রায় ১৪ হাজার বাসিন্দা ভারতীয় নাগরিকত্ব বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশে বিলুপ্ত ভারতীয় ছিটমহলগুলোর ৪১ হাজার ৪৪৯ জন বাসিন্দার মধ্যে ৯৭৯ জন তাঁদের আদি নাগরিকত্ব ‘ভারতীয়’ই বহাল রাখতে চেয়েছেন। আগামী নভেম্বরের ১ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বিলুপ্ত ভারতীয় ছিটমহলগুলোর বাসিন্দারা পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ ছাড়বেন। বাংলাদেশে ভারতীয় মিশন তাঁদের ‘ট্রাভেল পারমিট’ ইস্যু করবে এবং ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মেয়াদে ‘মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা’ ইস্যু করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠাবে। ওই ব্যক্তিদের ভারতের কোচবিহারে ‘রিসেটেলমেন্ট ক্যাম্প’-এ যাওয়ার জন্য বাংলাদেশে ভারতীয় মিশন যানবাহনের ব্যবস্থা করবে এবং সেগুলো ক্যাম্প পর্যন্ত যেতে দেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে কোচবিহারের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাংলাদেশি ট্রাক ড্রাইভারদের প্রয়োজনীয় অনুমতি দেবেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার তাঁদের নিরাপত্তা ও চলাচলের সুবিধা দেবে। তবে ভারতীয় নাগরিকত্ব বহাল রাখার আবেদনকারীদের মধ্যে কেউ কেউ শেষ মুুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলের আবেদন জানিয়েছেন। গতকাল এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিলুপ্ত হওয়া ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দা মোহাম্মদ মঈনুল (২৮) তাঁর ভারতীয় নাগরিকত্ব বহাল রাখার আবেদন বাতিলের জন্য অন্য একটি আবেদনপত্রে গত বৃহস্পতিবার স্বাক্ষর করেছেন। আবার কোথাও স্বামী-স্ত্রী দুজন আলাদা দুই দেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন এমন খবরও পাওয়া গেছে।

নতুন দেশ, নতুন পরিচয়

দাশিয়ারছড়া ছিটমহলে বিজয় মিছিল, মসজিদে-মন্দিরে প্রার্থনা : আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আবদুল খালেক ফারুক জানান, গতকাল সকাল থেকেই মুক্তির আনন্দে মেতে ওঠে ছিটমহলবাসী। ফুলবাড়ী উপজেলার ভেতর সবচেয়ে বড় ছিটমহল দাশিয়ারছড়ায় সকাল থেকে তিনটি মঞ্চে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। তবে মূল আয়োজন ছিল দাশিয়ারছড়া ছিটের কালীরহাট বাজারে। এখানে প্রধান অতিথি হিসেবে সব কর্মসূচির উদ্বোধন করেন সাবেক এমপি মো. জাফর আলী।

গতকাল সকাল থেকেই ছিটমহলবাসী মিলিত হয় আনন্দ আয়োজনে। আয়োজন করা হয় লাঠিখেলা ও নৌকাবাইচ, বিজয় মিছিল ও আনন্দ মিছিল। বাড়ি বাড়ি চলে ভালো খাবারের আয়োজন। পরিবার-পরিজন মিলে খুশিতে মেতে ওঠে সবাই। জুমার নামাজ শেষে মিলাদ মাহফিল ও আখেরি মোনাজাত এবং মন্দিরে মন্দিরে পূজা-অর্চনা করে ছিটমহলবাসী।

দাশিয়ারছড়া ছিটমহলের ৯টি মসজিদে ছিল উপচেপড়া ভিড়। ছিটের বাইরের দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন বিশেষ মোনাজাতে অংশগ্রহণ করে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সুস্বাস্থ্য কামনা করা হয়। যারা ভারতে চলে যাচ্ছে তাদের জন্য শুভ কামনা এবং যারা বাংলাদেশে রয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য মঙ্গল কামনা করা হয়। একইভাবে দাশিয়ারছড়া ছিটের ছয়টি মন্দিরে আয়োজন করা হয় বিশেষ প্রার্থনার। উঢ়াটারী গ্রামের বাদশা মিয়া বলেন, ‘আজ ঈদের মতো খুশি লাগছে। বাড়িতে পোলাও-মাংস রান্না হচ্ছে। ছিটের বাইরে থেকে মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়িসহ অন্য আত্মীয়স্বজন এসেছেন।’ একই কথা জানালেন এই গ্রামের জাহিদুল হক। ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশ ইউনিটের নেতাদের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয় দাশিয়ারছড়া ছিটমহলে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিরোধী দলের চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। ছিটমহলজুড়ে নেওয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা। পুলিশ দিনরাতে সার্বক্ষণিকভাবে ছিটমহলে টহল দিচ্ছে। স্থানীয় ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক তাদের সহযোগিতা করছে। পাশাপাশি বিজিবি ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কাজ তদারকি করছে। কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার তবারক উল্লাহ বলেন, ‘সরকারের অনুমতি পেলে আমরা এ ছিটমহলে ভবিষ্যতে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করব।’

গারাতি ছিটমহল উৎসবমুখর : আমাদের পঞ্চগড় প্রতিনিধি সাইফুল আলম বাবু জানান, পঞ্চগড়ে গত মধ্যরাতে ছিটমহল বিনিময়ের সবচেয়ে বড় আয়োজন ছিল গারাতি ছিটমহলে। গতকাল সকাল থেকেই বিভিন্ন ছিটমহলে বিরাজ করে উৎসবের পরিবেশ। সদর উপজেলার গারাতি ছিটমহলের ফোরকানিয়া মাদ্রাসা মাঠে গতকাল দুপুরে গিয়ে দেখা গেছে, অন্ধকার ছিটমহলের পরিচয় মুছে যাওয়ার প্রতীক্ষা যেন তর সইছে না কারো। ছোট-বড় জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সী লোকজন নেচে গেয়ে মুক্তির আনন্দ প্রকাশ করছে। কেউ বাঁশি বাজিয়ে জানান দিচ্ছে সে আনন্দের অনুভূতি। শিশুরা মেতে উঠেছে খেলাধুলায়। বিকেলে মাদ্রাসা মাঠে হচ্ছিল ‘চুক্তির মুক্তি’ নামে নাটকের মঞ্চায়ন। সেখানেও নিজেদের মুক্তির প্রতিচ্ছবি নাটকের দৃশ্যে দেখতে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার ভিড়। নাটকের এক-একটি দৃশ্য দেখে তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন-‘হ্যাঁ, এমনই ছিলাম তো।’ নাটক দেখতে মশগুল বৃদ্ধ শাহ আলম বললেন, ‘৬৮ বছর থাইকা কেমন ছিলাম তাই দেখতাছি। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা আর মোদি যে কাম করল হেইডা কেউ পারত কি না সন্দেহ আছে।’ কানাপাড়া গ্রামে যেতেই নাকে এলো পোলাও ও মাংস রান্না করার সুঘ্রাণ। সেখানে নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান, পাশের বাড়ির আব্দুর রহমান ও বাবুল হোসেনের বাড়িতেই সেসব রান্নার আয়োজন। গারাতি ছিটমহলের নাগরিক কমিটির চেয়ারম্যান মফিজার রহমান বলেন, ‘সকাল থেকেই লোকজন ঘর থেকে বেরিয়ে আমাদের নানা আয়োজনে যোগ দিয়েছে। জুমার নামাজের পর ছিটমহলের মসজিদে বিশেষ মোনাজাত হয়েছে।’ মোমবাতির আলোয় ম্লান সীমান্তের সোডিয়াম বাতি : আমাদের লালমনিরহাট প্রতিনিধি হায়দার আলী বাবু জানান, গত রাত ১২টায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার উত্তর গোতামারী ছিটমহল চলে আসে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার অধীনে। সে সময় জ্বালানো হয় মোমবাতি। অসংখ্য মোমের আলোয় যেন ম্লান হয়ে যায় ভারতীয় সীমান্তের সোডিয়াম বাতির আলো। মাইকে বাজছিল দেশাত্মবোধক গান।

লালমনিরহাটের ৫৯টি ছিটমহলের মধ্যে ১৭টিতে ছিল না কোনো জনবসতি। গতকাল সকাল থেকে সদর উপজেলার ভেতরকুটি, হাতীবান্ধার ১৩৫ ও ১৩৬ নম্বর উত্তর গোতামারী, পাটগ্রামের ১১৯ নম্বর বাঁশকাটা, লতামারীসহ একাধিক ছিটমহল ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি ছিটমহলেই যেন প্রাণ ফিরে এসেছে। বাসিন্দারা যেন ঈদের চেয়েও বেশি আনন্দে মেতেছে। কারো কারো বাড়িতে এসেছে মেয়ে-জামাই। পাটগ্রাম উপজেলার ভেতর থাকা ভারতীয় ১১৯ বাঁশকাটা ছিটমহলে গিয়ে দেখা যায়, শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। জুমার নামাজের পর মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ দোয়া। এরপর শুরু হয় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলাসহ বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা। সন্ধ্যায় স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় শুরু হয় গ্রামবাংলার লোকজ সংগীত, রাতে হয় যাত্রাপালা। ওই ছিটমহলের হাফিজার রহমান (৬৫) বলেন, ‘প্রায় ৭০ বছরের বন্দি জীবন থেকে আমরা মুক্তি পাচ্ছি। আর বেছে নিয়েছি বাংলাদেশি নাগরিকত্ব।’

বিকেলে উত্তর গোতামারী ছিটমহলে আয়োজন করা হয় হা-ডু-ডু, লাঠিখেলা ও ‘ছিট খেলার’। সন্ধ্যার পর অনুষ্ঠিত হয় জারিগান। এ রকম নানা ধরনের আয়োজন, আলোকসজ্জাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ছিটমহলগুলোতে। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির লালমনিরহাট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আজ আমাদের বিজয়ের দিন, স্বাধীনতার দিন। এই দিনটি পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর আমরা আন্দোলন করেছি।’ আনন্দের জোয়ার নীলফামারীর চার ছিটমহলে : আমাদের নীলফামারী প্রতিনিধি ভুবন রায় নিখিল জানান, গত রাত ১২টায় জেলার ডিমলা উপজেলায় ২৯ নম্বর বড়খানকি খারিজা গিদলাদহে মিজানুর রহমানের বাড়িতে ৬৮টি মোমবাতি জ্বালায় বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা। ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশের অংশ হওয়ার আনন্দে যোগ দিয়েছে নীলফামারীর চার ছিটমহলের নারী, শিশুসহ সবাই। ৩১ নম্বর জিগাবাড়ী ছিটমহলের আখতারুল ইসলাম (৫৫) বলেন, ‘অনেক ত্যাগের পর আমরা নাগরিক অধিকার ফিরে পাচ্ছি। দিনটি আমাদের জীবনে স্মরণীয়। আমরা দিনটিকে বিশেষ দিন হিসেবে উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি নিয়েছি।’

ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখতে আজ সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে। এরপর স্থানীয় নাগরিকদের আয়োজনে সেখানে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে।

ঘটনাপ্রবাহ : বাংলাদেশের অংশ হয়ে যাওয়া ভারতের ১১১টি ছিটমহলের (১৭১৬০.৬৩ একর) ১২টির অবস্থান কুড়িগ্রামে, ৫৯টি লালমনিরহাটে, চারটি নীলফামারীতে ও ৩৬টি পঞ্চগড়ে। অন্যদিকে ভারতের অংশ হয়ে যাওয়া ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহলের অবস্থান কোচবিহার জেলায়। এক দেশের মূল ভূখণ্ডের ভেতর অন্য দেশের ছোট ছোট ভূখণ্ড অত্যন্ত জটিল সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। ওই ছোট ছোট ভূখণ্ডের বাসিন্দারা ছিল কার্যত অবরুদ্ধ এবং নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ছিটমহল নামের ওই ছোট ছোট ভূখণ্ডের ওপর অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণও ছিল না।

গত ৬ ও ৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত মধ্যরাতে ছিটমহলগুলোর বিনিময় চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্বাক্ষরিত স্থল সীমান্ত চুক্তি এবং ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের উপস্থিতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা স্থল সীমান্ত চুক্তির প্রটোকল স্বাক্ষর করেন। সেগুলো বাস্তবায়নে ৬ জুন মোদির ঢাকা সফরে ইন্সট্রুমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়।

মোদির সফরের পর ছিটমহলগুলোর বাসিন্দাদের নাগরিকত্ব বাছাইকরণ প্রক্রিয়ায় অনেক কাজ হয়েছে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারীর জেলা প্রশাসক এবং ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেলের দপ্তর এবং কোচবিহারের জেলা প্রশাসক সমন্বিতভাবে নাগরিকত্ব বিষয়ে ছিটমহলবাসীর মতামত নিয়েছেন। গত ৬ থেকে ১৬ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের ৩০ জন পর্যবেক্ষকের উপস্থিতিতে ৭৫টি দল উভয় দেশের ছিটমহলে মতামত সংগ্রহের কাজ করেছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে অত্যন্ত জটিল এ সীমান্ত সমস্যার সফল সমাধানের ক্ষেত্রে গতকাল ৩১ জুলাই ছিল এক ঐতিহাসিক দিন। গত মধ্যরাত থেকে ছিটমহলগুলো বিলুপ্ত হয়ে নতুন দেশের অংশ হওয়ায় সেখানকার বাসিন্দারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা পাবে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য অচিরেই প্রকল্প : দীর্ঘ ৬৮ বছর পর ছিটমহল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে সমস্যা সমাধান হওয়ায় এর বাসিন্দাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাঁর অভিনন্দন বার্তায় ছিটমহল বিনিময়ের মুহূর্তকে ঐতিহাসিক হিসেবে অভিহিত করেন। সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানান। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ছিটমহলবাসী তাঁদের জাতিসত্তার স্বীকৃতি পাওয়ায় তাদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ৬৮ বছর পর তারা তাদের পরিচয়, নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসের সুযোগ এবং প্রিয় মাতৃভূমির জাতীয় পতাকা ও মানচিত্র পেয়েছে। বাংলাদেশের অন্য নাগরিকদের সঙ্গে তাদের কোনো পার্থক্য নেই। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে যে ধরনের প্রকল্প নেওয়া দরকার সরকার তার সব রকমের ব্যবস্থাই করবে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলবাসী গত মধ্যরাত থেকেই স্বাধীন দেশের নাগরিকের পূর্ণ মর্যাদা পাওয়ায় তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অভিনন্দন বার্তায় তিনি বলেন, ‘ছিটমহলবাসীদের বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা এখন থেকে এ দেশের নাগরিক। দেশের অন্য নাগরিকদের সঙ্গে তাদের কোনো পার্থক্য নেই। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে যে ধরনের প্রকল্প নেওয়া দরকার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় যেন সে ধরনের প্রকল্প হাতে নেয়।’

পরিকল্পনামন্ত্রী আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় প্রকল্প তৈরির কাজ অচিরেই হাতে নিতে যাচ্ছে। একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি এ কাজের প্রয়োজনীয় তদারকি করবে।