এ পি জে আবদুল কালামের জীবনের গল্পটা এককথায় সমতল থেকে শিখরে ওঠার। মাঝির কুঁড়েঘর থেকে তিনি পা রেখেছেন ভারতের মতো দেশের রাষ্ট্রপতি ভবনে। বিশ্বের শীর্ষ পদার্থবিজ্ঞানীদের তালিকায় যুক্ত করেছেন নিজের নাম। অকৃতদার এই মানুষটি এত নামযশের মধ্যেও কাটিয়েছেন সাধারণের জীবন। সব ছাপিয়ে শিক্ষক পরিচয়েই ছিলেন সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ; শিক্ষাদানকেই সবচেয়ে বেশি ভালো বেসেছেন তিনি। এসব কারণে ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি কালাম হয়ে ওঠেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষ; একজন অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব।
তবে কালামের বেড়ে ওঠার, বড় হওয়ার রাস্তাটা নেহাত সোজা ছিল না। পড়ালেখার ব্যয় মেটাতে পত্রিকার হকারিও করতে হয় তাঁকে বেশ কিছুদিন। সাত ভাইবোনের বড় সংসার। বাবা জয়নুল আবেদিনের সামান্য রোজগারে দিন আনি দিন খাই অবস্থা। তবু মা আশিয়াম্মা তাঁর ছোট ছেলেটির পড়ালেখার আগ্রহকে গরিবির কাছে পরাস্ত হতে দেননি। লেখাপড়া শিখেই যে ছেলে একদিন অনেক দূর যাবে, ঠিক জানতেন মা। স্বপ্ন দেখতেন, তাঁদের বাড়ির কাছেই যে বঙ্গোপসাগর, সেই সাগর ছাড়িয়ে যাবে তাঁর ছেলের নামডাক। মিছে হয়নি মায়ের স্বপ্ন।
স্কুল পাস করে কলেজে পড়ার জন্য একটা বৃত্তি পান কালাম। ভর্তি হন তিরুচিরাপল্লির সেন্ট জোসেফ কলেজে। ১৯৫৪ সালে সেখান থেকেই পদার্থবিদ্যায় স্নাতক। এরপর আবার স্কলারশিপ নিয়ে চেন্নাইয়ে। বিষয় অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং। তাঁর ক্লাসের প্রথম আটজনকে বিমানবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়। কালাম হয়েছিলেন নবম। তাই বিমানের চালক হয়ে ওঠা হয়নি তাঁর। অথচ কালামের স্বপ্নই ছিল যুদ্ধবিমান চালনার।
বিমানচালক হয়ে ওঠা হলো না। তবে নিজের অদম্য চেষ্টায় তিনি হয়ে উঠলেন ভারতের ‘মিসাইল ম্যান’। ১৯৯৮ সালে পোখরান বিস্ফোরণ পরীক্ষার অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। পড়ালেখার জন্য একবারই শুধু বিদেশে যান; ১৯৬৩-৬৪ সালে মার্কিন মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র নাসায়। যে বঙ্গোপসাগরের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখতেন মা, সেই সমুদ্রসৈকতেই একাধিক ক্ষেপণাস্ত্রের (‘অগ্নি’ ও ‘পৃথি্ব’) সফল উৎক্ষেপণ করেন ছেলে। রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে ছিলেন ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনে (আইএসআরও)। মহাকাশ ও পরমাণু গবেষণায় তাঁর অবদানের জন্য পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ ও ভারতরত্নে সম্মানিত হয়েছেন কালাম। এ ছাড়া দেশ-বিদেশে তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পান।
ছোটবেলা থেকে মুক্তমনা ছিলেন কালাম। প্রায়ই তাঁর মুখে শোনা যেত ক্লাসিক্যাল তামিল কবিতা। বলতে পারতেন গীতার অনেক শ্লোক। অথচ নিজে ছিলেন নিষ্ঠাবান মুসলমান। নামাজ আদায় করতেন নিয়মিত। কোরআন শরিফ পড়তেন।
২০০২ সালে ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন কালাম। রাষ্ট্রপতি ভবনে ছিলেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত। তাঁর সময়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের দরজা সর্বসাধারণ, বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। সবার কাছেই হয়ে ওঠেন ‘সব মানুষের রাষ্ট্রপতি’। সূত্র : দ্য হিন্দু, বিবিসি, এনডিটিভি।