পানি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে হাওরের মানুষ

খাদ্য সংকটে থাকা সর্বস্বান্ত হাওর পাড়ের মানুষের এখন নতুন উপদ্রব রোগবালাই। এখন পানিবাহিত নানা রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। হাওর তীরের কৃষি ও মৎস্যজীবী পরিবারগুলো আক্রান্ত হচ্ছে ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি, কাশি, আমাশয়, চর্মরোগ, কৃমি ও পেটব্যথাসহ বিভিন্ন রোগবালাইয়ে। ঘরে তিন বেলা দু’মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা যাদের নেই তাদের রোগ তাড়াতে ওষুধ কেনার সাধ্য কোথায়। তাই বলতে গেলে এখন নিত্যদিন রোগের সঙ্গে আপোষ করেই তাদের চলা। এ বছর চৈত্রের অকাল বন্যার পর এখন এমন স্বাস্থ্য অবস্থা হাওর তীরবর্তী গ্রামগুলোর কৃষি ও মৎস্যজীবীদের। টাকা নেই তাই শরীরও ভালো নেই। রোগ সারাতে মনোবল আর ধৈর্যই তাদের একমাত্র পুঁজি। মাঝে মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণায় অধৈর্য হলে রোগ সারাতে উপজেলা হাসপাতালে এলেও সেখানে মিলে না ডাক্তার কিংবা ওষুধ। আবার অনেক সময় ডাক্তার পাওয়া গেলেও তাদের রূঢ় আচরণে মনে হয় শরীরে রোগ থাকাই ভালো। গ্রাম থেকে এত দূরে গিয়েও যদি ডাক্তার পেলে ওষুধ না পাই; কিংবা ডাক্তারদের অবহেলার শিকার হতে হয় তাহলে ওখানে চিকিৎসা নিতে আসবো কেন। ক্ষোভে দুঃখে এমনটিই জানালেন হাওর তীরের ক্ষতিগ্রস্ত রোগাক্রান্ত কৃষি ও মৎস্যজীবীরা। জানা গেল, হাকালুকি হাওরের মৌলভীবাজার অংশের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা ৩টি উপজেলার মধ্যে ২টি উপজেলায় রয়েছে সরকারি হাসপাতাল। কিন্তু এই দুটি হাসপাতালেও রয়েছে ডাক্তার, ওষুধ ও লোকবলসহ নানা সমস্যা ও সংকট। আর যা আছে তারও সদ্ব্যবহার হচ্ছে না বলে ভুক্তভোগীদের তরফে রয়েছে নানা অভিযোগ। এ বছর হঠাৎ চৈত্র মাসে হাওর উত্তাল হয়ে সব গিলে খেয়েছে তীরের বাসিন্দাদের। ধানের পর মাছ। পোষা হাঁস, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ সবই। হাওর থেকে ভেসে আসা মরা পচা উৎকট গন্ধ এখনো নাকে লাগছে। এমন বিপর্যয় এর আগে কখনো দেখেনি তারা। হাওরে এ বিপর্যয়ের পর এখন জালে মাছ ধরা পড়ছে কম। এই মাছ বিক্রি করে জাল ভাড়াও উঠছে না। তাই ঘওে ঘরে যেমন খাদ্য নেই, তেমনি না থাকার তালিকায় আছে ওষুধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসও। তাই হাওরজুড়ে এখন শুধুই হাহাকার। হাকালুকি তীরবর্তী অধিকাংশ বাসিন্দার বসতভিটা ছাড়া নেই তেমন কৃষির জমিজমা। বোরো মৌসুমে অন্যের জমিতে বর্গা চাষ আর বছরজুড়ে হাওরে মাছ ধরাই তাদের কাজ। এ দুই কাজেই চলে তাদের জীবন জীবিকা। কিন্তু যে হাকালুকিকে ঘিরে তাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন আর এই জনবসতি, সেই হাকালুকিরই নেই সেই আগের অবস্থা। নাব্য হ্রাসে এখন দেশীয় প্রজাতির মাছ আর নানা দুর্লভ জীববৈচিত্র্যের অভায়াশ্রম হিসেবে পরিচিত এশিয়ার অন্যতম হাওর হাকালুকির ঐতিহ্য এখন ধ্বংসের দোরগোড়ায়। আর এরপর এ বছর অকাল বন্যায় সব সম্পদ হারিয়ে হাওর অনেকটা নিঃস্ব। হাকালুকির এমন বেহাল দশায় ভালো নেই হাওর তীরের জেলেপল্লীর জনগোষ্ঠী ও কৃষিজীবীরা। হাকালুকির দুরবস্থায় তাদের জীবন-জীবিকায়ও লেগেছে দৈন্যদশা। এমনিতে বছরের ৫ মাস কোনোরকমে মাছ ধরে সংসার চালালেও বাকি ৭ মাসই বেকার। এ বছর বোরো ধান পচে পানি দূষিত হয়ে মারা যায় মাছ। এ কারণেই তারা এখন পুরোপুরিই বেকার। এমন অভাব অনটনের মধ্যে দেখা দিয়েছে নানা অসুখ বিসুখ। সরজমিন দেখা গেল হাওর তীরের অধিকাংশ ঘরবাড়িতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের সুব্যবস্থা নেই বললেই চলে। দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত প্রতিটি শিশুই পুষ্টিহীনতায় জীর্ণশীর্ণ। এমন নানা কারণসহ এ বছর অকাল বন্যায় এখন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে হাকালুকি হাওর তীরের কৃষিজীবী ও জেলেপল্লীর বাসিন্দারা। জানা গেল এখন প্রতিনিয়তই তারা আক্রান্ত হচ্ছেন ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি, কাশি, আমাশয়, চর্মরোগ, কৃমি ও পেটব্যথাসহ বিভিন্ন রোগে। হাকালুকি তীরের কুলাউড়া উপজেলার ভূকশিমইল ইউনিয়নের সাদিপুরসহ কয়েকটি গ্রামে দেখা গেল এমন দৈন্যদশা। বিশেষ করে জেলেপল্লী হিসেবে পরিচিত সাদিপুর গ্রামের অনেকের রান্নাঘরের পাশে দেখা গেল স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ আর অস্বাস্থ্যকর খোলা পায়খানা। খোলা ড্রেন দিয়ে ময়লা আবর্জনা পুকুরগুলোতে এসে পড়ছে। আর ওই নোংরা পানিতেই হাত-পা ধোয়া, নিজেদের গোসল ছাড়াও গোসল সারাচ্ছেন গরু মহিষেরও। গৃহিণীরা গৃহস্থালির আসাবাবপত্র, কাপড়সহ বাসনপত্র আর খাবারের জিনিসপত্রও ধুচ্ছেন ওই পুকুরেই। স্যাঁতসেঁতে কর্দমাক্ত আর দুর্গন্ধময় পরিবেশ পুকুরজুড়ে। তারপরও পানির উৎস বা নিরাপদ পানি বলতেই তারা এ পুকুরটিকেই বেছে নিয়েছেন। কারণ, প্রায় শতাধিক পরিবারের বিশুদ্ধ পানির ভরসা একটি মাত্র টিউবওয়েল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, সবসময় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিউবওয়েলের পানি দিয়ে এতসব প্রয়োজনীয় কাজ সারা সম্ভব নয়। তাই ওই পুকুরই তাদের ব্যাপক পানির উৎস। জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অনেকটাই অসচেতন ওই এলাকার নারী পুরুষ। একই পরিবারে পাশাপাশি বয়সের রয়েছে ৬-৭টি শিশু সন্তান। অনেক পরিবারে ১০-১২ জন সদস্য আর হাঁস মুরগি ও ছাগলের জন্য ছোট একটি মাত্র বাঁশের বেড়ার জরাজীর্ণ ঘর। এখানে কোনোরকমে গাদাগাদি করে একসঙ্গে বসবাস তাদের। এখন বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন চর্মরোগ, হাম রুবেলা, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন রোগে। জানা যায়, সম্প্রতি হাম রুবেলায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় হাওর তীরের সাদিপুর গ্রামের কালা মিয়া ও লিজা বেগম দম্পতির ৯ মাসের মেয়ে রিমা আক্তার। জানা গেল, ওই এলাকায় এ রোগে আক্রান্ত ওই পরিবারের ৫ বছরের একটি মেয়ে শিশুসহ ও আশপাশের আরো ৬-৭টি শিশু। হাকালুকি হাওর পাড়ের কৃষি ও মৎস্যজীবীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে মৌলভীবাজার সিভিল সার্জন সত্যকাম চক্রবর্তী বলেন, হাওরাঞ্চল তুলনামূলকভাবে দুর্গম এলাকা হওয়ায় তারা উপজেলা হাসপাতালে এসে স্বাস্থ্যসেবা নিতে চান কম। তাছাড়া ওই এলাকার বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা অনেক কম। যে কারণে তারা বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন। তাছাড়া এ বছর অকাল বন্যায় বোরো ধান পচে হাওরের পানি দূষিত হওয়ায় পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা অবগত আছি। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের সচেতন করার পাশাপাশি সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর