ঢাকা ০৭:০০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বদলের স্বপ্ন অন্য দুই মালালারও

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৪৭:৫৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ মে ২০১৭
  • ৩২২ বার

মালালার সঙ্গে সে দিন একই বাসে ছিল তারা দু’জন। কায়নাত রিয়াজ ও শাজিয়া রমজান। রসায়ন পরীক্ষা দিয়ে ফিরছিল তিন বন্ধু। তালিবান জঙ্গিদের ছোঁড়া বুলেট এসে লাগে এক জনের হাতে, অন্য জনের কাঁধে। জ্ঞান হারানোর আগে কায়নাত দেখে, মাথায় গুলি লেগে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে মালালাও।

২০১২-র সেই হামলার পর গোটা জীবনটাই বদলে যায় মালালা ইউসুফজাইয়ের। রাতারাতি শিরোনামে উঠে আসে সোয়াতের মেয়ের নাম। পাকিস্তানের প্রত্যন্ত খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে নারী শিক্ষার প্রচারের মুখ ছিল আগেই। নোবেল শান্তি পুরস্কার ও রাষ্ট্রপুঞ্জের কনিষ্ঠতম শান্তির দূতের সম্মান তার খ্যাতির মুকুটে নতুন পালক জোড়ে। আর সেই খ্যাতির তলায় চাপা পড়ে যায় ‘মালালার দুই বন্ধু’ কায়নাত ও শাজিয়ার লড়াই।

যে লড়াই মালালার চেয়ে কোনও অংশে সহজ নয়। চিকিৎসার জন্য মালালাকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অন্য দিকে পেশোয়ারের সামরিক হাসপাতালে এক মাস চিকিৎসার পর সেরে ওঠে শাজিয়া। কিন্তু আতঙ্ক পিছু ছাড়েনি দুই বন্ধুর। কায়নাত জানায়, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে তার কানে আসে, প্রাণ ভয়ে চিৎকার করছে তার সহপাঠীরা। আহত পড়ুয়াদের নিয়ে বাস যায় স্থানীয় হাসপাতালে। মালালা আর শাজিয়াকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলেও আতঙ্কিত কায়নাত কাঁপতে কাঁপতে বাড়ির দিকে দৌড় দেয়। পৌঁছে মাত্র দুটো শব্দ বলতে পারে সে। ‘মালালা নেই’। দক্ষিণ ওয়েলসে বসে শাজিয়া বলছিল, ‘‘ওই ঘটনার পর আমি ঘুমোতে পারতাম না। যখনই চোখ বুজতাম, মনে হত ওরা আবার এসে আমায় গুলি করবে।’’

সে যাত্রায় প্রাণ বাঁচলেও সোয়াত উপত্যকায় থাকা কঠিন হয়ে পড়ে দুই কিশোরীর জন্য। তারাও জঙ্গিদের নজরে পড়ে যাবে, এই আতঙ্কে দু’টি পরিবারের সঙ্গে মেলামেশা কমিয়ে দেন পড়শিরা। তাদের তুলতে আপত্তি করতেন বাস-ট্যাক্সি চালকরাও। তত দিনে বার্মিংহামের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে সেরে উঠেছে মালালা। মাত্র ১৬ বছরের জন্মদিনে বক্তৃতা দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জে। নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তার মনোনয়নে রাজি গোটা বিশ্ব। ডাক আসছে তাবড় আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দক্ষিণ ওয়েলসের বিখ্যাত আবাসিক স্কুল আটলান্টিক কলেজ থেকেও ডাক পড়ে মালালার। নিজে তত দিনে বার্মিংহামে থিতু হলেও দুই বন্ধুর জন্য সুযোগটা লুফে নেয় মালালা। আটলান্টিক কলেজ থেকে স্কলারশিপ পেয়ে ২০১৩ সালে পাকিস্তান ছেড়ে ব্রিটেন পাড়ি দেয় শাজিয়া ও কায়নাত।

২০১৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সময় মালালা তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিল তার দুই বন্ধুর নাম। বলেছিল, ‘‘আমি একা নই। আমার সঙ্গে অনেকে আছে। আমি মালালা। আমিই শাজিয়া। আবার আমি কায়নাতও।’’ তিন বন্ধুর অনলাইনে কথা হয় এখনও। ঈদের সময় বার্মিংহামে দেখাও করে তারা।

এখন বছরে মাত্র দু’বার পাকিস্তানে যেতে পারে শাজিয়ারা। অভ্যাস বদলে অভ্যস্ত হয়েছে পাস্তা, পিৎজায়। আর লন্ডনের বিরিয়ানি? ‘‘ওরা ওদের মতো করে চেষ্টা করে আর কী’’, জবাব শাজিয়ার।

ওয়েলসের কলেজে সবাই তাদের চিনত ‘পাকিস্তানি যমজ বোন’ বলে। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগও পেয়েছে দু’জন। এ দেশে তারা শুধুই কায়নাত ও শাজিয়া। ‘মালালার বন্ধু’ নয়। ঊনিশের দুই কিশোরী এখন স্বাধীনতার মানে বোঝে। ‘‘এখন যদি কেউ বলে নেলপলিশ লাগিও না আমি পাল্টা প্রশ্ন করব— কেন লাগাব না?’’ মেরুন-রঙা নখ ঝলমলিয়ে বলে ওঠে কায়নাত। তবে এ-ও বোঝে, তারা এগিয়ে গেলেও, এগোতে পারেনি পাকিস্তান। সেখানে স্কুল না পেরোতেই বিয়ে হয়ে যায় তাদের বন্ধুদের। তাই কায়নাত বলে, ‘‘আমি আবার আমার দেশে ফিরে যেতে চাই। সে দেশটাও তো বদলাতে হবে!’’

সুত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

বদলের স্বপ্ন অন্য দুই মালালারও

আপডেট টাইম : ১১:৪৭:৫৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ মে ২০১৭

মালালার সঙ্গে সে দিন একই বাসে ছিল তারা দু’জন। কায়নাত রিয়াজ ও শাজিয়া রমজান। রসায়ন পরীক্ষা দিয়ে ফিরছিল তিন বন্ধু। তালিবান জঙ্গিদের ছোঁড়া বুলেট এসে লাগে এক জনের হাতে, অন্য জনের কাঁধে। জ্ঞান হারানোর আগে কায়নাত দেখে, মাথায় গুলি লেগে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে মালালাও।

২০১২-র সেই হামলার পর গোটা জীবনটাই বদলে যায় মালালা ইউসুফজাইয়ের। রাতারাতি শিরোনামে উঠে আসে সোয়াতের মেয়ের নাম। পাকিস্তানের প্রত্যন্ত খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে নারী শিক্ষার প্রচারের মুখ ছিল আগেই। নোবেল শান্তি পুরস্কার ও রাষ্ট্রপুঞ্জের কনিষ্ঠতম শান্তির দূতের সম্মান তার খ্যাতির মুকুটে নতুন পালক জোড়ে। আর সেই খ্যাতির তলায় চাপা পড়ে যায় ‘মালালার দুই বন্ধু’ কায়নাত ও শাজিয়ার লড়াই।

যে লড়াই মালালার চেয়ে কোনও অংশে সহজ নয়। চিকিৎসার জন্য মালালাকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অন্য দিকে পেশোয়ারের সামরিক হাসপাতালে এক মাস চিকিৎসার পর সেরে ওঠে শাজিয়া। কিন্তু আতঙ্ক পিছু ছাড়েনি দুই বন্ধুর। কায়নাত জানায়, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে তার কানে আসে, প্রাণ ভয়ে চিৎকার করছে তার সহপাঠীরা। আহত পড়ুয়াদের নিয়ে বাস যায় স্থানীয় হাসপাতালে। মালালা আর শাজিয়াকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলেও আতঙ্কিত কায়নাত কাঁপতে কাঁপতে বাড়ির দিকে দৌড় দেয়। পৌঁছে মাত্র দুটো শব্দ বলতে পারে সে। ‘মালালা নেই’। দক্ষিণ ওয়েলসে বসে শাজিয়া বলছিল, ‘‘ওই ঘটনার পর আমি ঘুমোতে পারতাম না। যখনই চোখ বুজতাম, মনে হত ওরা আবার এসে আমায় গুলি করবে।’’

সে যাত্রায় প্রাণ বাঁচলেও সোয়াত উপত্যকায় থাকা কঠিন হয়ে পড়ে দুই কিশোরীর জন্য। তারাও জঙ্গিদের নজরে পড়ে যাবে, এই আতঙ্কে দু’টি পরিবারের সঙ্গে মেলামেশা কমিয়ে দেন পড়শিরা। তাদের তুলতে আপত্তি করতেন বাস-ট্যাক্সি চালকরাও। তত দিনে বার্মিংহামের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে সেরে উঠেছে মালালা। মাত্র ১৬ বছরের জন্মদিনে বক্তৃতা দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জে। নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তার মনোনয়নে রাজি গোটা বিশ্ব। ডাক আসছে তাবড় আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দক্ষিণ ওয়েলসের বিখ্যাত আবাসিক স্কুল আটলান্টিক কলেজ থেকেও ডাক পড়ে মালালার। নিজে তত দিনে বার্মিংহামে থিতু হলেও দুই বন্ধুর জন্য সুযোগটা লুফে নেয় মালালা। আটলান্টিক কলেজ থেকে স্কলারশিপ পেয়ে ২০১৩ সালে পাকিস্তান ছেড়ে ব্রিটেন পাড়ি দেয় শাজিয়া ও কায়নাত।

২০১৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সময় মালালা তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিল তার দুই বন্ধুর নাম। বলেছিল, ‘‘আমি একা নই। আমার সঙ্গে অনেকে আছে। আমি মালালা। আমিই শাজিয়া। আবার আমি কায়নাতও।’’ তিন বন্ধুর অনলাইনে কথা হয় এখনও। ঈদের সময় বার্মিংহামে দেখাও করে তারা।

এখন বছরে মাত্র দু’বার পাকিস্তানে যেতে পারে শাজিয়ারা। অভ্যাস বদলে অভ্যস্ত হয়েছে পাস্তা, পিৎজায়। আর লন্ডনের বিরিয়ানি? ‘‘ওরা ওদের মতো করে চেষ্টা করে আর কী’’, জবাব শাজিয়ার।

ওয়েলসের কলেজে সবাই তাদের চিনত ‘পাকিস্তানি যমজ বোন’ বলে। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগও পেয়েছে দু’জন। এ দেশে তারা শুধুই কায়নাত ও শাজিয়া। ‘মালালার বন্ধু’ নয়। ঊনিশের দুই কিশোরী এখন স্বাধীনতার মানে বোঝে। ‘‘এখন যদি কেউ বলে নেলপলিশ লাগিও না আমি পাল্টা প্রশ্ন করব— কেন লাগাব না?’’ মেরুন-রঙা নখ ঝলমলিয়ে বলে ওঠে কায়নাত। তবে এ-ও বোঝে, তারা এগিয়ে গেলেও, এগোতে পারেনি পাকিস্তান। সেখানে স্কুল না পেরোতেই বিয়ে হয়ে যায় তাদের বন্ধুদের। তাই কায়নাত বলে, ‘‘আমি আবার আমার দেশে ফিরে যেতে চাই। সে দেশটাও তো বদলাতে হবে!’’

সুত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা