দলমত নির্বিশেষে সকলের প্রতি সকলকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘মানুষের চরম দুর্যোগ ও দুর্ভোগের সময়ে এ নিয়ে তারা মন্ত্রীসভার বৈঠকের পর হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠেন মর্মে যে সংবাদ প্রকাশিত হয় তাতেও আমরা দেশবাসীর সঙ্গে সমভাবে ব্যথিত হয়েছি। এত কিছুর পরেও বিলম্বে হলেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের খবরে সকলে কিছুটা আশান্বিত হয়েছিলেন। যে ভাবেই হয়ে থাকুন না কেন, তিনি এখন ক্ষমতার চেয়ারে আসীন। সেই হিসেবে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রধান দায়িত্ব মূলত তারই।’
খালেদা জিয়া বলেন, দেশবাসীর সঙ্গে আমরাও বিশ্বাস করি, হাওর অঞ্চলে যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য প্রাকৃতিক বিরূপতার পাশাপাশি ক্ষমতাসীনদের অপকর্ম, দুর্নীতি ও ব্যর্থতাও দায়ী। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সর্বোচ্চ সম্পর্ক স্থাপনের কথা প্রচার করা হয়। তা সত্ত্বেও পাহাড়ি ঢলের তথ্য যথাসময়ে কেন পাওয়া গেল না এবং সে অনুযায়ী হাওরবাসী ও সরকারি প্রশাসনকে কেন আগাম সতর্ক ও প্রস্তুত করা হল না, সে প্রশ্ন আজ সংগতভাবেই উঠেছে।’
তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা কেন একযোগে বিদেশ সফরে এবং এ ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা সরকারের কাছে দেশবাসী জানতে চায়। হাওর অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণে ক্ষমতাসীনদের সীমাহীন দুর্নীতির খবর বিপর্যয়ের বেশ আগে থেকেই প্রকাশিত হচ্ছিল। সকলের আশা ছিল ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগেই তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার বদলে শেখ হাসিনার বক্তৃতায় “প্রমাণ হলে ব্যবস্থা নেওয়ার” গতানুগতিক আশ্বাস মানুষকে হতাশ করেছে।’
রোববার সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় খালেদা জিয়া বলেন, ‘এত বড় দুর্যোগের পরেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরকারি উদ্যোগে দুর্গতের চিহ্নিতকরণ এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থা ও সংকীর্ণ দলীয়করণের অভিযোগ উঠছে। আমরা অনতিবিলম্বে এসবের প্রতিকার দাবি করছি এবং মানুষের দুর্গতি নিয়ে কোনো রকম রাজনীতি না করার আহ্বান জানাচ্ছি। হাওর অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন ও দুর্যোগ মোকাবিলায় বিপুল ব্যয়সাপেক্ষ গালভরা নামের যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল তা কেন বাস্তবায়িত হয়নি তা দেশবাসীকে জানানো উচিৎ।’
তিনি বলেন, ‘সকল দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা ও আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করে সেই পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। আমি দাবি করছি, নতুন ফসল না আসা পর্যন্ত হাওরের ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হোক। ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি কৃষিঋণের সুদ সম্পূর্ণ মওকুফ এবং সরকারি-বেসরকারি সকল প্রকার ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত করা হোক। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ ও বিনা সুদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেওয়া হোক। এক বছরের জন্য জলমহালের ইজারা বাতিল করে উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ স্থানীয় দরিদ্রদের দেওয়া হোক। ত্রাণ, পুনর্বাসন ও চিকিৎসার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। হাওরের শস্য, মৎস্য সম্পদ, গবাদিপশু ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর যে বিপুল হানি ঘটেছে তা আমাদের জন্য এক জাতীয় বিপর্যয়ের শামিল। এই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমি জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের মানুষের চরম দুর্দশা তার অন্তর স্পর্শ করবে, এই ধারণা থেকে আমাদেরও আশা ছিল, হাওর এলাকা পরিদর্শন শেষে তিনি হয়তো ওই এলাকাকে ‘দুর্গত অঞ্চল’ ঘোষণা করবেন। দু:খের বিষয়, সে আশা পূরণ হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় তার গতানুগতিক তৎপরতা দেখে ও বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে যে, তিনি পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করেননি, বা স্বীকার করতে চাননি। ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের স্বার্থ ও কল্যাণে হাওর অঞ্চলকে আগামী ছয় মাসের জন্য ‘দুর্গত অঞ্চল’ ঘোষণা এবং সেই মোতাবেক আন্তরিকভাবে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের হাওর অঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতিতে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। প্রতিবেশী দেশ থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট আগাম বন্যায় ব্যাপক শস্যহানিসহ গবাদি পশু, মাছ, জলজ প্রাণী এবং অন্যান্য সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতিতে সহায়-সম্বল হারিয়ে সেখানে এক অকল্পনীয় মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। রোগে-শোকে, খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে মানুষ এক অবর্ণনীয় দুর্দশায় জীবন কাটাচ্ছে। তাদের কষ্ট বর্ণনার অতীত।’
বিএনপি প্রধান বলেন, “বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি’র মহাসচিবের নেতৃত্বে সেখানে এক প্রতিনিধি দল পাঠাই। তারা সেখানে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাহস যুগিয়েছেন, ক্ষয়ক্ষতির অবস্থা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছেন। বিএনপি প্রতিনিধি দল হাওর অঞ্চলে বিপর্যয় ও ক্ষয়ক্ষতির যে ভয়াবহ চিত্র দেখেছেন তার আলোকেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাকে ‘দুর্গত অঞ্চল’ ঘোষণার আহ্বান জানাই। কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, মানবিক বিবেচনা থেকেই এ আহ্বান জানানো হয়েছিল। পরে অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন এবং স্থানীয় জনগণের পক্ষ থেকেও একই দাবি উত্থাপন করা হয়।”
তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যের বিষয় ক্ষমতাসীনেরা এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। আরো দু:খের বিষয় হচ্ছে, তাদেরকে তুষ্ট করার জন্য একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে বলেন যে, কোনো এলাকার অন্ততপক্ষে অর্ধেক সংখ্যক লোকের দুর্যোগে মৃত্যু না হলে সে এলাকাকে ‘দুর্গত অঞ্চল’ ঘোষণার নিয়ম নেই। আমরা আরো দু:খের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, প্রতিবেশী দেশের সীমান্তবর্তী খনি থেকে ইউরেনিয়াম মিশ্রিত পানির দূষণে জলজ প্রাণীর মৃত্যুর ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরকে খণ্ডন করাই একসময় ক্ষমতাসীনদের কাছে ত্রাণ তৎপরতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।