কয়রা হাওরের পাশে উচিতপুর মাঠে সারি দিয়ে আধা পাকা বোরো ধানের আঁটির স্তূপ। এ রকমই এক স্তূপের ওপর বসেছিলেন শহিদুর রহমান। কয়রা হাওর এলাকায় তিনি ছয় বিঘা জমিতে বি আর-২৯ জাতের বোরো চাষ করেছিলেন। আর সপ্তাহ দু-এক মাঠে থাকলে চালের দানা পুষ্ট হতো। কিন্তু তা হতে দিল না আচমকা বন্যা। অন্য অনেকের মতো তিনিও আধা পাকা ধান কেটে এনে মাঠে স্তূপ করে রেখেছেন।
শহিদুর ধানের ছড়া থেকে কয়েকটি ধান ছিঁড়ে নখ দিয়ে ভেঙে দেখালেন, ভেতরে চাল বেশ নরম; আঠালো। শুকালে এগুলো কালো হয়ে যাবে। সামান্য কিছু হয়তো থাকবে খাওয়ার উপযোগী আর খড়গুলো পাওয়া যাবে। বড়ই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তিনি সামনের দিনগুলো নিয়ে। সরকার ত্রাণ দিচ্ছে। কিন্তু তাঁর কোনো কার্ড নেই। তাই ত্রাণ পাননি।
নেত্রকোনা জেলার হাওর-অধ্যুষিত মদন উপজেলার উচিতপুরে গত মঙ্গলবার দুপুরে কথা হচ্ছিল শহিদুর রহমানের সঙ্গে। তাঁর মতো অনেকেই ত্রাণের কার্ড পাননি। ওএমএসের মাধ্যমে চাল বিক্রি শুরু হলে হয়তো অল্প দামে চাল কিনতে পারবেন। কিন্তু শুধু চাল হলেই তো সংসার চলবে না। আনুষঙ্গিক আরও অনেক খরচ আছে। গোখাদ্য না থাকায় কৃষকেরা বাধ্য হয়ে কম দামে গবাদিপশু বিক্রি করে দিচ্ছেন। এসব নিয়ে হাওর এলাকার বন্যাকবলিত মানুষেরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এ সময় তাদের মুখে হাসি থাকার কথা, কিন্তু বাস্তবে এখন তাঁদের মাথায় হাত।
২৫ এপ্রিল মঙ্গলবার থেকে নেত্রকোনার বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়েছে।
দুপুরে মদন উপজেলার উচিতপুরে দুর্গত মানুষের মধ্যে সরকারি ত্রাণ বিতরণ করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। প্রতি পরিবারকে ১৫ কেজি চাল ও নগদ ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়। এখানে তিন শ পরিবারকে এই ত্রাণ জরুরি ত্রাণ দেওয়া হয়।
বন্যাকবলিত লোকদের মন্ত্রী বলেন, খাবার নিয়ে তাঁদের কোনো দুশ্চিন্তা করতে হবে না। সরকারের গুদামে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য রয়েছে। জেলার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই আরও বড় আকারে ত্রাণ বিতরণ শুরু হবে। এই ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে আপাতত ১০ দিনের জন্য। মন্ত্রী মানবিক কারণে এনজিওগুলোকে আগামী এক বছর ঋণের কিস্তি ও সুদ আদায়ের কার্যক্রম স্থগিত রাখতে অনুরোধ করেন।
মদন উপজেলার কুলিয়াটি গ্রামের গোলাপ হোসেন জানালেন, তিনি রানিয়াতি হাওর এলাকায় ২০ কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। সব ডুবে গেছে। ত্রাণের জন্য স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাঁর নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তিনি ১৫ কেজি চাল ও ৫০০ টাকা পেয়েছেন।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, নেত্রকোনার দশ উপজেলা মধ্যে খালিয়াজুড়িতে ব্যাপক এবং কলমাকান্দা, মদন ও মোহনগঞ্জে আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এ বার জেলায় ১ লাখ ৮৪ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষা হয়েছিল। তার মধ্যে ৬৯ হাজার ৭১০ হেক্টরের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৮০ জন কৃষক। মাছের ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ১৮০ মেট্রিক টন। ক্ষতিগ্রস্ত জেলে পরিবার ১৬ হাজার ৫২৮।
বারহাট্টা উপজেলার চিরাম গ্রামের তাহেরা-মান্নান স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে প্রায় হাজার খানেক নানা বয়সের নর-নারী। খুব সকাল থেকেই তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন ত্রাণের জন্য। হাওরে আকস্মিক বন্যায় তাঁদের সবারই রোপা আমন ডুবে গেছে। মঙ্গলবার সকালে এখান থেকেই জেলায় আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি ত্রাণ বিতরণ শুরু করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী। এখানে ৩৩০ জনকে ১৫ কেজি করে চাল ও ৫০০ টাকা দেওয়া হয়।
বাহাদুরপুর গ্রামের সোনা মিয়া, নওগাঁয়ের আবদুল হাকিম, নিধিরাম গ্রামের খোদেজা বেওয়াসহ অনেকেই ত্রাণের কার্ড পাননি। তাঁরা দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থেকে হতাশ হয়ে ফিরে যান। বারহাট্টার রওশন আরা জানালেন, তাঁদের ১১ কাঠা জমির ফসল ডুবে গেছে। মতিয়ার রহমানের ফসল নষ্ট হয়েছে ২০ কাঠা জমির। তাঁদের দুজনেরই কার্ড ছিল। ত্রাণ পেয়েছেন। তারপরও এই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে বলে জানালেন।
বারহাট্টা থেকে মন্ত্রী আটপাড়া উপজেলার বানিয়াজান এলাকায় টেংরাম হাওরে সোনাইখালিতে দুর্গত ব্যক্তিদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন।
আটপাড়া উপজেলার মরাকান্দা হাওর এলাকার ফিরোজা বেগম জানালেন তাঁর দুটি ঘরই ভেসে গেছে। তাঁরা বাঁধের ওপরে আশ্রয় নিয়েছেন। গত মঙ্গলবারই প্রথম কোনো ত্রাণ সাহায্য পেলেন বলে জানালেন।
সেখান থেকে মন্ত্রী আসেন মদন উপজেলার উচিতপুরে। এখানে তিনি স্পিডবোটে কয়রা ও পাগলা হাওর এলাকায় দেখেন এবং উচিতপুর মাঠে মতবিনিময় সভায় বক্তৃতা করে ত্রাণ বিতরণ করেন।
এসব এলাকায় ত্রাণ নিতে আসা লোকেরা জানালেন, স্বাধীনতার পরে তাঁরা এমন অসময়ের বন্যা দেখেননি। মদনপুর উপজেলার তারাচাঁদপুর গ্রামের আবদুল গনি জানালেন, তাঁর দুটি গরু ছিল। একটি বিক্রি করে দিয়েছেন ৩০ হাজার টাকায়। অন্য সময় ন্যূনতম ৫০ হাজার টাকা এর দাম হতো। গবাদিপশুর খাবারের তীব্র সংকট। গোখাদ্য দিতে না পারায় লোকে অল্প দামে পশু বিক্রি করে দিচ্ছেন।
সর্বশেষ: নেত্রকোনা জেলা প্রতিনিধি পল্লব চক্রবর্তী জেলা প্রশাসন সূত্রের বরাত দিয়ে আজ রোববার জানান, জেলায় বরাদ্দ ত্রাণসামগ্রী এসেছে। এর মধ্যে সাধারণ রিলিফ হিসেবে চাল এসেছে ৩৯০ মেট্রিক টন। ভিজিএফ কার্ড দেওয়া হয়েছে ৫০ হাজার। কার্ডধারীরা প্রত্যেকে প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল ও ৫০০ টাকা পাবেন। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে ২০ হাজার বিশেষ কার্ড দেওয়া হয়েছে। এই কার্ডধারীরা ১০ টাকা কেজিতে চাল কিনতে পারবেন। এর বাইরে ওএমএসের মাধ্যমে ১৫ টাকা কেজিতে চাল বিক্রি করা হবে। আগামী ফসল না ওঠা পর্যন্ত এই ত্রাণ কার্যক্রম চলবে। আর নগদ টাকা বিতরণের জন্য সাত কোটি টাকা এসেছে। চাল বিতরণের জন্য জেলায় ৪২ জন ডিলার নিয়োগ করা হয়েছে।