ঢাকা ১২:৫৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:৪৫:২২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ এপ্রিল ২০১৭
  • ৩৭২ বার

ফসল হারিয়ে দিশাহারা হাওরবাসীর সামনে এখন নতুন শঙ্কা। ঘরে খাবার নেই। হাতে কাজ নেই। সামনের সময় কিভাবে কাটবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা তাদের চোখে-মুখে। নতুন ফসলের যখন উৎসব করার কথা তখন নতুন এই শঙ্কা নিয়ে দিন কাটছে হাওরের মানুষের। সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনাসহ তলিয়ে যাওয়া সব হাওর অঞ্চলের মানুষদের অনেকে এখন শহরমুখী। প্রায় সব ধানি জমি তলিয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে গবাদিপশুর খাদ্য সংকট। হাওর অঞ্চলে বোরো ফসল তোলার সময় কৃষক ছাড়াও প্রান্তিক শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হয়। নতুন ফসল ঘিরে চাঙা হয়ে উঠে ওই এলাকার অর্থনীতি। কৃষির আয় দিয়ে পরবর্তী এক বছর চলে মানুষের যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ফসলহানির ফলে হাওরের জীবনে এখন শুধুই হাহাকার। কৃষক পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পেলে হাওর অঞ্চলের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়তে পারে অনেক শিক্ষার্থী।
কাউয়াদিঘি হাওর এলাকায় ধানহারা কৃষকের কান্না
ইমাদ উদ দীন, কাউয়াদিঘি হাওর থেকে ফিরে জানান, হাকালুকি, কাউয়াদিঘি ও হাইল হাওর। একই অবস্থা মৌলভীবাজার জেলার তিনটি বড় হাওরপাড়ের অধিবাসীদের। স্বপ্নের বোরো ফসল হারিয়ে নির্বাক চাষিরা। পরিবারপরিজন নিয়ে খাওয়া-বাঁচার চিন্তায় চরম হতাশ। হাওরের তীরজুড়ে এখন শুধুই হাহাকার। কে কাকে দেবে সান্ত্বনা সবার যে একই পরিণতি। হঠাৎ এমন দুর্যোগে চাষি পরিবারগুলো দিশেহারা। কিন্তু জেলার ছোট-বড় অন্যান্য হাওরের মতো কাউয়াদিঘি হাওরের বোরো চাষিদের এমন দুর্ভোগে পড়ার কথা ছিল না। কারণ, কাওয়াদিঘি হাওরের জলাবদ্ধতা নিরসনে রয়েছে শত-কোটি টাকার প্রকল্প। বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা নিরসনে সেচ দিয়ে অপ্রয়োজনীয় পানি নিষ্কাশন। আর শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনীয় পানি সেচের মাধ্যমে সংগৃহীত করে চাষিদের সহযোগিতা করা। এজন্য হাওর তীরে রয়েছে ৯টি সেচ পাম্পের কাশিমপুর পাম্প হাউজ। কিন্তু নানা অজুহাতে প্রয়োজনে সময়ে সচল থাকে না বিশাল ব্যয়ের কৃষকের কল্যাণের এ পাম্প হাউজটি। তাই দুই মৌসুমেই এ পাম্প হাউস থেকে কোনো সুবিধাই পাচ্ছে না হাওরপাড়ের কৃষকরা। গতকাল সরজমিন রাজনগর উপজেলার কাওয়াদিঘি হাওর এলাকায় গেলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ক্ষোভের সঙ্গে এমনটিই জানান। চাষিরা বলেন, কৃষকদের কল্যাণে শত-কোটি টাকার প্রকল্প থাকার পরও প্রতি বছরই প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে আমাদের। এমনটি না হওয়ার জন্য সরকার প্রতি বছরই ওই প্রকল্প আর সেচপাম্পের জন্য লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে। কিন্তু কি কল্যাণ হচ্ছে কৃষকদের। অন্যান্য হাওরের মতো আমাদের হাওরের বোরো ফসল হারানোর কোনো কারণই ছিল না। কিন্তু সময়মতো কাশিমপুরের পাম্প হাউজটি সচল না থাকায় বোরো হারিয়ে আজ আমরা দিশেহারা। আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কাশিমপুর পাম্প হাউজ নিয়ে তাদের চরম উদাসীনতায় বোরো ফসল হারিয়ে আমরা আজ পথে বসেছি। এটা আমাদের নিয়তি নয়। এজন্য ওই কর্মকর্তাদের গাফিলতিই দায়ী। রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের জাহিদপুর গ্রামের বোরো চাষি আব্দুল মজিদ (৪৮), ফরজান মিয়া (৫০), দিলু মিয়া (৪৫), আহমদ মিয়া (৬০), শাহজান (৫৫), বিধানচন্দ্র দাস (৫৩)সহ অনেকেই ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন তারা প্রত্যেকেই ৩০ থেকে ৬ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। অনেকে চাষ দিয়েছেন নিজের জমি আর কেউ কেউ বর্গা নিয়ে। প্রচুর টাকা খরচ হলেও এক সেরও ধান ঘরে তুলতে পারেননি তারা। এমনকি এ ধানগুলো গরু মহিষের খাদ্যও হয়নি। এ বছর বোরো ফসলের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা থাকলেও অকাল বন্যায় এখন নিঃস্ব বোরো চাষিরা। তাই থামছে না হাওর পাড়ের কৃষকের কান্না। হাওরপাড়ে বসে বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখছেন আর ঢুকরে কাঁদছেন। এখন বছরজুড়ে নিজেদের খাদ্য ও গবাদিপশুর খাদ্য নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় চাষিরা। তাদের মতো একই অবস্থা কাউয়াদিঘি হাওরপাড়ের অন্য ১০টি ইউনিয়নের বোরো চাষিদের। কাউয়াদিঘি হাওর পাড়ের কৃষকরা জানালেন কৃষকের কল্যাণের জন্য যে প্রকল্পটি কাজ করার কথা সেখানে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় সে প্রকল্পটিই ক্ষতির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে আগে (বর্তমান মনু নদী প্রকল্পের আওতাধীন) ওই এলাকায় বন্যা, জলাবদ্ধতা ও খরায় কৃষকদের চাষকৃত ফসল ঘরে তুলা সম্ভব হতো না। প্রকল্প এলাকার অধিকাংশ কৃষি জমিই নিচু। এর মধ্যে ৪৮৫৮ হেক্টর কৃষি জমি অতি নিচু হাওর এলাকা হওয়ায় ৪ থেকে ৬ মিটার গভীর পানিতে ডুবে থাকে। অথচ ওই এলাকার প্রধান ফসলই ধান। কিন্তু আউশ, আমন, বোরো ও রবি শস্য জলাবদ্ধতা ও খরায় ব্যাহত হতো উৎপাদন। ওই এলাকায় ১১২০০ হেক্টরে দুটি, ৩৯০০ হেক্টরে একটি এবং ৪০ হেক্টরে তিনটি ফসল উৎপাদন হতো। ফসলের নিবিড়তা ছিল ১২৬ শতাংশ। তারা জানালেন, তাদের এলাকার চাষিরা মনু প্রকল্পের আগে প্রকৃতির খেয়ালের ওপরই কৃষি ব্যবস্থা ও চাষ পদ্ধতি নির্ধারণ করেছিল। অবহেলিত চাষিদের এমন দুর্দশা লাগবে কৃষক, কৃষিজমি ও ফসল রক্ষা ও উন্নয়নের স্বার্থে তৎকালীন সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হন। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ১৯৬২ সালের রিপোর্টের ভিত্তিতে এ প্রকল্পের বিস্তারিত রিপোর্ট ১৯৭২ সালে প্রণয়ন করা হয়। এর ভিত্তিতে প্রকল্পের নাম দেয়া হয় মনু প্রকল্প। প্রকল্পের নির্মাণকাজ ১৯৭৫-৭৬ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৮২-৮৩ সালে। সূত্রমতে মনু প্রকল্পের প্রকল্প এলাকা ২২,৬৭২ হেক্টর, কৃষিজমি মোট ১৯,২৭৮ হেক্টর, নিট ১৫,৫৪৬ হেক্টর, সেচ ব্যবস্থাধীন জমি ১১,৫৭৮ হেক্টর। বাঁধ ৫৯ কিলোমিটার। সেচ খাল ১০৫টি। ব্যারেজ ১টি, পাম্পিং প্যান্ট ১টি। নিষ্কাশন সাইফুন সুইস ৭টি, নিষ্কাশন সাইফুন ৯টি। অন্যান্য স্ট্রাকচার ৩০৯টি। তৎকালীন নির্মাণ ব্যয় ৬৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। আর এ প্রকল্পটির বার্ষিক পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হয় ১২১.৫০ লাখ টাকা। প্রথম দিকে চাষিরা এ প্রকল্পের সুফলতা পেলেও এখন বিপরীত চিত্র। এত বিশাল বাজেটের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও বার্ষিক পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় হওয়ার পরও এখন তা বর্ষা কিংবা শীত মৌসুমে ন্যূনতম উপকারে আসছে না কৃষকদের। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পর এর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বেহালদশায় সেচসহ এই প্রকল্পটির পুরো কার্যক্রম। জলাবদ্ধতা নিরসনে ফতেহপুর ইউনিয়নের কাশিমপুরে ৯টি সেচ পাম্পের মধ্যে ৮টি পাম্প স্থাপন হলেও এরমধ্যে ৪টিই পাম্প বিকল। আর যে ৪টি পাম্প ভালো সেগুলোও বছরজুড়ে নানা কারণে থাকে অচল। কৃষকরা জানালেন বর্ষা মৌসুমে নানা অজুহাতে সেচ না দিয়ে পাম্প বিকল রাখেন সংশ্লিষ্টরা। তখন সেচ না দেয়ায় অকাল বন্যায় তলিয়ে যায় বোরো ধান। আর শুকনো মৌসুমে পানির প্রয়োজনের সময় বিল মালিকদের সঙ্গে আঁতাত করে উৎকোচের বিনিময়ে সেচ দিয়ে মাছ ধরার সুযোগ করে দেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা। এতে করে তা দুই মৌসুমেই ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা জানালেন, এ বছর বোরো ধানের চাষ ভালো হওয়ায় তারা বাম্পার ফলনের আশা করেছিলেন। হঠাৎ থেমে থেমে ভারী বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে তাদের সব স্বপ্নই তলিয়ে গেছে পানিতে। তাদের অভিযোগ পাম্প হাউজ সচল থাকলে তাদের এমন সর্বনাশ হতো না। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলায় ১৭ হাজার ৪শ৩২ হেক্টর জমির বোরো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে কাউয়াদিঘি হাওর লগোয়া রাজনগর ও মৌলভীবাজার উপজেলায় বোরো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ৯শ হেক্টর। এর মধ্যে রাজনগর উপজেলায় ১৯৫০ ও সদর উপজেলায় ৯৫০ হেক্টর জমি। মনু প্রকল্প এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯৮৭ হেক্টর বোরো ফসলের জমি। হাওর পাড়ের বোরো চাষি ইসলামপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী (৬৫), সালিম মিয়া (৬০), কাশিমপুরের জমসেদ আলী (৫৬), করিম মিয়া (৫০), ইসলামপুরের রবিউল মিয়া, (৬২), কটু মিয়া (৬৫)সহ অনেকেই জানালেন এ পাম্প হাউজটিই তাদের জন্য অভিশাপ। কাশিমপুর পাম্প হাউজের শুরু থেকেই অপারেটর দায়িত্বে থাকা মতিউর রহমান বলেন, ৮টি পাম্পের মধ্যে ৫টি সচল। তবে দীর্ঘ দিন থেকে পাম্পগুলো সার্ভিসে থাকায় পাম্পগুলোর কর্মক্ষমতা অনেকটাই কমে গেছে। মনু প্রকল্প ও হাওর রক্ষা সমন্বয় পরিষদের সমন্বয়ক সরওয়ার আহমদ, আহ্বায়ক বকসি ইকবাল আহমদ ও সদস্যসচিব নকুল চন্দ্র দাশ জানান, দীর্ঘ দিন থেকে এ প্রকল্পের বেহাল দশায় এ অঞ্চলের কয়েক লাখ অসহায় কৃষিজীবী মানুষ নিঃস্ব হয়ে পথে বসার উপক্রম।
কিশোরগঞ্জের হাওরে ফসলহারা কৃষকের হাহাকার
আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ থেকে জানান, হাওরের ইটনা উপজেলার মৃগা ইউনিয়নের লাইমপাশা ভাটিরাজিবপুর গ্রামের কৃষক মো. মোতালিব মিয়া এবার ১৫ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। তার পুরো ফসলই পাানিতে তলিয়ে গেছে। ঘরে চাল না থাকায় তার ৬টি গরুর মধ্যে প্রায় দুই লাখ টাকা দামের ৪টি গরু মাত্র এক লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। এই টাকা দিয়েই এখন চলছে তার সংসার। একই অবস্থা লাইমপাশা গ্রামের সচ্ছল কৃষক মো. আক্কেল আলীর। প্রায় ১৫ একর জমির পুরোটাই হারিয়ে তিনি আজ নির্বাক। গোখাদ্যের অভাব আর সংসারের অভাবের কারণে ঘরে থাকা ৬টি গরুর সবকটিই বিক্রি করে দিয়েছেন। পার্শ্ববর্তী প্রজারকান্দা গ্রামের কৃষক আরশ আলী ১০ একর জমি থেকে এক আঁটি ধানও কাটতে পারেননি। সবই চলে গেছে সর্বনাশা বানের পানিতে। ঘরে থাকা ২টি গরুই বিক্রি করে অভাব সামাল দিচ্ছেন কোনভাবে। একই অবস্থা প্রজারকান্দা গ্রামের বড়ো গৃহস্থ মুল্লুক চাঁন মিয়ার। ২৫ একর জমির সবটা হারিয়ে এখন হাত দিয়েছেন ঘরে থাকা গরুর পালে। অভাবের তাড়নায় এরই মধ্যে ১৪টি গরুর মধ্যে ৭টি গরু বেচে দিয়েছেন তিনি। শ্রীরামপুর গ্রামের জয়নাল আবেদীন হাওরের ৮ একর জমি খুঁইয়ে বিক্রি করেছেন ঘরে থাকা একটি গরুও। শ্রীরামপুর গ্রামেরই সচ্ছল কৃষক আবদুল হাশিমের অবস্থা আরো শোচনীয়। ২০ একর জমি হারিয়ে একেবারে বোবা বনে গেছেন তিনি। ৩২টি গরুর বিশাল পাল থেকে বিক্রি করে দিয়েছেন ১৬টি গরু। কালীপুর গ্রামের গেদন হাজী আর মো. আবদুল হাশিম মেম্বার দু’জনেই ২০ একর করে জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। ফসল হারিয়ে তারাও পড়েছেন গভীর সংকটে। গেদন হাজীর গোয়ালে থাকা ৬টি আর মো. আবদুল হাশিম মেম্বারের গোয়ালে থাকা ২টি গরুই শেষ সম্বল হিসেবে বিক্রি করে দিয়ে তারা আজ নিঃস্বের কাতারে নাম লিখিয়েছেন। একইভাবে কাটিয়ারকান্দা গ্রামের অলি মিয়া ১২ একর জমির ধান হারিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন ৮টি গরুর সবক’টিই। লাইমপাশা মাদরাসা হাটি গ্রামের স্থানীয় পশু চিকিৎসক সেলিম শাহী জানান, মানুষ অভাবের তাড়নায় আর গোখাদ্যের অভাবে এলাকার সব গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন। পুরো এলাকা গরুশূন্য হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় তিনিও বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ জন্যে তিনি গাজীপুরে গিয়ে অন্যকিছু করার চেষ্টা করছেন বলেও সেলিম শাহী জানান। কেবল মৃগা ইউনিয়নের এই কয়েকটি গ্রামই নয় প্রকট দারিদ্রকে সঙ্গী করেই চলছে হাওরপাড়ের মানুষের জীবন। আগাম বন্যায় ফসলহানি কেড়ে নিয়েছে মানুষের মুখের হাসি। চরম দুঃসময় জেঁকে বসেছে কিশোরগঞ্জের হাওরপাড়ে। গ্রামে গ্রামে চলছে ফসলহারা মানুষের হাহাকার। নিত্য অভাব আর অর্থকষ্টে দুর্বিষহ হয়ে ওঠেছে হাওরবাসীর জীবন। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের সংস্থান করতে অনেকেই ছাড়ছেন হাওরের প্রিয় গৃহকোণ। আবার অনেকেই জলের দামে ঘরের গরু বিক্রি করে কিনছেন দুর্মুল্যের চাল। এ পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। মঙ্গলবার পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা হিসেবে ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং ৫৫০ টন চাল বিতরণ করার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস। বিকালে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জেলা প্রশাসক জানান, কিশোরগঞ্জে হাওর অঞ্চলের মোট ১ লাখ ২৯ হাজার ৩২৬ হেক্টর আবাদী জমির মধ্যে ৫৭ হাজার ৮৮৭ হেক্টর জমির বোরো ধান আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত জমি থেকে ২ লাখ ৪হাজার ৩৪১ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হতো যার আর্থিক মূল্য ৮১৭ কোটি ৩৬ লাখ চুয়াল্লিশ হাজার চারশ’ টাকা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯২ জন কৃষক। প্রেস ব্রিফিংয়ে জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস আরো জানান, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে অগ্রাধিকারভিত্তিতে ৫০ হাজার কৃষক পরিবারের প্রত্যেককে সহায়তা হিসেবে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল ও নগদ ৫শ’ টাকা দেয়া হবে। এ জন্যে তালিকা তৈরির কাজ চলছে। দু’য়েক দিনের মধ্যে তালিকা তৈরির কাজ শেষ হলে এসব বিতরণ করা শুরু হবে। এছাড়া ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলী এই চার উপজেলার প্রত্যেক ইউনিয়নে তিন জন করে ডিলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করবেন। জেলা প্রশাসনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোর মধ্যে ইটনা উপজেলায় ১৯ হাজার ৭৮০ হেক্টর, মিঠামইন উপজেলায় ১৪ হাজার ১১০ হেক্টর, অষ্টগ্রাম উপজেলায় ১৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর, নিকলীতে ৫ হাজার ৮১৫ হেক্টর, করিমগঞ্জে ৩ হাজার ৪০ হেক্টর, তাড়াইলে ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর, বাজিতপুরে ৫৫০ হেক্টর, ভৈরবে ৩০৫ হেক্টর হোসেনপুরে ১১০ ও কটিয়াদীতে ৬০০ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে স্থানীয় কৃষকেরা সরকারি এই হিসাব মানতে নারাজ। তাদের দাবি, সরকারি হিসেবের চেয়ে প্রকৃত ক্ষতি আরো অনেক বেশি হবে। ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলী, তাড়াইল ও করিমগঞ্জ এই ছয় উপজেলাতেই ক্ষতির পরিমাণ ৮০ হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে যাবে বলে তারা জানিয়েছেন। স্থানীয় কৃষকেরা জানান, জেলার ৯৩টি হাওরের সবকটিই এখন জলমগ্ন। এসব হাওরে অক্ষত বলতে এখন আর কোন জমি নেই। উজান এলাকার কয়েকটি হাওর ছাড়া সিংহভাগ হাওরেরই বোরো ফসল ঘরে তোলার অনুপযুক্ত। এর মধ্যে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার সবকটি হাওরই এখন পানির নিচে। এই তিন উপজেলার মোট ৬৮ হাজার ১৭৭ হেক্টর আবাদী জমির অন্তত ৫৫ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান পানির নিচে পঁচছে। জলমগ্ন কিছু হাওরের ফসল নৌকা আর দুর্মূল্যের শ্রমিক দিয়ে কাটার চেষ্টা করছেন কোন কোন এলাকার কৃষক। এ পরিস্থিতিতে তিন উপজেলার ৩২৫টি গ্রামের চার লক্ষাধিক মানুষের মুখের হাসি হারিয়ে গেছে। এসব এলাকার লক্ষাধিক কৃষক পরিবারের দিন কাটছে চরম অনিশ্চতায়।
কৃষকের স্বপ্নে সমাধি
তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ, জামালগঞ্জ (সুনামগঞ্জ) থেকে জানান, সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে বোরো ফসল ডুবির কারণে চারদিকে হাহাকার বিরাজ করছে। শনির হাওরের পর এবার পাকনা হাওরের ফসল ডুবার মধ্য দিয়ে সুনামগঞ্জের কৃষকের স্বপ্নে সমাধি হলো। জেলার সর্ব শেষ পাকনা হাওরের ১০ হাজার হেক্টর বোরো ফসলি জমিতে চাষাবাদ হয়েছিল। উরার বন্দ বাঁধ ভেঙে বিশাল হাওরের চারদিকে পানি থৈথৈ করছে। এছাড়া ওই হাওরে পানি প্রবেশ করায় পাকনা সংলগ্ন জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়ন ও ভিমখালী ইউনিয়নসহ প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর বোরো জমি পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে।
জীবন বাঁচানোর সম্পদ কষ্টে ফলানো বোরো ফসল চোখের সামনে তলিয়ে যাওয়ায় বানের পানি আর চোখের পানি একাকার হয়ে গেছে। কৃষক-কৃষাণীদের বুক ফাটা কান্নায় এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে পাকনা হাওর পাড়ের গ্রামগুলোতে। গত ক’দিন পূর্বে যেখানে ছিল সবুজের সমারোহ, এখন সেখানে রূপালী ঢেউ খেলা করছে। হাওরের উপরের অংশের আংশিক জমিতে অনেক কৃষক আধা পাকা ধান কোমর পানিতে নেমে কাটছে। পাকনা হাওরের ফেনারবাঁক গ্রামের কৃষক সাজিদুর রহমান বলেন, আধাপাকা ধান পানির নিচে গেল নীরব দর্শকের মতো দেখলাম কিছুই করতে পারলাম না, হায়রে আমরার পড়া কপাল। নবাব মিয়া বড় আক্ষেপ করে বলেন, হাজার হাজার মানুষ লইয়া কাজ কইয়াও শেষ রক্ষা হয় নাই। আমরার কি অবস্থা অইবো আল্লাই জানে। “বৈশাখ মাসে এত ফানি জীবনে দেহিনাই, চোখের সামনে কাঁচা-আধাপাকা ধান ফানির নিচে গেছে। কিছু ধান পাকা ভাব ক্ষেতে এহন মাত্র ধান বাহির হইছিল, দেনা কইরা জমি (কৃষিজমি) করছিলাম, দেনাই দিমু কেমনে আর কি কইরা বউ-বাচ্চা নিয়া সারা বছর চলমু এই চিন্তায় জীবন শেষ”। স্থানীয় কৃষকরা জানান, চৈত্রের মাঝামাঝি যখন হাওরের বাঁধের অবস্থা খারাপ খবর পেয়েছেন তখন থেকেই গ্রামে গ্রামে মাইকিং করে বাঁধে হাজার হাজার মানুষ স্বেচ্ছায় মাটি কাটার কাজ করেছেন। এ সময় পাউবোর কোনো কর্মকর্তা কর্মচারীকে বাঁধে দেখেননি। তারা আরো অভিযোগ করেন কোটি কোটি টাকা লুটপাট আর দুর্নীতি করে বাঁধের কাজ ঠিকমতো করেননি। সব হারিয়ে কৃষকরা এখন কোমর পানি বুক পানিতে নেমে কাঁচা ধান কাটছেন। তবে স্থানীয় কৃষি বিভাগের তথ্য মতে জামালগঞ্জ উপজেলায় ৮০ ভাগ বোরো ফসল পানির নিচে ডুবে গেছে বললেও বেসরকারি মতে ৯০ ভাগ ফসল তলিয়ে গেছে বলে কৃষকরা ধারণা করছেন। চৈত্রের শেষ দিকে অতিবর্ষণে প্রথম দফায় পানিতে তলিয়ে গেছে হাজার-হাজার হেক্টর বোরো জমি। আংশিক জমি ভাসমান থাকলেও এবার বাঁধ ভাঙার কারণে এগুলোও পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। বছরের একটি মাত্র বোরো ফসল বৈশাখে কাটা ও মাড়াই শুরু হয় এই অঞ্চলে। এবার হাওরের ফসল ডুবে কৃষকদের স্বপ্ন ও মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। হাজার হাজার কৃষকের কান্নায় হাওর এলাকার আকাশ এখন ভারি হয়ে উঠেছে।
জগন্নাথপুরের মাছ বাজারে হাহাকার
জগন্নাথপুর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে ফসলহানির পর মাছে মড়ক দেখা দেয়ায় মাছ বাজারে হাহাকার চলছে। ১৭ই এপ্রিল উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাসে আক্রান্ত মাছ না খাওয়ার জন্য এলাকায় মাইকিং করা হয়। এরপর থেকেই ভয়ে হাওরের মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন এলাকাবাসী। গতকাল উপজেলা সদরের মাছ বাজার ঘুরে দেখা যায়, স্থানীয় প্রজাতির কোনো মাছ নেই। কিছু ইলিশ মাছ ও ঝাটকা উঠেছে। তবে ফিশারির মাছ বেশি পরিমাণে দেখা গেছে বাজারে। উপায় না পেয়ে কেউ কেউ ফিশারির মাছ ক্রয় করছেন। তাও আবার বেশি দামে। স্থানীয় জাতের মাছের সংকট দেখা দেয়ায় দাম বেড়ে গেল ফিশারির মাছের।
বিক্রেতারা জানান, গ্রীষ্মের শুরু এমনিতেই মাছের সরবরাহ থাকে কম। এর মধ্যে মড়ক শুরু হওয়ায় বাজারে সংকট দেখা দিয়েছে। ক্রেতারাও মাছ কেনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
জগন্নাথপুর বাজারের মাছ বিক্রেতা জয়নাল আবেদন জানান, জগন্নাথপুরের হাওরগুলোতে মাছে মড়ক দেখা দেয়ার পর থেকে স্থানীয় জাতের কোনো মাছ বিক্রি হচ্ছে না। মাছে মড়ক আসার পূর্বে আমি স্থানীয় প্রজাতির মাছ বিক্রি করতাম। কিন্তু হাওরের মাছ কেউ ক্রয় করে না এখন। তাই গত দুই তিন দিন ধরে সিলেট থেকে ইলিশ মাছ এনে বিক্রি করছি।
পৌরশহরের ইকড়ছই এলাকার বাসিন্দা আবদুস সালাম জানান, দেশীয় জাতের মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। গত ৮ দিন ধরে মাছ খাচ্ছি না। আরেক বাসিন্দা মুজিবুর রহমান জানান, মাছে মড়ক আসার পর থেকেই মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। গতকল ফিশারির মাছ খেয়েছি। গত এক সপ্তাহ ধরে তাদের পরিবারের কেউ স্থানীয় প্রজাতির মাছ খাচ্ছে না।
উপজেলাবাসী জানান, ১লা এপ্রিল অকালবন্যা ও অতিবৃষ্টিতে উপজেলার বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ায় পর পানির নিচে থাকা ধানগাছ পচে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এতে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গত ১৬ই এপ্রিল হাওরের মাছগুলো মরে পানিতে ভেসে ওঠে। ব্যাপকহারে উপজেলার বিভিন্ন হাওর, নদী, জলাশয়ে মাছ মরে পচে যাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে উপজেলা প্রশাসন এসব মাছ না খাওয়ার জন্য উপজেলাবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে মাইকিং করেন। জগন্নাথপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ওয়াহিদুল আবরার জানান, জগন্নাথপুরের হাওরের পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস কমে গেছে। পানিতে অক্সিজেন বাড়ছে। বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত মরা মাছ খাওয়া যাবে না। তবে সুস্থ মাছ খাওয়া যাবে।
জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সামসুদ্দিন জানান, হাওরের অ্যামোনিয়া গ্যাসে আক্রান্ত মাছ খেলে পেটে পীড়া ও ডায়রিয়া রোগ হতে পারে। বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত মাছ খেয়ে এখনো কেউ অসুস্থ হয়নি।
দীর্ঘ হচ্ছে কৃষকের হাহাকার
কটিয়াদীতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার করগাঁও, চান্দপুর ও সহশ্রাদ ধূলদিয়া ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল উজানের পানিতে তলিয়ে গেছে। তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান এখন পানির নিচে। ঘরে তুলতে পারছে না তাদের একমাত্র বোরো ফসল। ফলে দীর্ঘ হচ্ছে কৃষকের হাহাকার।
জানা যায়, বোরো মৌসুমে বড় হাওরের দ্বার হিসেবে পরিচিত করগাঁও, ধূলদিয়া ও চান্দপুরের নিম্নাঞ্চলের একমাত্র ফসল বোরো ধান। বছরে মাত্র একটি ফসল ফলে থাকে এই এলাকায়। এই ফসলেই কৃষকের সারা বছরের খাদ্য মজুত করে উদ্বৃত্ত ধান বিক্রি করে সংসারের সমস্ত খরচ মিটিয়ে থাকেন। উজানের পানিতে হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসলহানির ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এলাকার কৃষক। আধাপাকা-কাঁচা ধান কোনো রকম কাটার উপযোগী মনে করলেই ধান ঘরে তুলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না শ্রমিকের স্বল্পতা, অধিক মজুরি আর জোঁকের প্রাদুর্ভাবে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, করগাঁও ইউনিয়নে এবার ১ হাজার ৬৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। গত কয়েক দিনের উজানের পানিতে ৪শ’ হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এরমধ্যে ১৮০ হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণরূপে এবং ২২০ হেক্টর জমির ধান আংশিক তলিয়ে গেছে।
ধূলদিয়া ইউনিয়নে ১ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। এরমধ্যে ২শ’ হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এরমধ্যে ৭০ হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণরূপে এবং ১৩০ হেক্টর জমির ধান ডুবন্ত অবস্থায় আছে। অবস্থার উন্নতি না হলে এর সবগুলোই ডুবে যাবে।
চান্দপুর ইউনিয়নের ১হাজার ৬৮০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়। এরমধ্যে ১০ হেক্টর জমির ধান ডুবন্ত অবস্থায় আছে। কৃষি অফিস সূত্রে ৬১০ হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বললেও বাস্তবে এ ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার হেক্টরের বেশি হবে বলে স্থানীয় চেয়ারম্যান এবং এলাকাবাসী জানায়।
চান্দপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাহতাব উদ্দিন বলেন, একদিকে শ্রমিকের দাম বেশি অন্য দিকে জোঁকের প্রাদুর্ভাব প্রচণ্ড। ফলে যে সকল জমির ধান কাটার সুযোগ আছে সেগুলোও শ্রমিকের দাম এবং রক্তচুষা জোঁকের কারণে ধান কাটতে পারছে না কৃষক। কিশোরগঞ্জ-২, কটিয়াদী পাকুন্দিয়া আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট সোহরাব উদ্দন, উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল ওয়াহাব আইন উদ্দিন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা উজানের পানিতে তলিয়ে যাওয়া জমির ফসল পরিদর্শন করেন।
দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের সব বিভাগ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে: অতিরিক্ত সচিব
তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সাংবাদিকদের সব পরামর্শই জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকার বাস্তবায়ন করবে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত জেলাবাসীকে আশ্বস্থ করতে চাই যে, তাদের সব প্রয়োজনে সরকার সবসময় পাশে আছে এবং থাকবে। জেলা প্রশাসনের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে সরকারের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সব বিভাগ ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজ করবে। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা প্রদান নিয়ে সংবাদ সম্মেলন ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে সোমবার রাতে ও মঙ্গলবার সকালে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে ওই সংবাদ সম্মেলন ও মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য এসব কথা বলেন, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও সাবেক জেলা প্রশাসক মো. ফয়জুর রহমান। সভায় লিখিত বক্তব্যে জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টির কারণে আকস্মিক বন্যায় সুনামগঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারকে সহায়তার জন্য ইতিমধ্যে ১০০০ মে.টন জিআর চাল এবং ৪৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা জিআর ক্যাশ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় পরিবার প্রতি ৩০ কেজি হারে ২৩শে এপ্রিল হতে জেলার ১১টি উপজেলা ও ৪টি পৌরসভায় মোট দেড় লাখ কার্ডের মাধ্যমে বন্যাক্রান্ত, অন্যান্য দুর্যোগাক্রান্ত, দুস্থ, অতিদরিদ্র ব্যক্তি ও পরিবারের মধ্যে বিতরণের জন্য মেয়র ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের উপ-বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ইতিমধ্যে ১৫৫ বান্ডেল ঢেউটিন ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণের পর ৭০ মে.টন. জিআর চাল, ৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা ক্যাশ ও ৩০ বান্ডেল ডেউটিন মজুদ রয়েছে। সর্বশেষ ৩০ কেজি হারে আগামী তিন মাস ৮ দিনের জন্য দেড় লাখ কার্ডের মাধ্যমে ভিজিএফ সাহায্য হিসেবে ১৪ হাজার ৭ শত মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। স্থানীয়ভাবে সুনামগঞ্জে ৭ হাজার মে.টন চাল মজুদ রয়েছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়। সভায় উপস্থিত সাংবাদিকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, দৈনিক সুনামকণ্ঠ সম্পাদক বিজন সেন রায়, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি আল-হেলাল, যুগান্তর প্রতিনিধি মাহবুবুর রহমান পীর, দৈনিক সুনামগঞ্জের সময় পত্রিকার সম্পাদক সেলিম আহমেদ, বাংলাভিশন টিভির জেলা প্রতিনিধি মাছুম হেলালসহ স্থানীয় সাংবাদিকবৃন্দ। সভায় সাংবাদিকেরা বলেন, যে জনপ্রতিনিধিরা পিআইসির সভাপতি সেজে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজে ব্যাপক লুটতরাজ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সরকারি বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করেছেন আর তাদের নিয়ে নয় বরং জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণে পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করা হোক। এছাড়া হাওরের সুনামগঞ্জের প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে সরকারের সব বরাদ্দ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রদান করা হউক। যেহেতু শতকরা ৯০ ভাগ কৃষকই ফসল হারিয়েছেন সেহেতু জেলার ৩ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসনের আওতায় আনতে হবে। ১৫ টাকা কেজি দরে ওএমএসের চাল ও ১০ টাকা কেজি মূল্যের খাদ্যবান্ধব এ চাল বিক্রয় কর্মসূচিকে জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে ওয়ার্ডভিত্তিক ডিলার নিয়োগের পরামর্শ দেন সাংবাদিকরা। এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. সফিউল আলম, এনডিসি মোহাম্মদ নাহিদ হাসান খান, জেলা প্রশাসকের স্টাফ অফিসার মোহাম্মদ আমিনুল এহসান খানসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

হাওরে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা

আপডেট টাইম : ১০:৪৫:২২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ এপ্রিল ২০১৭

ফসল হারিয়ে দিশাহারা হাওরবাসীর সামনে এখন নতুন শঙ্কা। ঘরে খাবার নেই। হাতে কাজ নেই। সামনের সময় কিভাবে কাটবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা তাদের চোখে-মুখে। নতুন ফসলের যখন উৎসব করার কথা তখন নতুন এই শঙ্কা নিয়ে দিন কাটছে হাওরের মানুষের। সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনাসহ তলিয়ে যাওয়া সব হাওর অঞ্চলের মানুষদের অনেকে এখন শহরমুখী। প্রায় সব ধানি জমি তলিয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে গবাদিপশুর খাদ্য সংকট। হাওর অঞ্চলে বোরো ফসল তোলার সময় কৃষক ছাড়াও প্রান্তিক শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হয়। নতুন ফসল ঘিরে চাঙা হয়ে উঠে ওই এলাকার অর্থনীতি। কৃষির আয় দিয়ে পরবর্তী এক বছর চলে মানুষের যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ফসলহানির ফলে হাওরের জীবনে এখন শুধুই হাহাকার। কৃষক পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পেলে হাওর অঞ্চলের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়তে পারে অনেক শিক্ষার্থী।
কাউয়াদিঘি হাওর এলাকায় ধানহারা কৃষকের কান্না
ইমাদ উদ দীন, কাউয়াদিঘি হাওর থেকে ফিরে জানান, হাকালুকি, কাউয়াদিঘি ও হাইল হাওর। একই অবস্থা মৌলভীবাজার জেলার তিনটি বড় হাওরপাড়ের অধিবাসীদের। স্বপ্নের বোরো ফসল হারিয়ে নির্বাক চাষিরা। পরিবারপরিজন নিয়ে খাওয়া-বাঁচার চিন্তায় চরম হতাশ। হাওরের তীরজুড়ে এখন শুধুই হাহাকার। কে কাকে দেবে সান্ত্বনা সবার যে একই পরিণতি। হঠাৎ এমন দুর্যোগে চাষি পরিবারগুলো দিশেহারা। কিন্তু জেলার ছোট-বড় অন্যান্য হাওরের মতো কাউয়াদিঘি হাওরের বোরো চাষিদের এমন দুর্ভোগে পড়ার কথা ছিল না। কারণ, কাওয়াদিঘি হাওরের জলাবদ্ধতা নিরসনে রয়েছে শত-কোটি টাকার প্রকল্প। বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা নিরসনে সেচ দিয়ে অপ্রয়োজনীয় পানি নিষ্কাশন। আর শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনীয় পানি সেচের মাধ্যমে সংগৃহীত করে চাষিদের সহযোগিতা করা। এজন্য হাওর তীরে রয়েছে ৯টি সেচ পাম্পের কাশিমপুর পাম্প হাউজ। কিন্তু নানা অজুহাতে প্রয়োজনে সময়ে সচল থাকে না বিশাল ব্যয়ের কৃষকের কল্যাণের এ পাম্প হাউজটি। তাই দুই মৌসুমেই এ পাম্প হাউস থেকে কোনো সুবিধাই পাচ্ছে না হাওরপাড়ের কৃষকরা। গতকাল সরজমিন রাজনগর উপজেলার কাওয়াদিঘি হাওর এলাকায় গেলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ক্ষোভের সঙ্গে এমনটিই জানান। চাষিরা বলেন, কৃষকদের কল্যাণে শত-কোটি টাকার প্রকল্প থাকার পরও প্রতি বছরই প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে আমাদের। এমনটি না হওয়ার জন্য সরকার প্রতি বছরই ওই প্রকল্প আর সেচপাম্পের জন্য লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে। কিন্তু কি কল্যাণ হচ্ছে কৃষকদের। অন্যান্য হাওরের মতো আমাদের হাওরের বোরো ফসল হারানোর কোনো কারণই ছিল না। কিন্তু সময়মতো কাশিমপুরের পাম্প হাউজটি সচল না থাকায় বোরো হারিয়ে আজ আমরা দিশেহারা। আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কাশিমপুর পাম্প হাউজ নিয়ে তাদের চরম উদাসীনতায় বোরো ফসল হারিয়ে আমরা আজ পথে বসেছি। এটা আমাদের নিয়তি নয়। এজন্য ওই কর্মকর্তাদের গাফিলতিই দায়ী। রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের জাহিদপুর গ্রামের বোরো চাষি আব্দুল মজিদ (৪৮), ফরজান মিয়া (৫০), দিলু মিয়া (৪৫), আহমদ মিয়া (৬০), শাহজান (৫৫), বিধানচন্দ্র দাস (৫৩)সহ অনেকেই ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন তারা প্রত্যেকেই ৩০ থেকে ৬ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। অনেকে চাষ দিয়েছেন নিজের জমি আর কেউ কেউ বর্গা নিয়ে। প্রচুর টাকা খরচ হলেও এক সেরও ধান ঘরে তুলতে পারেননি তারা। এমনকি এ ধানগুলো গরু মহিষের খাদ্যও হয়নি। এ বছর বোরো ফসলের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা থাকলেও অকাল বন্যায় এখন নিঃস্ব বোরো চাষিরা। তাই থামছে না হাওর পাড়ের কৃষকের কান্না। হাওরপাড়ে বসে বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখছেন আর ঢুকরে কাঁদছেন। এখন বছরজুড়ে নিজেদের খাদ্য ও গবাদিপশুর খাদ্য নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় চাষিরা। তাদের মতো একই অবস্থা কাউয়াদিঘি হাওরপাড়ের অন্য ১০টি ইউনিয়নের বোরো চাষিদের। কাউয়াদিঘি হাওর পাড়ের কৃষকরা জানালেন কৃষকের কল্যাণের জন্য যে প্রকল্পটি কাজ করার কথা সেখানে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় সে প্রকল্পটিই ক্ষতির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে আগে (বর্তমান মনু নদী প্রকল্পের আওতাধীন) ওই এলাকায় বন্যা, জলাবদ্ধতা ও খরায় কৃষকদের চাষকৃত ফসল ঘরে তুলা সম্ভব হতো না। প্রকল্প এলাকার অধিকাংশ কৃষি জমিই নিচু। এর মধ্যে ৪৮৫৮ হেক্টর কৃষি জমি অতি নিচু হাওর এলাকা হওয়ায় ৪ থেকে ৬ মিটার গভীর পানিতে ডুবে থাকে। অথচ ওই এলাকার প্রধান ফসলই ধান। কিন্তু আউশ, আমন, বোরো ও রবি শস্য জলাবদ্ধতা ও খরায় ব্যাহত হতো উৎপাদন। ওই এলাকায় ১১২০০ হেক্টরে দুটি, ৩৯০০ হেক্টরে একটি এবং ৪০ হেক্টরে তিনটি ফসল উৎপাদন হতো। ফসলের নিবিড়তা ছিল ১২৬ শতাংশ। তারা জানালেন, তাদের এলাকার চাষিরা মনু প্রকল্পের আগে প্রকৃতির খেয়ালের ওপরই কৃষি ব্যবস্থা ও চাষ পদ্ধতি নির্ধারণ করেছিল। অবহেলিত চাষিদের এমন দুর্দশা লাগবে কৃষক, কৃষিজমি ও ফসল রক্ষা ও উন্নয়নের স্বার্থে তৎকালীন সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হন। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ১৯৬২ সালের রিপোর্টের ভিত্তিতে এ প্রকল্পের বিস্তারিত রিপোর্ট ১৯৭২ সালে প্রণয়ন করা হয়। এর ভিত্তিতে প্রকল্পের নাম দেয়া হয় মনু প্রকল্প। প্রকল্পের নির্মাণকাজ ১৯৭৫-৭৬ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৮২-৮৩ সালে। সূত্রমতে মনু প্রকল্পের প্রকল্প এলাকা ২২,৬৭২ হেক্টর, কৃষিজমি মোট ১৯,২৭৮ হেক্টর, নিট ১৫,৫৪৬ হেক্টর, সেচ ব্যবস্থাধীন জমি ১১,৫৭৮ হেক্টর। বাঁধ ৫৯ কিলোমিটার। সেচ খাল ১০৫টি। ব্যারেজ ১টি, পাম্পিং প্যান্ট ১টি। নিষ্কাশন সাইফুন সুইস ৭টি, নিষ্কাশন সাইফুন ৯টি। অন্যান্য স্ট্রাকচার ৩০৯টি। তৎকালীন নির্মাণ ব্যয় ৬৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। আর এ প্রকল্পটির বার্ষিক পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হয় ১২১.৫০ লাখ টাকা। প্রথম দিকে চাষিরা এ প্রকল্পের সুফলতা পেলেও এখন বিপরীত চিত্র। এত বিশাল বাজেটের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও বার্ষিক পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় হওয়ার পরও এখন তা বর্ষা কিংবা শীত মৌসুমে ন্যূনতম উপকারে আসছে না কৃষকদের। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পর এর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বেহালদশায় সেচসহ এই প্রকল্পটির পুরো কার্যক্রম। জলাবদ্ধতা নিরসনে ফতেহপুর ইউনিয়নের কাশিমপুরে ৯টি সেচ পাম্পের মধ্যে ৮টি পাম্প স্থাপন হলেও এরমধ্যে ৪টিই পাম্প বিকল। আর যে ৪টি পাম্প ভালো সেগুলোও বছরজুড়ে নানা কারণে থাকে অচল। কৃষকরা জানালেন বর্ষা মৌসুমে নানা অজুহাতে সেচ না দিয়ে পাম্প বিকল রাখেন সংশ্লিষ্টরা। তখন সেচ না দেয়ায় অকাল বন্যায় তলিয়ে যায় বোরো ধান। আর শুকনো মৌসুমে পানির প্রয়োজনের সময় বিল মালিকদের সঙ্গে আঁতাত করে উৎকোচের বিনিময়ে সেচ দিয়ে মাছ ধরার সুযোগ করে দেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা। এতে করে তা দুই মৌসুমেই ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা জানালেন, এ বছর বোরো ধানের চাষ ভালো হওয়ায় তারা বাম্পার ফলনের আশা করেছিলেন। হঠাৎ থেমে থেমে ভারী বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে তাদের সব স্বপ্নই তলিয়ে গেছে পানিতে। তাদের অভিযোগ পাম্প হাউজ সচল থাকলে তাদের এমন সর্বনাশ হতো না। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলায় ১৭ হাজার ৪শ৩২ হেক্টর জমির বোরো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে কাউয়াদিঘি হাওর লগোয়া রাজনগর ও মৌলভীবাজার উপজেলায় বোরো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ৯শ হেক্টর। এর মধ্যে রাজনগর উপজেলায় ১৯৫০ ও সদর উপজেলায় ৯৫০ হেক্টর জমি। মনু প্রকল্প এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯৮৭ হেক্টর বোরো ফসলের জমি। হাওর পাড়ের বোরো চাষি ইসলামপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী (৬৫), সালিম মিয়া (৬০), কাশিমপুরের জমসেদ আলী (৫৬), করিম মিয়া (৫০), ইসলামপুরের রবিউল মিয়া, (৬২), কটু মিয়া (৬৫)সহ অনেকেই জানালেন এ পাম্প হাউজটিই তাদের জন্য অভিশাপ। কাশিমপুর পাম্প হাউজের শুরু থেকেই অপারেটর দায়িত্বে থাকা মতিউর রহমান বলেন, ৮টি পাম্পের মধ্যে ৫টি সচল। তবে দীর্ঘ দিন থেকে পাম্পগুলো সার্ভিসে থাকায় পাম্পগুলোর কর্মক্ষমতা অনেকটাই কমে গেছে। মনু প্রকল্প ও হাওর রক্ষা সমন্বয় পরিষদের সমন্বয়ক সরওয়ার আহমদ, আহ্বায়ক বকসি ইকবাল আহমদ ও সদস্যসচিব নকুল চন্দ্র দাশ জানান, দীর্ঘ দিন থেকে এ প্রকল্পের বেহাল দশায় এ অঞ্চলের কয়েক লাখ অসহায় কৃষিজীবী মানুষ নিঃস্ব হয়ে পথে বসার উপক্রম।
কিশোরগঞ্জের হাওরে ফসলহারা কৃষকের হাহাকার
আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ থেকে জানান, হাওরের ইটনা উপজেলার মৃগা ইউনিয়নের লাইমপাশা ভাটিরাজিবপুর গ্রামের কৃষক মো. মোতালিব মিয়া এবার ১৫ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। তার পুরো ফসলই পাানিতে তলিয়ে গেছে। ঘরে চাল না থাকায় তার ৬টি গরুর মধ্যে প্রায় দুই লাখ টাকা দামের ৪টি গরু মাত্র এক লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। এই টাকা দিয়েই এখন চলছে তার সংসার। একই অবস্থা লাইমপাশা গ্রামের সচ্ছল কৃষক মো. আক্কেল আলীর। প্রায় ১৫ একর জমির পুরোটাই হারিয়ে তিনি আজ নির্বাক। গোখাদ্যের অভাব আর সংসারের অভাবের কারণে ঘরে থাকা ৬টি গরুর সবকটিই বিক্রি করে দিয়েছেন। পার্শ্ববর্তী প্রজারকান্দা গ্রামের কৃষক আরশ আলী ১০ একর জমি থেকে এক আঁটি ধানও কাটতে পারেননি। সবই চলে গেছে সর্বনাশা বানের পানিতে। ঘরে থাকা ২টি গরুই বিক্রি করে অভাব সামাল দিচ্ছেন কোনভাবে। একই অবস্থা প্রজারকান্দা গ্রামের বড়ো গৃহস্থ মুল্লুক চাঁন মিয়ার। ২৫ একর জমির সবটা হারিয়ে এখন হাত দিয়েছেন ঘরে থাকা গরুর পালে। অভাবের তাড়নায় এরই মধ্যে ১৪টি গরুর মধ্যে ৭টি গরু বেচে দিয়েছেন তিনি। শ্রীরামপুর গ্রামের জয়নাল আবেদীন হাওরের ৮ একর জমি খুঁইয়ে বিক্রি করেছেন ঘরে থাকা একটি গরুও। শ্রীরামপুর গ্রামেরই সচ্ছল কৃষক আবদুল হাশিমের অবস্থা আরো শোচনীয়। ২০ একর জমি হারিয়ে একেবারে বোবা বনে গেছেন তিনি। ৩২টি গরুর বিশাল পাল থেকে বিক্রি করে দিয়েছেন ১৬টি গরু। কালীপুর গ্রামের গেদন হাজী আর মো. আবদুল হাশিম মেম্বার দু’জনেই ২০ একর করে জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। ফসল হারিয়ে তারাও পড়েছেন গভীর সংকটে। গেদন হাজীর গোয়ালে থাকা ৬টি আর মো. আবদুল হাশিম মেম্বারের গোয়ালে থাকা ২টি গরুই শেষ সম্বল হিসেবে বিক্রি করে দিয়ে তারা আজ নিঃস্বের কাতারে নাম লিখিয়েছেন। একইভাবে কাটিয়ারকান্দা গ্রামের অলি মিয়া ১২ একর জমির ধান হারিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন ৮টি গরুর সবক’টিই। লাইমপাশা মাদরাসা হাটি গ্রামের স্থানীয় পশু চিকিৎসক সেলিম শাহী জানান, মানুষ অভাবের তাড়নায় আর গোখাদ্যের অভাবে এলাকার সব গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন। পুরো এলাকা গরুশূন্য হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় তিনিও বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ জন্যে তিনি গাজীপুরে গিয়ে অন্যকিছু করার চেষ্টা করছেন বলেও সেলিম শাহী জানান। কেবল মৃগা ইউনিয়নের এই কয়েকটি গ্রামই নয় প্রকট দারিদ্রকে সঙ্গী করেই চলছে হাওরপাড়ের মানুষের জীবন। আগাম বন্যায় ফসলহানি কেড়ে নিয়েছে মানুষের মুখের হাসি। চরম দুঃসময় জেঁকে বসেছে কিশোরগঞ্জের হাওরপাড়ে। গ্রামে গ্রামে চলছে ফসলহারা মানুষের হাহাকার। নিত্য অভাব আর অর্থকষ্টে দুর্বিষহ হয়ে ওঠেছে হাওরবাসীর জীবন। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের সংস্থান করতে অনেকেই ছাড়ছেন হাওরের প্রিয় গৃহকোণ। আবার অনেকেই জলের দামে ঘরের গরু বিক্রি করে কিনছেন দুর্মুল্যের চাল। এ পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। মঙ্গলবার পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা হিসেবে ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং ৫৫০ টন চাল বিতরণ করার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস। বিকালে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জেলা প্রশাসক জানান, কিশোরগঞ্জে হাওর অঞ্চলের মোট ১ লাখ ২৯ হাজার ৩২৬ হেক্টর আবাদী জমির মধ্যে ৫৭ হাজার ৮৮৭ হেক্টর জমির বোরো ধান আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত জমি থেকে ২ লাখ ৪হাজার ৩৪১ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হতো যার আর্থিক মূল্য ৮১৭ কোটি ৩৬ লাখ চুয়াল্লিশ হাজার চারশ’ টাকা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯২ জন কৃষক। প্রেস ব্রিফিংয়ে জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস আরো জানান, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে অগ্রাধিকারভিত্তিতে ৫০ হাজার কৃষক পরিবারের প্রত্যেককে সহায়তা হিসেবে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল ও নগদ ৫শ’ টাকা দেয়া হবে। এ জন্যে তালিকা তৈরির কাজ চলছে। দু’য়েক দিনের মধ্যে তালিকা তৈরির কাজ শেষ হলে এসব বিতরণ করা শুরু হবে। এছাড়া ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলী এই চার উপজেলার প্রত্যেক ইউনিয়নে তিন জন করে ডিলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করবেন। জেলা প্রশাসনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোর মধ্যে ইটনা উপজেলায় ১৯ হাজার ৭৮০ হেক্টর, মিঠামইন উপজেলায় ১৪ হাজার ১১০ হেক্টর, অষ্টগ্রাম উপজেলায় ১৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর, নিকলীতে ৫ হাজার ৮১৫ হেক্টর, করিমগঞ্জে ৩ হাজার ৪০ হেক্টর, তাড়াইলে ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর, বাজিতপুরে ৫৫০ হেক্টর, ভৈরবে ৩০৫ হেক্টর হোসেনপুরে ১১০ ও কটিয়াদীতে ৬০০ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে স্থানীয় কৃষকেরা সরকারি এই হিসাব মানতে নারাজ। তাদের দাবি, সরকারি হিসেবের চেয়ে প্রকৃত ক্ষতি আরো অনেক বেশি হবে। ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলী, তাড়াইল ও করিমগঞ্জ এই ছয় উপজেলাতেই ক্ষতির পরিমাণ ৮০ হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে যাবে বলে তারা জানিয়েছেন। স্থানীয় কৃষকেরা জানান, জেলার ৯৩টি হাওরের সবকটিই এখন জলমগ্ন। এসব হাওরে অক্ষত বলতে এখন আর কোন জমি নেই। উজান এলাকার কয়েকটি হাওর ছাড়া সিংহভাগ হাওরেরই বোরো ফসল ঘরে তোলার অনুপযুক্ত। এর মধ্যে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার সবকটি হাওরই এখন পানির নিচে। এই তিন উপজেলার মোট ৬৮ হাজার ১৭৭ হেক্টর আবাদী জমির অন্তত ৫৫ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান পানির নিচে পঁচছে। জলমগ্ন কিছু হাওরের ফসল নৌকা আর দুর্মূল্যের শ্রমিক দিয়ে কাটার চেষ্টা করছেন কোন কোন এলাকার কৃষক। এ পরিস্থিতিতে তিন উপজেলার ৩২৫টি গ্রামের চার লক্ষাধিক মানুষের মুখের হাসি হারিয়ে গেছে। এসব এলাকার লক্ষাধিক কৃষক পরিবারের দিন কাটছে চরম অনিশ্চতায়।
কৃষকের স্বপ্নে সমাধি
তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ, জামালগঞ্জ (সুনামগঞ্জ) থেকে জানান, সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে বোরো ফসল ডুবির কারণে চারদিকে হাহাকার বিরাজ করছে। শনির হাওরের পর এবার পাকনা হাওরের ফসল ডুবার মধ্য দিয়ে সুনামগঞ্জের কৃষকের স্বপ্নে সমাধি হলো। জেলার সর্ব শেষ পাকনা হাওরের ১০ হাজার হেক্টর বোরো ফসলি জমিতে চাষাবাদ হয়েছিল। উরার বন্দ বাঁধ ভেঙে বিশাল হাওরের চারদিকে পানি থৈথৈ করছে। এছাড়া ওই হাওরে পানি প্রবেশ করায় পাকনা সংলগ্ন জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়ন ও ভিমখালী ইউনিয়নসহ প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর বোরো জমি পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে।
জীবন বাঁচানোর সম্পদ কষ্টে ফলানো বোরো ফসল চোখের সামনে তলিয়ে যাওয়ায় বানের পানি আর চোখের পানি একাকার হয়ে গেছে। কৃষক-কৃষাণীদের বুক ফাটা কান্নায় এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে পাকনা হাওর পাড়ের গ্রামগুলোতে। গত ক’দিন পূর্বে যেখানে ছিল সবুজের সমারোহ, এখন সেখানে রূপালী ঢেউ খেলা করছে। হাওরের উপরের অংশের আংশিক জমিতে অনেক কৃষক আধা পাকা ধান কোমর পানিতে নেমে কাটছে। পাকনা হাওরের ফেনারবাঁক গ্রামের কৃষক সাজিদুর রহমান বলেন, আধাপাকা ধান পানির নিচে গেল নীরব দর্শকের মতো দেখলাম কিছুই করতে পারলাম না, হায়রে আমরার পড়া কপাল। নবাব মিয়া বড় আক্ষেপ করে বলেন, হাজার হাজার মানুষ লইয়া কাজ কইয়াও শেষ রক্ষা হয় নাই। আমরার কি অবস্থা অইবো আল্লাই জানে। “বৈশাখ মাসে এত ফানি জীবনে দেহিনাই, চোখের সামনে কাঁচা-আধাপাকা ধান ফানির নিচে গেছে। কিছু ধান পাকা ভাব ক্ষেতে এহন মাত্র ধান বাহির হইছিল, দেনা কইরা জমি (কৃষিজমি) করছিলাম, দেনাই দিমু কেমনে আর কি কইরা বউ-বাচ্চা নিয়া সারা বছর চলমু এই চিন্তায় জীবন শেষ”। স্থানীয় কৃষকরা জানান, চৈত্রের মাঝামাঝি যখন হাওরের বাঁধের অবস্থা খারাপ খবর পেয়েছেন তখন থেকেই গ্রামে গ্রামে মাইকিং করে বাঁধে হাজার হাজার মানুষ স্বেচ্ছায় মাটি কাটার কাজ করেছেন। এ সময় পাউবোর কোনো কর্মকর্তা কর্মচারীকে বাঁধে দেখেননি। তারা আরো অভিযোগ করেন কোটি কোটি টাকা লুটপাট আর দুর্নীতি করে বাঁধের কাজ ঠিকমতো করেননি। সব হারিয়ে কৃষকরা এখন কোমর পানি বুক পানিতে নেমে কাঁচা ধান কাটছেন। তবে স্থানীয় কৃষি বিভাগের তথ্য মতে জামালগঞ্জ উপজেলায় ৮০ ভাগ বোরো ফসল পানির নিচে ডুবে গেছে বললেও বেসরকারি মতে ৯০ ভাগ ফসল তলিয়ে গেছে বলে কৃষকরা ধারণা করছেন। চৈত্রের শেষ দিকে অতিবর্ষণে প্রথম দফায় পানিতে তলিয়ে গেছে হাজার-হাজার হেক্টর বোরো জমি। আংশিক জমি ভাসমান থাকলেও এবার বাঁধ ভাঙার কারণে এগুলোও পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। বছরের একটি মাত্র বোরো ফসল বৈশাখে কাটা ও মাড়াই শুরু হয় এই অঞ্চলে। এবার হাওরের ফসল ডুবে কৃষকদের স্বপ্ন ও মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। হাজার হাজার কৃষকের কান্নায় হাওর এলাকার আকাশ এখন ভারি হয়ে উঠেছে।
জগন্নাথপুরের মাছ বাজারে হাহাকার
জগন্নাথপুর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে ফসলহানির পর মাছে মড়ক দেখা দেয়ায় মাছ বাজারে হাহাকার চলছে। ১৭ই এপ্রিল উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাসে আক্রান্ত মাছ না খাওয়ার জন্য এলাকায় মাইকিং করা হয়। এরপর থেকেই ভয়ে হাওরের মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন এলাকাবাসী। গতকাল উপজেলা সদরের মাছ বাজার ঘুরে দেখা যায়, স্থানীয় প্রজাতির কোনো মাছ নেই। কিছু ইলিশ মাছ ও ঝাটকা উঠেছে। তবে ফিশারির মাছ বেশি পরিমাণে দেখা গেছে বাজারে। উপায় না পেয়ে কেউ কেউ ফিশারির মাছ ক্রয় করছেন। তাও আবার বেশি দামে। স্থানীয় জাতের মাছের সংকট দেখা দেয়ায় দাম বেড়ে গেল ফিশারির মাছের।
বিক্রেতারা জানান, গ্রীষ্মের শুরু এমনিতেই মাছের সরবরাহ থাকে কম। এর মধ্যে মড়ক শুরু হওয়ায় বাজারে সংকট দেখা দিয়েছে। ক্রেতারাও মাছ কেনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
জগন্নাথপুর বাজারের মাছ বিক্রেতা জয়নাল আবেদন জানান, জগন্নাথপুরের হাওরগুলোতে মাছে মড়ক দেখা দেয়ার পর থেকে স্থানীয় জাতের কোনো মাছ বিক্রি হচ্ছে না। মাছে মড়ক আসার পূর্বে আমি স্থানীয় প্রজাতির মাছ বিক্রি করতাম। কিন্তু হাওরের মাছ কেউ ক্রয় করে না এখন। তাই গত দুই তিন দিন ধরে সিলেট থেকে ইলিশ মাছ এনে বিক্রি করছি।
পৌরশহরের ইকড়ছই এলাকার বাসিন্দা আবদুস সালাম জানান, দেশীয় জাতের মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। গত ৮ দিন ধরে মাছ খাচ্ছি না। আরেক বাসিন্দা মুজিবুর রহমান জানান, মাছে মড়ক আসার পর থেকেই মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। গতকল ফিশারির মাছ খেয়েছি। গত এক সপ্তাহ ধরে তাদের পরিবারের কেউ স্থানীয় প্রজাতির মাছ খাচ্ছে না।
উপজেলাবাসী জানান, ১লা এপ্রিল অকালবন্যা ও অতিবৃষ্টিতে উপজেলার বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ায় পর পানির নিচে থাকা ধানগাছ পচে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এতে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গত ১৬ই এপ্রিল হাওরের মাছগুলো মরে পানিতে ভেসে ওঠে। ব্যাপকহারে উপজেলার বিভিন্ন হাওর, নদী, জলাশয়ে মাছ মরে পচে যাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে উপজেলা প্রশাসন এসব মাছ না খাওয়ার জন্য উপজেলাবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে মাইকিং করেন। জগন্নাথপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ওয়াহিদুল আবরার জানান, জগন্নাথপুরের হাওরের পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস কমে গেছে। পানিতে অক্সিজেন বাড়ছে। বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত মরা মাছ খাওয়া যাবে না। তবে সুস্থ মাছ খাওয়া যাবে।
জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সামসুদ্দিন জানান, হাওরের অ্যামোনিয়া গ্যাসে আক্রান্ত মাছ খেলে পেটে পীড়া ও ডায়রিয়া রোগ হতে পারে। বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত মাছ খেয়ে এখনো কেউ অসুস্থ হয়নি।
দীর্ঘ হচ্ছে কৃষকের হাহাকার
কটিয়াদীতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার করগাঁও, চান্দপুর ও সহশ্রাদ ধূলদিয়া ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল উজানের পানিতে তলিয়ে গেছে। তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান এখন পানির নিচে। ঘরে তুলতে পারছে না তাদের একমাত্র বোরো ফসল। ফলে দীর্ঘ হচ্ছে কৃষকের হাহাকার।
জানা যায়, বোরো মৌসুমে বড় হাওরের দ্বার হিসেবে পরিচিত করগাঁও, ধূলদিয়া ও চান্দপুরের নিম্নাঞ্চলের একমাত্র ফসল বোরো ধান। বছরে মাত্র একটি ফসল ফলে থাকে এই এলাকায়। এই ফসলেই কৃষকের সারা বছরের খাদ্য মজুত করে উদ্বৃত্ত ধান বিক্রি করে সংসারের সমস্ত খরচ মিটিয়ে থাকেন। উজানের পানিতে হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসলহানির ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এলাকার কৃষক। আধাপাকা-কাঁচা ধান কোনো রকম কাটার উপযোগী মনে করলেই ধান ঘরে তুলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না শ্রমিকের স্বল্পতা, অধিক মজুরি আর জোঁকের প্রাদুর্ভাবে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, করগাঁও ইউনিয়নে এবার ১ হাজার ৬৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। গত কয়েক দিনের উজানের পানিতে ৪শ’ হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এরমধ্যে ১৮০ হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণরূপে এবং ২২০ হেক্টর জমির ধান আংশিক তলিয়ে গেছে।
ধূলদিয়া ইউনিয়নে ১ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। এরমধ্যে ২শ’ হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এরমধ্যে ৭০ হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণরূপে এবং ১৩০ হেক্টর জমির ধান ডুবন্ত অবস্থায় আছে। অবস্থার উন্নতি না হলে এর সবগুলোই ডুবে যাবে।
চান্দপুর ইউনিয়নের ১হাজার ৬৮০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়। এরমধ্যে ১০ হেক্টর জমির ধান ডুবন্ত অবস্থায় আছে। কৃষি অফিস সূত্রে ৬১০ হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বললেও বাস্তবে এ ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার হেক্টরের বেশি হবে বলে স্থানীয় চেয়ারম্যান এবং এলাকাবাসী জানায়।
চান্দপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাহতাব উদ্দিন বলেন, একদিকে শ্রমিকের দাম বেশি অন্য দিকে জোঁকের প্রাদুর্ভাব প্রচণ্ড। ফলে যে সকল জমির ধান কাটার সুযোগ আছে সেগুলোও শ্রমিকের দাম এবং রক্তচুষা জোঁকের কারণে ধান কাটতে পারছে না কৃষক। কিশোরগঞ্জ-২, কটিয়াদী পাকুন্দিয়া আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট সোহরাব উদ্দন, উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল ওয়াহাব আইন উদ্দিন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা উজানের পানিতে তলিয়ে যাওয়া জমির ফসল পরিদর্শন করেন।
দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের সব বিভাগ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে: অতিরিক্ত সচিব
তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সাংবাদিকদের সব পরামর্শই জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকার বাস্তবায়ন করবে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত জেলাবাসীকে আশ্বস্থ করতে চাই যে, তাদের সব প্রয়োজনে সরকার সবসময় পাশে আছে এবং থাকবে। জেলা প্রশাসনের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে সরকারের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সব বিভাগ ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজ করবে। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা প্রদান নিয়ে সংবাদ সম্মেলন ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে সোমবার রাতে ও মঙ্গলবার সকালে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে ওই সংবাদ সম্মেলন ও মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য এসব কথা বলেন, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও সাবেক জেলা প্রশাসক মো. ফয়জুর রহমান। সভায় লিখিত বক্তব্যে জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টির কারণে আকস্মিক বন্যায় সুনামগঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারকে সহায়তার জন্য ইতিমধ্যে ১০০০ মে.টন জিআর চাল এবং ৪৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা জিআর ক্যাশ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় পরিবার প্রতি ৩০ কেজি হারে ২৩শে এপ্রিল হতে জেলার ১১টি উপজেলা ও ৪টি পৌরসভায় মোট দেড় লাখ কার্ডের মাধ্যমে বন্যাক্রান্ত, অন্যান্য দুর্যোগাক্রান্ত, দুস্থ, অতিদরিদ্র ব্যক্তি ও পরিবারের মধ্যে বিতরণের জন্য মেয়র ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের উপ-বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ইতিমধ্যে ১৫৫ বান্ডেল ঢেউটিন ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণের পর ৭০ মে.টন. জিআর চাল, ৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা ক্যাশ ও ৩০ বান্ডেল ডেউটিন মজুদ রয়েছে। সর্বশেষ ৩০ কেজি হারে আগামী তিন মাস ৮ দিনের জন্য দেড় লাখ কার্ডের মাধ্যমে ভিজিএফ সাহায্য হিসেবে ১৪ হাজার ৭ শত মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। স্থানীয়ভাবে সুনামগঞ্জে ৭ হাজার মে.টন চাল মজুদ রয়েছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়। সভায় উপস্থিত সাংবাদিকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, দৈনিক সুনামকণ্ঠ সম্পাদক বিজন সেন রায়, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি আল-হেলাল, যুগান্তর প্রতিনিধি মাহবুবুর রহমান পীর, দৈনিক সুনামগঞ্জের সময় পত্রিকার সম্পাদক সেলিম আহমেদ, বাংলাভিশন টিভির জেলা প্রতিনিধি মাছুম হেলালসহ স্থানীয় সাংবাদিকবৃন্দ। সভায় সাংবাদিকেরা বলেন, যে জনপ্রতিনিধিরা পিআইসির সভাপতি সেজে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজে ব্যাপক লুটতরাজ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সরকারি বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করেছেন আর তাদের নিয়ে নয় বরং জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণে পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করা হোক। এছাড়া হাওরের সুনামগঞ্জের প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে সরকারের সব বরাদ্দ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রদান করা হউক। যেহেতু শতকরা ৯০ ভাগ কৃষকই ফসল হারিয়েছেন সেহেতু জেলার ৩ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসনের আওতায় আনতে হবে। ১৫ টাকা কেজি দরে ওএমএসের চাল ও ১০ টাকা কেজি মূল্যের খাদ্যবান্ধব এ চাল বিক্রয় কর্মসূচিকে জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে ওয়ার্ডভিত্তিক ডিলার নিয়োগের পরামর্শ দেন সাংবাদিকরা। এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. সফিউল আলম, এনডিসি মোহাম্মদ নাহিদ হাসান খান, জেলা প্রশাসকের স্টাফ অফিসার মোহাম্মদ আমিনুল এহসান খানসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।