বিশ্বমিডিয়ায় সার্ফার নাসিমা

বাংলাদেশের নারী সার্ফিংয়ের পথিকৃৎ বলাই যায় তাকে। তার হাত ধরে রোমাঞ্চকর, উত্তেজনার সার্ফিংয়ের নাম লিখেছে বাংলাদেশ। নানা প্রতিকূলতা, সামাজিক রক্ষণশীলতা বাধা হয়েছিল তার পথচলায়। কিন্তু সেসব গায়ে মাখেননি। পাত্তা দেননি নাসিমা আক্তার। সেজন্যই আজ তার পরিচয় বিশ্বব্যাপী। বিশ্ব সার্ফিংয়ের আলোচিত এক নারী।

সাগরপাড়ের মেয়ে নাসিমা। প্রতিবেশী ছেলেমেয়েরা যখন স্কুলে যান, খেলাধুলায় মেতে থাকেন সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে। তখন ঘর ছাড়তে হয় ৯ বছরের বালিকা নাসিমাকে। ঘর ছেড়ে অজানার সঙ্গী হলেও দমে যাননি। বরং জেদী হয়েছেন। উত্তাল ঢেউকে জয় করতে হয়েছেন তেজস্বিনী। সমুদ্রের জলে দাঁড়িয়ে বেড়ানোর নেশা নাসিমাকে আজ বিশ্বব্যাপী পরিচয় দিয়েছে। বয়স ১৮, চপলা কিশোরী নাসিমা এখন এক দুরন্ত সার্ফার। মুসলিম ঘরের এক কিশোরীকে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউকে জয় করতে দেখে বিস্মিত বিশ্ব মিডিয়া। এমন এক কিশোরীকে নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করতে তাই লোভ সংবরণ করতে পারেননি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত নির্মাতা হিথার কিসিঞ্জার।

নাসিমা কক্সবাজারের মেয়ে। এখন সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তবে তার পথ চলাটি কিন্তু কখনোই ফুলেল ছিল না। ছিল কণ্টকাকীর্ণ। পানিতে নামায় হরদম সমালোচনার তীক্ষ্ন ছুরিতে এফোড়-ওফোড় হয়েছে তার নিষ্পাপ হৃদয়। কটূক্তি করেছেন প্রতিবেশীরা। সইতে হয়েছে গঞ্জনা। এমনকি ‘বেশ্যা’ শব্দও শুনতে হয়েছে কিশোরী বয়সে। তারপরও থেমে থাকেননি। সার্ফিংয়ের প্রতি তার আগ্রহ এবং অদম্য ভালোবাসা কোনো বাধাকে বাধা হতে দেয়নি। এগিয়ে নিয়েছে সম্মুখের পানে। ডকুমেন্টারিতে নাসিমার এই লড়াইয়ের চিত্রই তুলে ধরেছেন নির্মাতা কিসিঞ্জার। ‘দ্য মোস্ট ফিয়ারলেস’ বা ‘ভয়ডরহীন’- ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয়েছে নাসিমার বাড়ি ছাড়া থেকে সার্ফার হওয়া পর্যন্ত। ৯ বছর বয়সে বাড়িছাড়া নাসিমার জায়গা হয় ‘বাংলাদেশ সার্ফ ক্লাব’ নামে একটি সংগঠনে। সংগঠনটির পৃষ্ঠপোষক একটি মার্কিন মিশনারি। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তরতর করে এগিয়েছেন নাসিমা। তার দেখানো পথে এখন অনেক নারী সার্ফার রয়েছেন ক্লাবটিতে। এখন তাদের সংখ্যা ৮। তাদেরকেও সহযোগিতা করছে সংগঠনটি। তাদেরও নানা বিদ্রূপ, লাঞ্ছনা, গঞ্জনার মধ্যেই এগোতে হচ্ছে। নাসিমার ভালোবাসার নাম সার্ফিং। কিন্তু সমাজের মতো তার পরিবারও পছন্দ করে না তার সার্ফিং। কিন্তু ভালোবাসার টানে ছাড়তে পারছেন না সার্ফিং, ‘আমার স্বামী এবং পরিবারের সদস্যরা সার্ফিং পছন্দ করে না। শুধু আমি নয়, বাংলাদেশের অন্য মেয়েরা সার্ফিং করুন, এটা তারা চায় না। কিন্তু আমি সার্ফিং ভালোবাসি। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে সার্ফিং করতে আমার ভীষণ, ভীষণ ভালো লাগে।’

নাসিমার এই উঠে আসার গল্পের শুরু চার বছর আগে। মার্কিন সাংবাদিক জয়মাল ইয়োগিস একটি প্রতিবেদন লিখেন। তার প্রতিবেদন পড়ে উৎসাহিত হন কিসিঞ্জার। সিদ্ধান্ত নেন নাসিমাকে নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করবেন। এরপর তৈরি করেন ডকুমেন্টারি ‘দ্য মোস্ট ফিয়ারলেস’ বা ‘ভয়ডরহীন’। শুধু ডকুমেন্টারি নয়, আলোচিত নাসিমাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ‘সানডে টাইমস’, ‘দ্য গার্ডিয়ান’ এবং অস্ট্রেলিয়ার ‘দ্য অস্ট্রেলিয়ান’- এ। নারী বিষয়ক আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ম্যারি ক্লেয়ারেও প্রকাশিত হয়েছে নাসিমার সচিত্র প্রতিবেদন। বিশ্বব্যাপী নাসিমাকে পরিচিত করে দেওয়া নির্মাতা কিসিঞ্জার বলেন, ‘নাসিমা একজন ভালো মুসলিম স্ত্রী হতে চান। এজন্য সার্ফিংয়ের প্রতি তার যে ভালোবাসা, অনুরাগ, সেটা ছাড়তে রাজি নন।’ ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য সানডে টাইমস ‘বাংলাদেশি সার্ফার গার্ল সিঙ্কস মুসলিম ট্যাবুজ’ শিরোনামে লিখেছে- ‘নাসিমা বাংলাদেশের একজন সার্ফার। এ কিশোরী বাংলাদেশের রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের প্রচলিত প্রথা ভেঙে মেয়েদের সার্ফিং শেখাচ্ছেন। সমাজের পঙ্কিল পথগুলোকে পেছনে ফেলে বেরিয়ে আসতে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন, উৎসাহ দিচ্ছেন। সার্ফিং প্রতিযোগিতাগুলোতে অংশ নিয়ে সাফল্য পাচ্ছেন। হারাচ্ছেন পুরুষদেরও। নাসিমা শুধু বাংলাদেশের নারী সার্ফিং সূচনার পথিকৃৎ।’

নাসিমা কক্সবাজারের লাইফসেভিং অ্যান্ড সার্ফিং ক্লাবে বাংলাদেশের প্রথম নারী লাইফগার্ড। তারপরও তার জীবন সংগ্রাম থেমে থাকেনি। নারীদের পথিকৃৎ হলেও জীবন সংগ্রাম করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সংসার চালাচ্ছে না সার্ফিং থেকে আয়কৃত অর্থে। কিন্তু সেটা দিয়ে না হওয়ায় সমুদ্র থেকে তুলে আনা শামুক-ঝিনুকের খোলস দিয়ে তৈজসপত্র তৈরি করে বাজারে বিক্রয় করে সংসারের অর্থ সংগ্রহ করছেন তিনি। আর রাত্রিযাপন? ভয়ঙ্কর! সমুদ্র সৈকতে উল্টো করে শুইয়ে রাখা নৌকার তলায় রাত পার করতে হয় নাসিমাকে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর