বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট-২ আসনের সাবেক এমপি এম. ইলিয়াস আলী নিখোঁজের পাঁচ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ ১৭ এপ্রিল। ফিরে আসার অপেক্ষায় ইলিয়াস আলীর পরিবারের সদস্যরা আজো আশায় বুক বেঁধে আছেন।
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর সভা, সমাবেশ, হরতাল, মিছিল হয়েছে। এসবের কোনোটাই ইলিয়াছকে ফেরাতে পারেনি। সর্বশেষ তার স্ত্রী তাহসিনা রুশদী লুনা প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হয়েছেন, আশ্বাসও পেয়েছেন, কিন্তু স্বামীকে আজো ফিরে পাননি। তিন সন্তানকে নিয়ে ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা থাকেন ঢাকার বনানীতে।
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে ইলিয়াস আলী নিজ বাসায় যাওয়ার পথে বনানী থেকে নিখোঁজ হন। তার সঙ্গে গাড়িচালক আনসারও নিখোঁজ হন। আত্মীয়তার সম্পর্ক না থাকলেও একই এলাকার হওয়ায় ইলিয়াসকে চাচা বলে ডাকতেন আনসার। ইলিয়াসও তাকে ভাতিজা বলে ডাকতেন।
ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার। স্বামী নিখোঁজ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানান, তার স্বামী ফিরে আসবেন, এটা তিনি বিশ্বাস করেন। ইলিয়াস আলীর এলাকার মানুষও এটা বিশ্বাস করে। তিনি এ-ও বলেন, ‘বাস্তব পরিস্থিতি হয়তো ভিন্ন, অনেকের কাছে অনেক কিছু মনে হতে পারে, তবে বিশ্বাস করি একদিন না একদিন সে ফিরবেই। ’
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন তাহসিনা রুশদী লুনা। এ ছাড়া হাইকোর্টে ইলিয়াসের খোঁজ চেয়ে রিটও করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালতে পুলিশ কয়েক ডজনবার প্রতিবেদন দিয়েছিল। এখন কী অবস্থায় আছে, সে খবর আর রাখেন না তিনি। তিনি বলেন, ‘মামলা তো পুলিশ নিল না। এখন জানি না পুলিশের অগ্রগতি কী?’
ইলিয়াস ও তার গাড়িচালকের নিখোঁজের বিষয়টি তদন্ত করে বনানী থানা-পুলিশ। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে ২৪টি তদন্ত প্রতিবেদন উচ্চ আদালতে দাখিল করেন থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা কাজী মাইনুল ইসলাম। যদিও এসব প্রতিবেদনে তার নিখোঁজ হওয়ার আগের অবস্থান ও গাড়ির বিবরণগুলো ঘুরেফিরে এসেছে।
তাহসিনা রুশদী লুনা জানান, এখনও প্রতিমুহূর্তে তার আশায় পথ চেয়ে থাকে তার পরিবারের সদস্যরা। যখনই টেলিভিশনের সামনে বসেন সংবাদের স্ক্রলের দিকে চেয়ে থাকেন। একটা ব্রেকিং নিউজের জন্য অপেক্ষা করেন; যেখানে লেখা থাকবে ইলিয়াস আলীকে পাওয়া গেছে। পরিবারের সবাই প্রতিটি মুহূর্ত তার ফেরার অপেক্ষায় আছে। তাদের বিশ্বাস, ইলিয়াস বেঁচে আছেন এবং ফিরে আসবেন। এখন আল্লাহর ওপর ভরসা করে বসে আছেন পরিবারের সদস্যরা।
তিনি আরো জানান, স্বামী ছাড়া তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা ভালো নেই। এখনও ভাবেন ইলিয়াস যেকোনো দিন যেকোনো মুহূর্তে তাদের মধ্যে ফিরে আসবেন। তার প্রত্যাশায় পথের পানে চেয়ে থাকে ছেলেমেয়েরা।
তাহসিনা রুশদী লুনা জানান, দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে আবরার ইলিয়াস বর্তমানে লন্ডনে এলএলবি ফাইনাল ইয়ারে পড়াশোনা করছেন। ছোট ছেলে লাবিব সারা অ্যাকাউন্টিংয়ে প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছে। এছাড়া একমাত্র মেয়ে সাইয়ারা নাওয়াল ঢাকায় বিআইএস স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। ইলিয়াস আলী নিখোঁজের পর র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দফায় দফায় গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করেছিল। কিন্ত কোনো ফল হয়নি।
গাড়ী চালক আনসারের স্ত্রী মুক্তা বেগম তার গ্রামের একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘যেখানেই আছেন আনসার, ইলিয়াসের সঙ্গেই আছেন। তারা জীবিত আছেন, একদিন ঠিকই ফিরবেন। ’
আনসার আলীর বাবা নেই। দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। পরিবারে মা, স্ত্রী, ভাইবোন ছাড়াও রয়েছে তার একমাত্র কন্যাসন্তান। নিখোঁজ হওয়ার সময় মেয়ে মারিয়া মাহজাবিনের বয়স ছিল তিন বছর, সে এখন আট বছরে, পড়ছে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ।
আনসারের মা নূরজাহান বেগম (৬১) বলেন, তার ছেলের বেতনের টাকা প্রতি মাসে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। পাঁচ বছর ধরে এ দায়িত্ব পালন করছেন ইলিয়াস আলীর স্ত্রী। এ টাকা আর ছেলের বউয়ের শিক্ষকতার বেতনে চলে সংসার। সংসারে অভাব, টানাপোড়েনের চেয়ে আনসারের কোনো খোঁজ না পাওয়াই স্ত্রী ও মায়ের কাছে সবচেয়ে কষ্টের।
এদিকে ইলিয়াস আলীকে অবিলম্বে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। রোববার রাজধানীতে নিখোঁজের পাঁচ বছর অতিবাহিত হওয়ার প্রতিবাদে এক যুব সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ দাবি জানান।
সরকারকে উদ্দেশ করে আমির খসরু বলেন, ‘নিখোঁজ ইলিয়াস আলীকে অতিসত্বর তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিন। তা না হলে দেশের মানুষ আপনাদেরকে ক্ষমা করবে না। হত্যা, গুম আর নির্যাতনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করে বেশি দিন ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না। দেশের মানুষ এসব নির্যাতনের উচিত জবাব দেবে।’