রাষ্ট্র সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ছয়টি কমিশনের কার্যক্রম জোর কদমে এগিয়ে চলছে। কিছুদিন ধরেই কমিশনগুলোর কার্যক্রম দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। কমিশনগুলো একের পর এক বৈঠক করছে অংশীজনের সঙ্গে। নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মতামত। তাদের মতামত নেওয়ার এ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে গত ৪ নভেম্বর ওই ছয় কমিশনের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে কমিশনের কার্যক্রমের অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয়। তবে এখনও স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকার এবং নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন হয়নি। এই চার সংস্কার কমিশন গঠনের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।
জানা গেছে, বৈঠকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী জানান, তার কমিশনের কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সবার মতামত সংগ্রহ করা হচ্ছে। কমিশনের সদস্যরা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সফর করে জনসাধারণের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। জনপ্রশাসনের বিভিন্ন ক্যাডার প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময় শুরু হয়েছে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে কমিশনপ্রধান সফর রাজ জানান, পুলিশ সংস্কার কমিশন এরই মধ্যে ১০টি সভা করেছে। পাশাপাশি অংশীদারদের সঙ্গে চারটি বৈঠক করেছে। জনসাধারণের মতামত চেয়ে কমিশন একটি প্রশ্নমালা প্রস্তুত করছে, যা এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। সফর রাজ বলেন, কিছু আইন ও বিধি সংশোধনের প্রস্তাব এসেছে, যেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।
এদিকে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে কমিশন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার জানান, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অনুপস্থিত ভোটারদের জন্য পোস্টাল ব্যালট নিয়ে কাজ চলছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে ভোটার তালিকা সমন্বয় করা হচ্ছে। নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে জোর দিচ্ছে নির্বাচন সংস্কার কমিশন। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অংশীদারদের পরামর্শ গ্রহণ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে ইসি নিবন্ধিত ৪৭টি দলের মধ্যে ২২টি দল ও জোটের কাছে প্রস্তাব চেয়েছে কমিশন। সংস্কারের জন্য সব অংশীজনের মতামত নেবে তারা। আগামী ২৫ নভেম্বরের মধ্যে মতামত জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন জোটভুক্তদের কাছে মতামত চাওয়া হয়নি।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা আইন কানুন গভীরভাবে পর্যালোচনা করছি। আমরা কিছু মতামত পেয়েছি। গণমাধ্যমের মতামতও নেব। তবে দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের দরকার নেই বলে মনে করেন তিনি। অনেক মতামত বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা সংশ্লিষ্ট কমিশনের সঙ্গে বসব।
এদিকে, গত ১২ নভেম্বর বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন বৈঠক করেছে। এত অংশ নিয়েছিলেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আলোচনায় কমিশনের কাজের অগ্রগতি কতটুকুÑ এটি জানতে চেয়েছি। ওনারা কিছু সমস্যার কথাও বলেছেন।’
অন্যদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশনের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট চালু করা হয়েছে। ওয়েবসাইটের ঠিকানা- http://crc.legislativediv.gov.bd। সংবিধান সংস্কার কমিশনের এই ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে সংবিধান সংস্কার বিষয়ে আগ্রহী ব্যক্তি বা সংগঠন পরামর্শ, মতামত ও প্রস্তাব জানাতে পারবেন। আগামী ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পরামর্শ, মতামত ও প্রস্তাব জানার সুযোগ থাকবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থেকেও মতামত দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন গত সোমবার থেকে মতবিনিময় শুরু করেছে। জাতীয় সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে প্রথম দিনের সভায় অংশ নেন ১৬টি সংগঠনের ৩১ জন প্রতিনিধি। গত মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের সভায় যোগ দেন স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ, বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আব্দুল মালেক, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, মুসা আল হাফিজ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, ড. শহিদুল আলম এবং মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজি।
সর্বশেষ গত বুধবার তৃতীয় দিনের সভায় অংশ নেন নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, ডা. জাহেদ উর রহমান প্রমুখ। এ ছাড়া কমিশনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন সংগঠন সংবিধান সংস্কার বিষয়ে লিখিত প্রস্তাবনা জমা দিয়েছে। বিশিষ্টজনরাও লিখিত প্রস্তাব দিয়েছেন।
এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে গঠন করা কমিশনের প্রধান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে কমিশনের কাজ চলছে টিআইবি কার্যালয়ে। এরই মধ্যে তারা কয়েকটি মিটিং করেছেন।
সর্বশেষ কার্যক্রম প্রসঙ্গে ইফতেখারুজ্জামনা বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলছি। আমরা দুদকের আইনজীবীর পরামর্শ নিচ্ছি। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদেরও মতামত নিচ্ছি। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপ করছি। এ ছাড়া মেইলে পরামর্শ চেয়েছি, সেখানে অনেক সাড়া পাচ্ছি। ঢাকার বাহিরেও কমিশন যাবে বলে জানান তিনি।
গত ৩ অক্টোবর নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুদক ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। দুই দিন বাদে ৬ অক্টোবর গঠন করা হয় সংবিধান সংস্কার কমিশন। কমিশন গঠনের দিন থেকে ৯০ দিনের মধ্যে তাদের সরকারপ্রধানের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তারা সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করবেন।
এদিকে গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় অধ্যাপক একে আজাদ খানকে প্রধান করে স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামাল আহমেদকে প্রধান করে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকার নেতা সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন এবং শিরীন পারভীন হককে প্রধান করে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।