প্রাচীন মিশরের মানুষ বছরকে তিনটি ঋতুতে ভাগ করেছিলো। আখেত, পেরেত ও শেমু। আখেত ছিলো বন্যার ঋতু। নীলনদ উপচে পানি তলিয়ে দিতো চাষের জমি, বসতি। তারপর একদিন পানি নেমে যেতো। তখন সেই ঋতুকে বলা হতো পেরেত। পেরেত ফসল রোপনের ঋতু। বন্যার পর পলি জমা মাটিতে রোপন করা হতো ফসল। আর শেষ ঋতু শেমু ছিলো ফসল কাটার।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে হাওড় অঞ্চলেও তিন ঋতুর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোণার কিছু অঞ্চল জুড়ে বাংলাদেশের হাওড় অঞ্চল। এইসব হাওড় অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন মনোরম, ঠিক তেমনই কঠিন মানুষের জীবন যাপন যুদ্ধ।
এপ্রিল মাসে পাহাড়ি ঢল থেকে হাওড়ের পানি চলে আসে। ডুবে যায় চাষের জমি। হাওড়ের মানুষজন মূলত হাটিতে (এক ধরণের উঁচু ভূমি) বসবাস করে। এক একটা হাটিতে ত্রিশ-চল্লিশটা পরিবার দলা বেঁধে থাকে। মানুষজন আগে থেকেই মাটি কেটে ভিটেগুলো উঁচু করে রাখে যেন পানিতে ডুবে না যায়। আর বাঁশ ও বিলের নলখাগড়া দিয়ে শক্ত করে বাঁধ তৈরি করে তীব্র ঢেউ বা আফাল থেকে ভিটেটাকে রক্ষা করতে।
এক হাটি থেকে আর হাটিতে নৌকা ছাড়া যাওয়ার কোন উপায় নেই। হাটিগুলো তখন এক একটা ছোট ছোট দ্বীপ।
হাওড় অঞ্চলে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। যাদের নৌকা ও জাল আছে, তারা এই মিঠাপানির মাছ মারতে পারে। কেউ কেউ অন্যের জাল ও নৌকায় মাছ ধরতে শ্রম বিক্রি করে।
জেলেরা মাছ ধরে নিয়ে আসে আড়তে। আড়ত থেকে মাছ চলে যায় শহরে-শহরে। জেলেরা খুব একটা দর পায় না মাছের। এখানেও লাভবান মধ্যস্বত্বভোগীরা।
চারদিকে পানি আর পানি। শিশুদের সাবধানে রাখা হয়। যেন পানিতে ভেসে না যায়। তবে হাওড়ের শিশুরা খুব ছোট থেকেই শিখে যায় পানির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা।
সাত-আট মাস পানিবন্দী জীবনে বৈচিত্র আনতে নানা উৎসবের চেষ্টা চলে এই সময়ে। কলের নৌকা সাজিয়ে মাইক বাজাতে বাজাতে বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠান চোখে পড়ে খুব।
পানিবন্দী থাকার এই সময়ে নানা রকম গানবাজনা ও নাটকের আয়োজন করে কিছুটা বিনোদন।
নীল আকাশ, সাদা সাদা মেঘ দেখে বোঝা যায় শরৎকাল। তখনো মানুষ পানিবন্দী। যতদূর চোখ যায় আকাশের রঙ মেখে নীল জলরাশি।
হাওড় অঞ্চলে হেমন্ত বলে কোন ঋতুর দেখা মেলে না। অক্টোবরের শেষ দিকে বা নভেম্বরে পানিতে টান ধরে।
পানি নেমে গেলে মানুষজনের মাঝে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। জমি তৈরি করতে হবে। ফলাতে হবে ফসল। শিশুদের মধ্যেও দেখা যায় দীঘল মাটির স্পর্শ পাওয়ার আনন্দ।
আদিগন্ত জলরাশি। মন কেমন করা সময়। সময় যেন আর কাটতে চায় না।
হাওড় অঞ্চলের মানুষগুলো বিরুপ প্রকৃতি আর দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছে। আজকের সূর্য অস্ত গেলেও পরদিন সম্ভাবনা আর আশা নিয়ে অপেক্ষা করে নতুন সূর্যের।